মানবকল্যাণে ইসলামী অর্থনীতি
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
মানবকল্যাণে ইসলামী অর্থনীতি
মু. সাইফুল ইসলাম
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
الاقتصاد الإسلامي اقتصاد إنساني ينشد الخير والفلاح
(باللغة البنغالية)
محمد سيف الإسلام
:
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............
ইসলামী অর্থনীতিবিদগণের মতে শুধু বস্তুগত কল্যাণ ইসলামী অর্থনীতির উদ্দেশ্য নয়। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ সাধন করা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে এ বিষয়ের ওপরই আলোকপাত করা হয়েছে।
মানবকল্যাণে ইসলামী অর্থনীতি
ইসলাম আল্লাহ মনোনীত একমাত্র দীন। ইসলামে তাই রয়েছে ইহ ও পরকাল উভয় জাহানের মুক্তি এবং কল্যাণ। ইসলাম সে হিসেবে একটি জীবন ব্যবস্থাও বটে। এ ব্যবস্থা সামষ্টিক, অখণ্ডিত। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য ব্যবস্থার সমন্বয়ে নির্মিত হয়েছে ইসলামের সামগ্রিক ও সমন্বিত জীবনব্যবস্থা। ইসলামী জীবনব্যবস্থার ব্যবস্থাপনাও সামষ্টিক এবং সমন্বিত। সামাজিক ব্যবস্থা (Social System), পারিবারিক ব্যবস্থা (Family System), নৈতিক ব্যবস্থা (Moral System), অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Economic System) ইত্যাদি এ সামষ্টিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী বিধি-বিধানের প্রাচুর্যে ইসলামী জীবনব্যবস্থা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের এটি একটি বৈশিষ্ট্য। এ দিক বিবেচনায় ইসলাম অনন্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার।
ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সামগ্রিক জীবনব্যবস্থার অন্তর্গত একটি ব্যবস্থা। ইসলামী জীবনদর্শনের মৌল চেতনার আলোকে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিগঠিত। ইসলামের কিছু মৌলিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ ইসলামী অর্থনীতির আসল উপাদান। ইসলামী অর্থনীতি মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ বিষয় নয়। ইসলামী জীবন দর্শন থেকে উৎসারিত ইসলামী অর্থনীতি ইসলামী মূল্যবোধ দ্বারা বিকশিত হয়েছে। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ অর্থনীতির মৌলিক উপাদান।
বিশ্বের সব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কোনো না কোনোভাবে কিছু সামাজিক, নৈতিক অথবা ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। মূল্যবোধগুলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসমূহকে টেকসই করে রেখেছে। দেশের রাষ্ট্রশক্তি বা সরকার এ মূল্যবোধগুলো রক্ষা করে। সব অর্থনৈতিক পদ্ধতির জন্য মূল্যবোধগুলোর অপরিহার্যতা রয়েছে। এগুলো ছাড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না অথবা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত মজবুত হয় না।
ইসলামী অর্থনীতিবিদগণের মতে শুধু বস্তুগত কল্যাণ ইসলামী অর্থনীতির উদ্দেশ্য নয়। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ সাধন করা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য। অ্যাডাম স্মিথ, রিকার্ডো ম্যালথাস অর্থনীতিতে ক্লাসিক্যাল অ্যানালিসিস করেন। তাদের অ্যানালিসিসকে অর্থনীতিতে ইতিবাচক বিশ্লেষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আলফ্রেড মার্শাল নামক আরেকজন অর্থনীতিবিদের মতে ‘সাধারণ অর্থনীতি বিজ্ঞান হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন সমস্যার বিশ্লেষণ। তার মতে মানুষের আচরণ, ব্যবহার এবং কর্মধারাই অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু। মানুষের প্রয়োজন এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মই অর্থনীতি শাস্ত্রের বিবেচ্য বিষয়।’ ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি ছিল একটি মূল্যবোধ নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ। অন্য দিকে ইসলামী অর্থনীতি মূল্যবোধভিত্তিক বিশ্লেষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। নিঃসন্দেহে ইসলামী অর্থনীতি মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ নয়। ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধ ইসলামী অর্থনীতির আসল ভিত্তি।
