×
আল্লাহর জন্যে ভালোবাসা : আল্লাহর জন্যে ভালোবাসা ইসলামের যাবতীয় কর্মের চালিকাশক্তি—নি:সন্দেহে বলা যায়। তবে, আমাদের এ ভূমিতে এ ব্যাপারটিকে কেন্দ্র করে এক ধরণের ভন্ডামী প্রচলিত আছে, যা সমাজকে শেষ করে দিচ্ছে অঙ্কুরেই। আল্লাহর জন্যে ভালোবাসার একটি পরিশ্রুত ব্যাখ্যা হতে পারে নিবন্ধটি।

    আল্লাহর জন্য ভালোবাসা

    الحب في الله

    ترجمة : نعمان بن ابو البشر

    مراجعة : عبد الله شهيد عبدالرحمن


    আল্লাহর জন্য ভালোবাসা

    “আল্লাহর জন্য ভালোবাসা” সম্পর্কে জাহেলী যুগে মানুষের কোন ধারণা ছিল না। স্বাদেশিকতা বংশ সম্পর্ক বা অনুরূপ কিছু ছিল তাদের পরস্পর সম্পর্কের মূল ভিত্তি। আল্লাহর বিশেষ দয়ায় ইসলামের আলো উদ্ভাসিত হল। পরস্পর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় উৎকর্ষতা আসল। ধর্মীয় সম্পর্ক সর্বোচ্চ ও সুমহান সম্পর্ক হিসেবে রূপ লাভ করল। এ-সম্পর্কের উপরেই প্রতিদান, পুরস্কার, ভালোবাসা ও ঘৃণা সাব্যস্ত হল। ইসলামের বিকাশের সাথে সাথে ইসলামি ভ্রাতৃত্ব ও আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ইত্যাদি পরিভাষা চালু হল।

    আল্লাহর জন্য ভালোবাসা-এর অর্থ হচ্ছে, এক মুসলিম ভাই অপর মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণ ও আল্লাহর আনুগত্য কামনা করা। সম্পদের মোহ, বংশ বা স্থান ইত্যাদির কোন সংশ্লিষ্টতা এক অপরের সম্পর্কের ও ভালোবাসার মানদণ্ড হবে না।

    আল্লাহর জন্য ভালোবাসার কতিপয় ফজিলত :

    ১. আল্লাহর জন্য ভালোবাসা স্থাপনকারীদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন :-আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন -

    عن أبي هريرة عن النبي صلى الله عليه وسلم أن رجلا زار أخا له في قرية أخرى، فأرصد الله له على مدرجته ملكا، فلما أتى عليه قال أين تريد؟ قال: أريد أخا لي في هذه القرية، قال:هل لك عليه من نعمة تربها ؟ قال:لا، غير أني أحببته في الله عز وجل، قال:فإني رسول الله إليك أن الله قد أحبك كما أحببته فيه . (رواه مسلم:4656)

    এক ব্যক্তি অন্য গ্রামে বসবাসকারী নিজ ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হল। মহান আল্লাহ তার জন্য পথে একজন ফেরেশতা মোতায়েন করে রাখলেন। যখন সে ফেরেশতা সে ব্যক্তির নিকটবর্তী হল, বলল তুমি কোথায় যাও ? সে বলল, এই গ্রামে বসবাসকারী আমার এক ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করা আমার উদ্দেশ্য। ফেরেশতা বলল, তার কাছে তোমার কোন পাওনা আছে কি-না ? সে বলল, না। কিন্তু আমি তাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। তখন ফেরেশতা বলে উঠল, নিশ্চয় আমি তোমার নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত দূত। মহান আল্লাহ অবশ্যই তোমাকে ভালোবেসেছেন যে রকম তুমি তাকে আল্লাহর জন্য ভালোবেসেছ। (সহীহ মুসলিম:৪৬৫৬) হাদিসে কুদসীতে আছে মহান আল্লাহ বলেন :—

    وجبت محبتي للمحتابين فيّ ، والمتجالسين فيّ، والمتزاورين فيّ، والمتباذلين فيّ ( رواه أحمد:21717)

    আমার জন্য পরস্পর ভালোবাসা স্থাপনকারী, পরস্পর উঠা-বসা-কারী, পরস্পর সাক্ষাৎকারী, পরস্পর ব্যয়কারীদের জন্য আমার ভালোবাসা অবধারিত। (আহমদ:২১৭১৭)

