×
এ প্রবন্ধে মাক্কা-মুকাররামা লাইব্রেরীর পরিচিতি, সেটার বাস্তবচিত্র, সেটা যিয়ারত করার বিধান এবং সেখানে হাজীগণ যেসব ভুল করে থাকেন তার বর্ণনা রয়েছে।

    মক্কা লাইব্রেরি

    مكتبة مكة المكرمة

    < بنغالي- Bengal - বাঙালি>

    একদল বিজ্ঞ আলেম

    جماعة من العلماء

    —™

    অনুবাদক: মুহাম্মাদ আব্দুর রব আফ্ফান

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    ترجمة: محمد عبد الرب عفان

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    মক্কা লাইব্রেরি

    প্রথমত: পরিচয়

    সাফা-মারওয়া সা‘ঈর স্থান থেকে পূর্ব পার্শ্বে এই লাইব্রেরি শি‘আবে আবু তালিবের সূচনায় অবস্থিত। লাইব্রেরিটি ১৩৭০ হিজরী মোতাবেক ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে শাইখ আব্বাস কাত্তান নির্মাণ করেন। এখানকার ধর্মমন্ত্রণালয় এর তত্ত্বাবধান করে।

    এতে রয়েছে বহু মূল্যবান গ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি ও ঐতিহাসিক অমূল্য ভাণ্ডার। লাইব্রেরিটি বর্তমানেও দু’তলা বিশিষ্ট কাষ্ঠ গ্রিলযুক্ত ঐতিহ্যবাহী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।[1]

    দ্বিতীয়ত: লাইব্রেরির হাকীকত বা রহস্য:

    কোনো কোনো লেখক উল্লেখ করেন যে, লাইব্রেরির স্থানটি হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই ঘর; যাতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন; যা আকীল ইবন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করেন তখন তিনি তা গ্রহণ করেন এবং তার ও তার বংশধরের হাতেই মুহাম্মাদ ইবন ইউসুফ আস-সাকাফী (হাজ্জাজের ভাই) তা ক্রয় করা পর্যন্ত থেকে যায়। অতঃপর তিনি তা তার সেই বাড়ীর অন্তর্ভুক্ত করেন যা ‘দারুল বায়দ্বা’ নাম পরিচিত ছিল। হারুনুর রশীদের মাতা আল-খাইযুরান যখন ৭১ হিজরীতে হজ করেন, তখন তিনি সেটিকে মসজিদ বানিয়ে দেন; যাতে সালাত আদায় করা হত।[2]

    প্রকৃতপক্ষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের স্থানের নির্দিষ্টতার ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো সহীহ দলীল নেই, এজন্য আলেম ও ঐতিহাসিকগণ তার জন্মস্থানের নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে মতভেদ করেছেন।[3]

    পর্যটক আবু সালেম আল আইয়্যামী (মৃত: ১০৯০ হিজরী) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মস্থানের বিশুদ্ধতা অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন ও এক্ষেত্রে আলিমদের মতভেদ উল্লেখ করে মানুষের মাঝে যে উক্তিটি প্রসিদ্ধ তার পর্যালোচনা করেন এবং বলেন, ‘আশ্চর্যের বিষয় হলো’ দার-গৃহের শয়ন কক্ষ পরিমাণকে তারা নির্ধারণ করে বলেন, “এটি হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মস্থান। আমার নিকট কোনো সহীহ ও দুর্বল সূত্রে এর নির্দিষ্টতা প্রমাণ হওয়া তো বড় দূরের কথা হিসেবে বিবেচিত। কেননা ইতোপূর্বে যে সব মতভেদের কথা উল্লেখ হয়েছে, তা মক্কা বা অন্য কোথায়। একমত অনুযায়ী তার জন্মস্থান সেখানে, তবে সেখানের কোন অংশে? অন্য মতানুযায়ী এই শে‘আব-ঘাটিতে, তবে কোন গৃহে? ... বস্তুত গৃহের নির্দিষ্ট স্থানের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত; কেননা এর মধ্যে অতিবাহিত হয়ে গেছে বহুকাল ও যামানা এবং চিহ্ন ও আলামতও বিচ্ছিন্ন ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।”

    অতঃপর তিনি (রহ.) বলেন: জন্মস্থান নির্ধারিত হওয়ার বিশুদ্ধতা একেবারেই অসম্ভব: “কেননা জন্ম সংঘটিত হয় জাহেলী যুগে। এমন কেউ তখন ছিল না, যে স্থানগুলো সংরক্ষণ করে রাখবে। বিশেষ করে তাদের এ ব্যাপারে কোনো লক্ষ্য বা চিন্তাও ছিল না। পক্ষান্তরে ইসলামের আগমনের পর, সাহাবী ও তাবে‘ঈদের অবস্থা অবলোকন করে বুঝা যায় যে, শরী‘আত যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয় না, তেমন স্থানের ব্যাপারে তাঁদেরও কোনো গুরুত্ব ছিল না। কেননা এতে করে যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তা থেকে বিমূখতার ভয় করতেন তারা এবং শরী‘আতকেই তারা হাতিয়ার ও যবান দ্বারা হিফাযত করতেন।[4]