ড. এম উমর চাপরা, ড. এম নেয়ামাতুল্লাহ সিদ্দিকী, এম আনাস আয-যারকা প্রমুখ ইসলামী অর্থনীতিবিদ মনে করেন ‘অপর্যাপ্ত সম্পদ’ এবং ‘সীমাহীন প্রয়োজন’ এরূপ পরিস্থিতিতে মানুষের আচরণ ও প্রতিক্রিয়া কেমন হবে অথবা কেমন হওয়া উচিৎ এ সম্পর্কে আলোচনা হওয়া ইসলামী অর্থনীতির প্রতিপাদ্য বিষয়। ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ আরো মনে করেন, সম্পদ আল্লাহ তা‘আলার আমানত। সম্পদ সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে হবে এবং মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করতে হবে। ইসলামী অর্থনীতিতে মানবকল্যাণ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামী অর্থনীতি সকল প্রকার অর্থনৈতিক শোষণ ও যুলুমের অবসান ঘটিয়ে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
ইসলামী অর্থনীতি নানা বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত
এক. ইসলামী অর্থনীতি কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক: পবিত্র কুরআন মাজীদ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহর শিক্ষা ও আদর্শ দ্বারা ইসলামী অর্থনীতি ঐশ্বর্যমণ্ডিত।
দুই. ইসলামী অর্থনীতি সার্বজনীন: সব যুগের সব মানুষের অধিকার পূরণের কথা বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক কোনো নীতিমালা অকার্যকর অথবা অকল্যাণকর প্রমাণ করা যায় নি।
তিন. সাম্য: ইসলামী অর্থনীতির সাম্যবাদী রূপ সব মহলে প্রশংসার দাবিদার। এতে ধনী-গরিব, আশরাফ-আতরাফ, আরব-অনারব, শাসক-শাসিত ইত্যাদি শ্রেণির মানুষের হক, অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।
চার. মানবকল্যাণ: সর্বাধিক মুনাফা অর্জন নয় অথবা সম্পদ কুক্ষিগত করা নয়, মানবকল্যাণ নিশ্চিত করা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
পাঁচ. ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদ আমানত: সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে এবং মানবকল্যাণে নিয়োজিত করতে হবে।
ছয়. সুদের মূলোৎপাটন: ইসলামে সুদকে হারাম এবং ব্যবসাকে হালাল ঘোষণা করা হয়েছে।
সাত. সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ: ইসলাম একে নিরুৎসাহিত করে সম্পদের সুষম বণ্টনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।
আট. প্রবৃদ্ধি অর্জন: ইসলামী অর্থনীতিতে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ইসলামী অর্থনীতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাসনামলে একটি অবয়ব লাভ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিষ্ঠিত মদিনার কল্যাণ রাষ্ট্রের অর্থসংক্রান্ত প্রশাসন অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিষ্ঠিত মদিনার জনকল্যাণমূলক সেই রাষ্ট্রটিতে। মদিনার কল্যাণ রাষ্ট্রের অর্থ প্রশাসন যথেষ্ট সুসংহত ও মজবুত ছিল। ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধ মদিনা রাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থার আসল ভিত্তি ছিল। ইসলামের সূচনা লগ্নে মদিনা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে একটি মডেল হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাসনামলে পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে ইসলামী অর্থনীতি যে অবয়ব লাভ করে তার সংক্ষেপ রূপকে অথবা উল্লেখযোগ্য দিকগুলো এভাবে প্রকাশ করা যায়।
সম্পদ জীবনের উদ্দেশ্য নয়: ইসলামী অর্থনীতিতে অর্থ জীবনের জন্য অপরিহার্য হলেও তা জীবনের উদ্দেশ্য নয়। অন্য দিকে জীবনের দারিদ্র্য কাম্য নয়। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “দারিদ্র্য মানুষকে কুফুরীর দিকে নিয়ে যায়”।[1]
