×
বর্তমান যুগে রাষ্ট্রের মধ্যে এ প্রথা চালু হয়েছে যে, কোনো রাজা-বাদশাহ বা রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যু হলে ৩ দিন বা তাঁর চেয়েও কম অথবা এর চেয়েও বেশি দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অফিস-আদালত বন্ধ করা এবং পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। উক্ত ফতোয়ায় রাষ্ট্রীয় শোক পালনের শর‘ঈ বিধান কী? তা আলোচনা করা হয়েছে।

    রাজা-বাদশাহ ও রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য রাষ্ট্রীয় শোক পালনের শর'ঈ বিধান

    حكم الحداد على الميت من الملوك والزعماء

    < বাংলা - بنغالي - Bengali >

    শাইখ আব্দুল আযীয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন বায

    الشيخ عبد العزيز بن عبد الله بن باز

    —™

    অনুবাদক: এ কিউ এম মাসূম মজুমদার

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    ترجمة: أقيوم معصوم مجموعه دار

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    রাজা-বাদশাহ ও রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য রাষ্ট্রীয় শোক পালনের শর'ঈ বিধান

    আল-হামদুলিল্লাহ (সকল প্রশংসাই মহান আল্লাহর জন্য) আর সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর সঙ্গী-সাথীসহ যারা তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেছে তাদের প্রতি। অতঃপর,

    বর্তমান যুগে ইসলামী বহু রাষ্ট্রের মধ্যে এ প্রথা চালু হয়েছে যে, কোনো রাজা-বাদশাহ বা রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যু হলে ৩ দিন, বা তাঁর চাইতেও কম অথবা এর চাইতেও বেশি দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অফিস আদালত বন্ধ করা এবং পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ কাজটি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরী'আত বিরোধী কাজ। এ ছাড়াও কাজটি ইসলামের শত্রুদের অনুকরণ ও অনুসরণও বটে।

    এ ব্যাপারে রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বহু সহীহ হাদীস এসেছে, যে সমস্ত হাদীসে এ জাতীয় শোক পালন নিষেধ করা হয়েছে এবং এমন কাজ থেকে তাঁর যেন বিরত থাকে, এ ব্যাপারে উম্মাতকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। তবে, স্ত্রী তাঁর স্বামীর জন্য ৪ মাস ১০ দিন শোকপালন করবে। এ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নারীদের জন্য আরেকটি বিশেষ অনুমতি রয়েছে যে, তারা তাদের নিকট আত্মীয়ের কারো মৃত্যু হলে তাঁর জন্য ৩ দিন বা এর চাইতে কম সময় শোক পালন করতে পারবে। এ ছাড়া অন্য কোনো প্রকার শোক পালন আমাদের ইসলামী শরী'আতে নিষিদ্ধ।