    আধুনিক যুগের বিখ্যাত ঐতিহাসিক হামাদ আল-জাসের বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন স্থানে জন্মগ্রহণ করেছেন এ মতভেদ থাকা সত্বেও; ঐ মতের নিশ্চয়তা যা জনসাধারণের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মস্থান নামে পরিচিত, তা কোনো ঐতিহাসিক সঠিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়।”[5]

    জন্মস্থানের নির্দিষ্টতায় উলামা ও ঐতিহাসিকগণের মতভেদ হওয়া দ্বারা নিঃসন্দেহে এটা প্রমাণিত হয় যে, সে বিষয়ে সম্মানিত সাহাবীগণের কোনো গুরুত্ব ছিল না। কেননা তার সাথে শরী‘আতের আমলের কোনো সম্পর্ক নেই। নতুবা অবশ্যই কোনো স্থানের ব্যাপারে তাদের ঐক্যমত বর্ণনা হত যদি তা নির্ধারিত ও প্রসিদ্ধ থাকত। যেমন, হজের নিদর্শনাবলী সর্বজনবিদিত ও সর্বজ্ঞাত।

    তৃতীয়ত: লাইব্রেরি যিয়ারত ও তা থেকে বরকত নেওয়া কি শরী‘আতসম্মত?

    ইবাদত ও সাওয়াবের জন্য উক্ত লাইব্রেরি যিয়ারত করা বৈধ নয়। কেননা এ ব্যাপারে কোনো দলীল আসে নি। প্রথমত: ইবাদতের সূত্র হলো, দলীল না থাকলে বিরত থাকা এবং দ্বিতীয়ত: ইতোপূর্বে যা বর্ণনা করা হয়েছে তার ভিত্তিতে বুঝা যায় তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জন্মস্থানকে নির্ধারণ করা বিশুদ্ধ নয়।

    তর্কের খাতিরে যদি তার বিশুদ্ধতা ধরে নেওয়া যায় তবুও সেখান থেকে কোনোভাবেই বরকত গ্রহণ করা জায়েয নয়। কেননা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে সকল স্থানে বসেছেন, সালাত আদায় করেছেন ইত্যাদি, যে স্থানগত নিদর্শন বা চিহ্ন রয়েছে, তন্মধ্যে জন্মস্থানও একটি। এসব ক্ষেত্রে বরকত গ্রহণের বৈধতার কোনো দলীল নেই।

    পক্ষান্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মস্থানের সম্মান ও তা দ্বারা বরকত গ্রহণের বৈধতার দলীল গ্রহণ করা ঐ হাদীস থেকে, যাতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, জিবরীল আলাইহিস সালাম মি‘রাজের রাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাইতে লাহামে (যেখানে ঈসা আলাইহিস সালাম জন্মগ্রহণ করেন সেখানে) দু’রাকাত সালাত আদায়ের হুকুম দেন। নিম্নের বিষয়গুলো দ্বারা তার উত্তর দেওয়া যায়:

    ১। হাদীস শাস্ত্রবিদ ও অন্যান্যরা এ বর্ণনাটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেন যে, এটি অগ্রহণযোগ্য ও জাল। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাব্যস্ত নেই যে, তিনি বাইতে লাহামে সালাত আদায় করেছেন।

    শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ রহ. বলেন: সহীহ হাদীসে সাব্যস্ত হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন, মি‘রাজের রাতে বায়তুল মুকাদ্দাস আগমন করেন, তখন তিনি তাতে দু’রাকাত সালাত আদায় করেন। কিন্তু তা ব্যতীত কোনো স্থানে সালাত আদায় করেন নি, না সেখানে যিয়ারত করেছেন। আর মি‘রাজের হাদীসের ব্যাপারে বলা যায় তার মধ্যে কিছু রয়েছে সহীহ এবং যা কিছু সুনান ও মুসনাদ কিতাবসমূহে রয়েছে, তার কিছু আছে বানোয়াট-জাল। যেমন, কেউ কারো থেকে বর্ণনা করে থাকে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেন, এটি হলো আপনার পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কবর, অবতরণ করুন ও তাতে সালাত আদায় করুন। এটি হল বাইতে লাহাম, আপনার ভাই ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মস্থান, অবতরণ করুন ও সেখানে সালাত আদায় করুন। এমনই অনেক কিছু, যা আলেমগণের ঐকমত্যে বানানো। এভাবে মিথ্যার প্রচলন হয়েছে।... এরপর ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) বলেন: বাইতে লাহাম হলো খ্রিস্টানদের একটি গির্জা, তাতে আগমন করা মুসলিমদের নিকট কোনো ফযীলতের কাজ নয়। চাই তা ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মস্থান হোক বা না হোক।[6]

    ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, কথিত রয়েছে যে, তিনি অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকি বায়তে লাহামে অবতরণ করেছেন ও সেখানে সালাত আদায় করেছেন অথচ কখনও তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম থেকে সুসাব্যস্ত নেই।[7]

    ২। যদি প্রমাণও থাকে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজের রাতে বায়তে লাহামে সালাত আদায় করেছেন, তাহলেও এর অর্থ এটা নয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে জন্মগ্রহণ করেছেন সেখানে বরকত গ্রহণ ও নেকীর আশায় সালাতের বৈধতা প্রমাণিত হবে; কেননা ইবাদতের ক্ষেত্রে কোনো কিয়াস দুরস্ত হবে না; যেহেতু ইবাদত হলো ‘তাওক্বীফী’ তথা দলীল নির্ধারিত বা দলীলের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

    ধরে নেওয়া যাক, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে বায়তে লাহামের সম্মান প্রদর্শন করতে হুকুম দেন নি বা সেখানে সালাত আদায় করতে বলেননি; কিন্তু কোনো সাহাবীও তো বায়তে লাহামের সম্মান ও সেখানে সালাত আদায় করেন নি।[8]

    অতএব, এরই ভিত্তিতে বলা যায় এখানে আগমনে মুসলিমদের নিকট কোনো ফযীলত নেই। অনুরূপ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম স্থানেরও কোনো ফযীলত নেই। আল্লাহই অধিক জ্ঞাত।[9]

    চতুর্থত: কোনো কোনো হাজী সেখানে যে সব বিদ‘আত ও সুন্নাত পরিপন্থী বিষয়ে পতিত হয়:

    কতিপয় হাজী মক্কা মুকাররমা লাইব্রেরিতে বিভিন্নভাবে বিদ‘আত সুন্নাত পরিপন্থী কর্মে লিপ্ত হয়ে থাকে। কেননা তারা সে স্থানের পবিত্রতা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের বিশ্বাসী। যার ভ্রান্ততা ইতোপূর্বে উল্লেখও হয়েছে যেন হাজীগণ সে সব বিদ‘আত থেকে নিজেদের হেফাযত করেন। নিম্নে তার কিছু অংশের প্রতি ইঙ্গিত করলাম:

    ১। লাইব্রেরিটি ইবাদত-সাওয়াবের নিয়তে যিয়ারত ও তাঁর পবিত্রতা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে বলে বিশ্বাস করা।

    ২। সেখানে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট দো‘আ করা এবং তার থেকে প্রয়োজন পূরণ কামনা করা।।

    ৩। তার চারিপার্শ্বে ত্বাওয়াফ করা।

    ৪। তার দিকে ফিরে সালাত আদায় করা।

    ৫। সেখানে বেশি বেশি দো‘আ করা ও তিলাওয়াত করা।

    ৬। তার দেওয়াল ও ধুলা-বালি দ্বারা বরকত গ্রহণ করা।

    ৭। তার উপর লেখা-লেখি করা।

    ৮। তার দরজা ও দেওয়ালে আতর মাখান।

    ৯। তার সাথে কোনো চিহ্ন যেমন, কাগজ, ম্যাসেজ ও চুল স্থাপন করা।

    [1] উমার রফী’ রচিত ‘‘কিতাব মক্কা’’: পৃষ্ঠা-১২৫

    [2] আল-ফাসির শেফাউল গারাম বি আখবারিল বালাদিল হারাম: ১/২৬৯ প্রভৃতি গ্রন্থ।

    [3] শেফাউল গারাম: ১/২৬৯ ইত্যাদি।

    [4] রেহলাতু ‘আইয়্যাশিয়াহ: ১/২২৫

    [5] আসার ইসলামী, মাজাল্লাতুল আরাব: ৩ ও ৪ খন্ড, রমযান ১৪০২ হিজরী।

    [6] ইকতিদ্বাউ সিরাতিম মুস্তাকীম: ২/৮১৪।

    [7] যাদুল মা‘আদ: ৩/৩৪।

    [8] হামূদ আত-তুওয়াইজারী, আর রদ্দুল কাভী ‘আলার রিফা‘ঈ: পৃষ্ঠা ৮৮ ও ইকতিদ্বাউস সিরাত: ২/৮১৩।

    [9] বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন ড. নাসের আল-জুদা‘ই রচিত কিতাব ‘আত-তাবাররুক’ পৃষ্ঠা-৩৫৫।