উপার্জন করা: ইসলামী অর্থনীতি মানুষকে উপার্জনক্ষম হওয়ার আহ্বান জানায়। ইসলাম হালাল পন্থায় উপার্জন করাকে ফরয করেছে এবং নিজ হাতের উপার্জনকে শ্রেষ্ঠ রোজগার হিসেবে উৎসাহিত করেছে।
সম্পদ ব্যবহার: ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইসলামের আহ্বান হলো মানুষ সব সম্পদকে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজের এবং অন্যের কল্যাণে নিয়োজিত করবে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে:
﴿وَٱبۡتَغِ فِيمَآ ءَاتَىٰكَ ٱللَّهُ ٱلدَّارَ ٱلۡأٓخِرَةَۖ وَلَا تَنسَ نَصِيبَكَ مِنَ ٱلدُّنۡيَا﴾ [القصص: ٧٧]
“আল্লাহ যা তোমাকে দিয়েছেন তা দ্বারা আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান করো। দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলো না।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৭৭] এর মর্মার্থ হলো বৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও ব্যয় করতে এবং আখিরাতের জন্য পুণ্য সঞ্চয় করতে বলা হয়েছে।
সুদবিহীন অর্থনীতি: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অর্থনীতির আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো সুদবিহীন অর্থনীতি। ইসলাম সুদ-ঘুষ হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম সুদকে শুধু নিষিদ্ধ করে নি, সুদের কারবারীদের প্রতি জিহাদ ঘোষণার আহ্বান জানানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে সুদের মতো সব ধরনের শোষণের উপায় উপকরণকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঘুষ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “ঘুষ গ্রহণকারী ও ঘুষদাতা উভয়ে জাহান্নামে যাবে।”
অর্থনেতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে সব প্রকার বৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। উৎপাদন, বিনিয়োগ, আয়, ব্যয়, ভোগ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে ইসলামের মৌল চেতনার প্রভাব বিদ্যমান ছিল। তৎকালে উৎপাদনের প্রতি এতই গুরুত্বারোপ করা হয় যে, জমাজমি পতিত অবস্থায় রাখতে ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। জমি পতিত অবস্থায় ফেলে রাখায় উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বিলাল ইবন হারেস আল-মুযানী থেকে তা ফেরত নিয়েছিলেন।[2] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,
«أَلَا مَنْ وَلِيَ يَتِيمًا لَهُ مَالٌ فَلْيَتَّجِرْ فِيهِ، وَلَا يَتْرُكْهُ ....»
“যে ব্যক্তি কোনো মালদার ইয়াতীমের অভিভাবক হয়েছে সে যেন তা দ্বারা ব্যবসা করে এবং তা ফেলে না রাখে।....[3]
সম্পদ পুঁজিকরণ: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পদ পুঁজীকরণ সমর্থন করতেন না। এ ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে বিত্তবানদের সম্পদে গরিব দুঃস্থদের হক রয়েছে। এ কারণে ইসলাম মনে করে সম্পদ যেন পুঞ্জীভূত না হয়ে গরিবদের মধ্যে আবর্তিত হয়। পবিত্র কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে:
﴿لِيُنفِقۡ ذُو سَعَةٖ مِّن سَعَتِهِۦۖ وَمَن قُدِرَ عَلَيۡهِ رِزۡقُهُۥ فَلۡيُنفِقۡ مِمَّآ ءَاتَىٰهُ ٱللَّهُ﴾ [الطلاق: ٧]
“বিত্তবান নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবনোপকরণ সীমিত সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করবে।” [সূরা আত-ত্বালাক, আয়াত: ৭]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তাদের জন্য সুসংবাদ, যারা সৎপথে অর্থ রোজগার করে এবং তা থেকে ব্যয় করে”।
অবৈধভাবে অন্যের মাল গ্রহণ: অন্যায়ভাবে কারোর অর্থ সম্পদ গ্রাস অথবা আত্মসাৎ করা ইসলাম সমর্থন করে না। এ জন্য ইসলামে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ أَخَذَ مِنَ الْأَرْضِ شَيْئًا بِغَيْرِ حَقِّهِ خُسِفَ بِهِ يَوْمَ القِيَامَةِ إِلَى سَبْعِ أَرَضِينَ»
“যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত জমিন গ্রহণ করেছে কিয়ামতের দিন তার সাত তবক জমিন তার ঘাড়ে শিকলরূপে পরিয়ে দেওয়া হবে”।[4]