    ২. মহান আল্লাহর জন্য পরস্পর ভালোবাসা স্থাপনকারী আল্লাহর আরশের ছায়াতলে অবস্থান করবে, যে দিন তাঁর আরশের ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :-

    سبعة يظلهم الله في ظله يوم لا ظل إلا ظله ....... ورجلان تحابا في الله ، اجتمعا عليه ، وتفرقا عليه. (رواه البخاري:620)

    “সাত ব্যক্তি, আল্লাহ তাদেরকে তাঁর ছায়াতলে ছায়া দিবে, যে দিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না...এবং দুজন ব্যক্তিকে, যারা আল্লাহর জন্য তারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা স্থাপন করেছে, তাঁর ভালোবাসায় তারা একত্রিত হয়েছে, এবং তাঁর ভালোবাসায় তারা পৃথক হয়েছে‌। (বুখারী:৬২০) রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন :—

    إن الله يقول يوم القيامة: أين المتحابون بجلالي، اليوم أظلهم في ظلي يوم لا ظل إلا ظلي. ( رواه مسلم:4655)

    আল্লাহ কিয়ামত দিবসে বলবেন, আমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পরস্পর ভালোবাসা স্থাপনকারীরা কোথায় ? আজ - যে দিন আমার ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না- আমি তাদের ছায়া দেব। (সহীহ মুসলিম:৪৬৫৫)

    ৩. আল্লাহর জন্য ভালোবাসা জান্নাতে প্রবেশের বিশেষ মাধ্যম: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :-

    لاتدخلون الجنة حتى تؤمنوا، ولاتؤمنوا حتى تحابوا.... ( رواه مسلم:81

    “ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। পরস্পর ভালোবাসা স্থাপন না করা পর্যন্ত তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না। (সহীহ মুসলিম:৮১)

    এক সাথি আরেক সাথির উপর প্রভাব বিস্তার করে বিধায় প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে সাথি গ্রহণের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করা। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন :—

    الرجل على دين خليله، فلينظر أحدكم من يخالل... (رواه الترمذي:2300)

    মানুষ তার বন্ধুর রীতি-নীতির উপর পরিচালিত হয়, সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকের উচিত, কে তোমাদের বন্ধু হবে এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা। (তিরমিজি:২৩০০)

    ভাল সাথির বেশ কিছু গুণাবলি

    • দীনদার ও তাকওয়াবান হওয়া : তাকওয়াবানের কিছু আলামত নিচে উল্লেখ করা হল।

    • আল্লাহ প্রদত্ত অকাট্য বিধি-বিধান পালনে যত্নবান হওয়া। যেমন সালাত কায়েম, জাকাত প্রদান-ইত্যাদি।

    • গালিগালাজ, অভিশাপ, গীবত ইত্যাদি। থেকে নিজের জিহ্বাকে পরিচ্ছন্ন রাখা।

    • নিজ সাথিকে ভাল উপদেশ দেওয়া।

    • সজনদেরকে ভালোবাসা।

    • অশ্লীলতা ও পংকিলতা থেকে দূরে থাকা।

    • ভাল কাজে সহযোগিতা প্রদান, পাপের কাজে নিরুৎসাহিত করা।

    আল্লাহ তাআলা বলেন :—

    الأخلاء يومئذ بعضهم لبعض عدو إلا المتقين.الزخرف:

    “বন্ধুরা সেই দিন হয়ে পড়বে একে অপরের শক্র, মুত্তাকীরা ব্যতীত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন :—

    لا تصاحب إلا مؤمنا، ولا يأكل طعامك إلا تقي. (رواه الترمذي:3218)

    “ঈমানদার ব্যতীত সাথি গ্রহণ করো না, মুত্তাকী ব্যতীত কেহ যেন তোমার খাবার ভক্ষণ না করে। (তিরমিজি:৩২১৮)

    ২. বুদ্ধিমান হওয়া : নির্বোধকে সাথি হিসেবে গ্রহণে কোন কল্যাণ নেই। কেননা সেই লাভ করতে গিয়ে ক্ষতি করে বসবে।

    ৩. সুন্দর চরিত্রবান হওয়া: কেননা দুশ্চরিত্রবান সাথির অশুভ কর্মে তুমি আক্রান্ত হয়ে পড়বে, কষ্টে নিপতিত হবে।