    আমাদের এ শরী'আত তথা মানুষের জন্য মহান আল্লাহর দেওয়া পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থায় কোনো বাদশাহ বা রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান বা অন্য কারো জন্য কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় শোক জায়েয হওয়ার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় তাঁর ছেলে ইবরাহীম এবং ৩ মেয়ে এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ মারা যান, তাদের জন্য তো তিনি শোক দিবস পালনের ঘোষণা দেন নি। আর তাঁর সময়েই মুতার যুদ্ধের বীর সেনাপতিগণ যেমন, যাইদ ইবন হারেসা, জা'ফর ইবন আবু তালেব, আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু 'আনহুম শহীদ হয়েছিলেন, তিনি তাদের জন্যে কোনো প্রকারের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষনা দেন নি। এরপর রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম –যিনি মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং আদম সন্তানদের মধ্যে তিনি সর্বজন সম্মানিত ব্যক্তি -দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন, তাঁর মৃত্যু ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বড় মসিবত, এরপরও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু 'আনহুম তাঁর জন্য কোনো প্রকার শোক দিবস পালন করেন নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পরে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবী এবং রাসূলের পরে যিনি মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু 'আনহু মারা গেলেন, তার জন্যও কোনো প্রকারের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করা হয় নি। এরপর উমার, উসমান এবং আলী রা. রাদিয়াল্লাহু 'আনহুম শহীদ হলেন। তারা সবাই রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর রাদিয়াল্লাহু 'আনহু এরপরে মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, তাদের জন্যেও কোনো রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করা হয় নি। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ দুনিয়া থেকে চলে গেলেন অথচ তাদের উত্তরসূরী তাবেঈ'গণ তাদের জন্য কোনো প্রকারের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করেন নি। অতঃপর মারা গেলেন বিভিন্ন তাবেঈ'গণ এবং তাদের পরে যারা এসেছিলেন তাদের মধ্যে থেকে যারা ইসলামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং মানুষের হিদায়াতের ইমাম ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যেব, 'আলী ইবনুল হুসাইন (যাইনুল 'আবেদীন) আর তার পুত্র মুহাম্মদ ইবন 'আলী, উমার ইবন আব্দুল আযীয, আয-যুহরী, ইমাম আবু হানিফা ও তার দুই ছাত্র, ইমাম মালেক ইবন আনাস, আল-আওযা'য়ী, আস-সাওরী, ইমাম আশ-শাফেঈ', ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহিসহ অসংখ্য সুবিখ্যাত ও হিদায়াতের ইমামগণের মৃত্যুতে মুসলিমগণ কোথাও কোনো প্রকার রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করেন নি। যদি এ কাজটি আমাদের জন্য কল্যাণকর বা সাওয়াবের হতো, তাহলে আমাদের পূর্ববর্তী নেককারগণ সবার আগে পালন করতেন। জেনে রাখুন, তাদের পথে চললেই রয়েছে আমাদের জন্য কল্যাণ আর তাদের বিরোধীতায়ই রয়েছে যাবতীয় অকল্যাণ ও অনিষ্ট। ইতোপূর্বে বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আমাদের পূর্ববতী নেককার উত্তরসূরীরা (সালফে সালেহীন) শুধু নির্দিষ্ট দিনগুলোতে স্বামীর জন্য স্ত্রীর শোক পালন ব্যতীত অন্য কারো জন্য কোনো প্রকার শোক দিবস পালন না করা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাদের এ কাজটি ঠিক এবং যথার্থ।

    আজকাল মানুষ বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ এবং রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যুতে যে রাস্ট্রীয় শোক দিবস পালন করে থাকে, যার ফলশ্রুতিতে মানুষের কাজকর্ম বন্ধ রাখা হয় এবং মানুষ অন্যান্য বহুবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তাছাড়াও এমন কাজটি করা দ্বারা কাফিরদের অনুকরণ ও অনূসরণ করা হয়। অতএব, তাদের এ কাজটি ইসলামী শরী'আত বিরোধী কাজ।

    আর এ আলোচনা দ্বারা জানা গেল যে, রাষ্ট্রপ্রধান ও মুসলিম নেতাদের ওপর ওয়াজিব (অবশ্য কর্তব্য) হলো এ জাতীয় মৃত্যু শোক দিবস পালন না করে পূর্ববতী নেককার উত্তরসূরী (সালফে সালেহীন) সাহাবী ও তাদের অনুসারীদের পদ্ধতি ও পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলা।

    'আলেমদের ওপর ওয়াজিব হলো, এ জাতীয় শোক দিবস পালনের ব্যাপারে তারা মানুষকে সাবধান করে দিবেন এবং জানিয়ে দিবেন। ওয়াজিব নসিহত হিসেবে এবং নেককাজ ও তাকওয়ার (আল্লাহ-ভীতির) কাজে তাদেরকে সহযোগিতার অংশ হিসেবে। যেহেতু, আল্লাহ তা'আলা জন্য ও তাঁর কিতাবের জন্য এবং তাঁর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যে এবং মুসলিম ইমামদের জন্য এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য নসীহত করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। তাই এই সংক্ষিপ্ত কিছু কথা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করলাম।

    আল্লাহ তা'আলার নিকট চাই যে, তিনি যেন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান ও ইসলামের নেতা এবং সর্বসাধারণদেরকে তাঁর সন্তুষ্টি ও রেযামন্দি অনুযায়ী 'আমল করার, তাঁর শরী'আতকে শক্তভাবে আকড়ে ধরার এবং শরীআত বিরোধী কোনো কাজ থেকে সতর্ক থাকার তাওফিক দান করেন আর আমাদের সকলের অন্তরকে ও যাবতীয় কাজকে সংশোধন করে দেন। তিনি তো আমাদের দো'আ শুনেন এবং দ্রুত কবুল করেন।

    পরিশেষে, আল্লাহ তা'আলার সালাত ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পরিবারবর্গ এবং তাঁর সাহাবীদের ওপর।