তিনি আরো বলেন, সাবধান! কারো মাল হালাল নয় তার মনের সন্তোষ ব্যতীত।[5]
উপার্জিত সম্পদ ভোগ: উপার্জনকারী উপার্জিত সম্পদের স্বত্বাধিকারী হলেও উপার্জনকারীকে এককভাবে সম্পদ ভোগ করার নিরঙ্কুশ অধিকার দেওয়া হয় নি। ব্যক্তির উপার্জিত সম্পদ দ্বারা গরীব দুঃস্থদের সাহায্য করা, প্রতিবেশী আত্মীয়দের হক আদায় করার বিধান রয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘প্রত্যেক মুসলিমের পক্ষে দান করা ওয়াজিব।’ তিনি আরো বলেছেন: সে যেন নিজের হাতে উপার্জন করে, অতঃপর নিজেকে লাভবান করে এবং অন্যকেও দান করে।[6] অন্য একটি হাদীসের বর্ণনা এরূপ- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “যাকাত ছাড়াও নিশ্চয় তোমাদের মালে মানুষের হক রয়েছে”।[7]
খাদ্য মজুদ: দুষ্প্রাপ্যতার সময় মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে খাদ্য মজুদ ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি এহতেকার (মজুদদারী ব্যবসা) করে সে পাপী। ফকীহগণের মতানুযায়ী এহতেকারের ফলে দেশে সঙ্কট দেখা দিলে এহতেকারকারীর নিজের ও তার পরিবারের পক্ষে আবশ্যক খাদ্যশস্য রেখে বাকি শস্য বিক্রি করে দেওয়ার নির্দেশ জারি করা সরকারের কর্তব্য। ইসলামের ইসরাফ (Overuse) এবং তাবযীর (Misuse) সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি এবং মজুদকারীর (Hoarding) জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
অপব্যয় ও অপচয় না করা: অপব্যয় অথবা অপচয় করা ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামী অর্থনীতিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। হালাল ভোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অতিরিক্ত ব্যয় অথবা সীমালঙ্ঘন এবং বৈধ কাজে সীমালঙ্ঘন অথবা প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণিত একটি হাদীসের বিবরণ এরূপ «كُلُوا وَاشْرَبُوا وَالبَسُوا وَتَصَدَّقُوا، فِي غَيْرِ إِسْرَافٍ وَلاَ مَخِيلَةٍ» “যা ইচ্ছা খেতে পারো এবং যা ইচ্ছা পরিধান করতে পারো যদি না তোমাকে স্পর্শ করে অপব্যয় ও গর্ব”।[8]
বিশ্বের তিনটি অন্যতম অর্থব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা করা হলে দেখা যায় পুঁজিবাদ শোষণের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনকে উৎসাহিত করে। সমাজতন্ত্র যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চরমভাবে উপেক্ষিত। তবে পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্রে কোনোটির ক্ষেত্রেই নৈতিক মূল্যবোধের গুরুত্ব প্রদান করা হয় নি। প্রখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের একটি মূল্যবান মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি তার মন্তব্যে বলেন,
I dislike communism because it is undemocratic and capitalism because it favors exploitation.
অর্থাৎ আমি সমাজতন্ত্র পছন্দ করি না; কেননা তা অগণতান্ত্রিক এবং আমি পুঁজিবাদকেও পছন্দ করি না; কেনন তা শোষণকে প্রশ্রয় দেয়।
সমকালীন বিশ্ব একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। ইসলাম New Economic order হিসেবে শোষিত বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর প্রাণের দাবিকে পূরণ করতে পারে। কেননা ইসলামী অর্থনীতি মূল্যবোধনির্ভর একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা নৈতিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং যে ব্যবস্থায় মানবকল্যাণের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
ইসলামী অর্থনীতি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষায় ভরপুর। একে যুগের পরিভাষায় বিশ্লিষ্ট আকারে তুলো ধরার ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইসলামের মৌল দর্শন ও শিক্ষার আলোকে ইসলামী অর্থনীতির সফল বাস্তবায়নের জন্য ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, ইসলামী চিন্তাবিদ, ইসলামী অর্থনীতিবিদ এবং উলামায়ে কিরামের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমিন!
সমাপ্ত