    ৪. সুন্নত মোতাবেক চলা : সাথি বিদআতী হলে তোমাকে বিদআতের দিকে নিয়ে যাবে, তোমার চিন্তা চেতনাকে কলুষিত করবে,

    ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের আদবসমুহ :

    ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু আদব রয়েছে যা মেনে চললেই আল্লাহর জন্য ভালোবাসার দাবি যথার্থ প্রমাণিত হবে। নীচে কতিপয় আদব উল্লেখ করা হল।

    • সালাম প্রদান ও হাসি-মুখে সাক্ষাৎ করা: রাসূলুল্লাহ সা: বলেন :-

    لاتحقرن من المعروف شيئا، ولو أن تلقى أخاك بوجه طلق. رواه مسلم:4760

    কোন ভাল কাজকে কখনো তুচ্ছ জ্ঞান করনা, এমনকি তা যদিতোমার ভাইয়ের সাথে হাসোজ্জ্বল চেহারায় সাক্ষাৎ করা ও হয়। (সহীহ মুসলিম:৪৭৬০)

    • উপঢৌকন প্রদান: ভালোবাসা বৃদ্ধি ও মনোমালিন্য দূরীকরণে এর রয়েছে বিরাট প্রভাব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

    تهادوا تحابوا ( موطأ مالك:1413)

    তোমরা একে অপরকে উপহার প্রদান কর, তোমাদের পরস্পর ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। (মুয়াত্তা:১৪১৩)

    • এক ভাই অপর ভাইয়ের জন্য দুআ করা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :-

    ما من عبد مسلم يدعو لأخيه بظهرالغيب، إلا قال الملك: ولك بمثل (رواه مسلم:4912)

    কোন মুসলিম বান্দা যখন তার ভাইয়ের পিছনে তার জন্য দুআ করে তখন ফেরেশতা বলে উঠে তোমার জন্য ও অনুরূপ।(সহীহ মুসলিম:৪৯১২)

    আর ইহা তার সারা জীবন এমনকি মৃত্যুর পরে ও অব্যাহত থাকবে।

    • অপর ভাইয়ের নিকট ভালোবাসার কথা প্রকাশ করা: রাসূলুল্লাহ সা: বলেন :—

    إذا أحب الرجل أخاه، فليخبره أنه يحبه. رواه أبوداود:4459

    মানুষ যখন তার ভাইকে ভালোবাসে সে যেন তাকে অবহিত করে যে, সে তাকে ভালোবাসে।” এবং তাকে বলবে:

     إني أحبك في الله

    নিশ্চয় আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। জওয়াবে সে বলবে:

     أحبك الذي أحببتني له

    যে ব্যাপারে তুমি আমাকে ভালোবেসেছ সেটা তোমার নিকট পছন্দ হয়েছে। (আবুদাউদ:৪৪৫৯)

    • দেখা-সাক্ষাতের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা: যাতে কমও না হয় আবার বেশিও না হয় কম হলে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে, বেশি হলে বিরক্ত হয়ে পড়বে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :-

    زر غباً تزدد حباً

    “বিরতি দিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ কর, ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। কবি বলেন :

    زرغباً تزدد حباً فمن أكثر التكرار أقصاه الملل

    বিরতি দিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ কর, ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে, যে বার বার দেখা-সাক্ষাৎ করে অস্বস্তিবোধ তাকে দূরে সরিয়ে দিবে।

    • সাহায্য করা ও প্রয়োজন মেটানো: ইহা তিন পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়।

    ১- সর্বোচ্চ পর্যায়: নিজের প্রয়োজনের উপর অপর ভাইয়ের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

    ২- মধ্যপর্যায়: আবেদন ছাড়া অপর ভাইয়ের এমন প্রয়োজন মেটানো যা নিজের প্রয়োজনের সাথে সাংঘর্ষিক হয় না।

    ৩- নিম্ন পর্যায়: আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অপর ভাইয়ের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া।

    • অপর ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখা, তার গোপনীয় বিষয় প্রকাশ না করা, উত্তম পন্থায় তাকে উপদেশ দেয়া, তার ইজ্জত-আব্রু সংরক্ষণ করা, ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা, তার সাথে সুন্দর আচরণ করা।

    সমাপ্ত