×
এ আলোচনায় পবিত্র মদীনা মুনাওওয়ারার নাম, ফযিলত ও এখানে অবস্থানের আদবসমূহ সম্পর্কে আল-কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে।

 পবিত্র মদীনা মুনাওওয়ারার নাম, ফযিলত ও এখানে অবস্থানের আদবসমূহ

المدينة المنورة : أسماؤها وفضلها وآداب الإقامة بها

  

 পবিত্র মদীনা মুনাওওয়ারার নাম, ফযিলত ও এখানে অবস্থানের আদবসমূহ

  

 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

পবিত্র মদীনা মুনাওওয়ারাকে বলা হয় দ্বিতীয় হারাম। মুসলিম হৃদয়ে এ নগরীটির প্রতি রয়েছে অপরিসীম শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও মর্যাদা। কেননা এটি ছিল প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতভূমি। তিনি তাঁর জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শেষ দশ বছর এ নগরীতেই কাটিয়েছেন। অহীর বৃহত্তর অংশ এখানেই তাঁর উপর অবতীর্ণ হয়। এ নগরীকে কেন্দ্র করেই তিনি আল্লাহর সাহায্যে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বস্তুত আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নগরীকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করে অনেক ফযিলত, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে একে অভিষিক্ত করেছেন।

 পবিত্র মদীনা মুনাওওয়ারার নাম

মদীনাকে অনেকগুলো নামে অভিহিত করা হয়েছে, যা তার ফযিলত ও মর্যাদার প্রমাণ বহন করছে। কেননা একই জিনিসের অনেক নাম সে জিনিসের মর্যাদা ও গুরুত্বের প্রমাণবাহী। ঐতিহাসিকগণ এ নগরীর বহু নাম উল্লেখ করেছেন। ‘আল্লামা সামহুদী’ এর ৯৪টি নাম উল্লেখ করেছেন।

তন্মধ্যে ‘মদীনা’ নামটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ, যা আল-কুরআনে চার বার এসেছ। [সূরা আত্-তাওবাহ: ১০১, ১২০, সূরা আল আহযাব: ৬০, সূরা আল-মুনাফেকুন: ৮] আর হাদীসে এ নামটি অসংখ্যবার এসেছে।

মদীনার আরেকটি নাম ‘ত্বাবাহ’। ইমাম মুসলিম জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى سَمَّى الْمَدِينَةَ طَابَة»

 ‘‘আল্লাহ তা’য়ালা এ মদীনাকে ‘ত্বাবাহ’ নামে নামকরণ করেছেন।’’ [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৪২৩]

এ শহরের অন্যতম আরেকটি নাম হল ‘ত্বাইবাহ’ বা ‘ত্বাইয়েবাহ’। ইমাম মুসলিমের আরেকটি বর্ণনা এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«هَذِهِ طَيْبَةُ هَذِهِ طَيْبَةُ هَذِهِ طَيْبَة»

 ‘‘এ নগরী হল ত্বাইবাহ, ত্বাইবাহ, ত্বাইবাহ’’। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৫৭৩]

ত্বাবাহ ও ত্বাইবাহ কিংবা ত্বাইয়েবাহ শব্দগুলোর অর্থ হল পবিত্র বা উত্তম।

আরো যে সব নামে মদীনাকে অভিহিত করা হয় তম্মধ্যে রয়েছে ‘আদ-দার’, ‘আল-হাবীবা’, ‘দারুল হিজরাহ’, ‘দারুল ফাতহ’ ইত্যাদি।

আর জাহেলী যুগে মদীনার নাম ছিল ‘ইয়াসরিব’। কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নামে এ শহরটিকে অভিহিত করতে অপছন্দ করেছেন। ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«أُمِرْتُ بِقَرْيَةٍ تَأْكُلُ الْقُرَى يَقُولُونَ يَثْرِبُ وَهْيَ الْمَدِينَة»

 ‘‘আমাকে এমন এক জনপদে হিজরত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা অন্য সব জনপদকে গ্রাস করবে। লোকজন একে ইয়াসরিব বলে। অথচ এটি হল মদীনা’’। [সহীহ বুখারী - ১৮৭১ ও সহীহ মুসলিম-৩৪১৯]

 মদীনার ফযিলত ও মর্যাদা

 রাসূলের প্রিয় নগরী:

এ নগরী যাতে অন্য সকলেরও প্রিয় হয়, সেজন্য তিনি আল্লাহর কাছে দো‘আ করেছিলেন,

«اللَّهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الْمَدِينَةَ كَحُبِّنَا مَكَّةَ ، أَوْ أَشَد»

‘‘হে আল্লাহ! তুমি মদীনাকে আমাদের কাছে প্রিয় করে দাও, যেমনি ভাবে প্রিয় করেছ মক্কাকে, বরং তার চেয়েও বেশী প্রিয় কর।’’ [সহীহ বুখারী: ১৮৮৯, সহীহ মুসলিম: ৩৪০৮]

 রাসূলের শেষ জীবনের স্থায়ী নিবাস:

এ নগরীতেই তিনি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়টুকু অতিবাহিত করেছেন। হেদায়াতের আলো নিয়ে এর আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন মানুষকে সত্যের দিশা দেয়ার জন্য। এর প্রতিটি ধুলিকণা সাক্ষ্য দিবে যে, তিনি মানুষকে এক আল্লাহর দিকে ডেকেছেন, একমাত্র সত্যধর্ম ইসলামের দিকে ডেকেছেন, ইহ ও পরকালীন মুক্তির দিকে ডেকেছেন।

 এ নগরীর সবকিছুতে বরকত দেয়ার জন্য দো‘আ:

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে মদীনার সবকিছুতে বরকত দেয়ার জন্য নিম্নবর্ণিত দো‘আটি করেন:

«اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِى ثَمَرِنَا وَبَارِكْ لَنَا فِى مَدِينَتِنَا وَبَارِكْ لَنَا فِى صَاعِنَا وَبَارِكْ لَنَا فِى مُدِّنَا اللَّهُمَّ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ عَبْدُكَ وَخَلِيلُكَ وَنَبِيُّكَ وَإِنِّى عَبْدُكَ وَنَبِيُّكَ وَإِنَّهُ دَعَاكَ لِمَكَّةَ وَإِنِّى أَدْعُوكَ لِلْمَدِينَةِ بِمِثْلِ مَا دَعَاكَ لِمَكَّةَ وَمِثْلِهِ مَعَه»

‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের ফল-ফলাদিতে বরকত দাও। আমাদের এ মদীনায় বরকত দাও। আমাদের আহার্য্য, শস্য ও খাদ্য-দ্রব্যে বরকত দাও। হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই ইবরাহীম তোমার বান্দা, তোমার বন্ধু ও তোমার নবী। আর আমিও তোমার বান্দা ও তোমার নবী। তিনি মক্কা নগরীর বরকতের জন্য তোমার কাছে দো‘আ করেছিলেন। মক্কার জন্য যে পরিমাণ দো‘আ তিনি তোমার কাছে করেছিলেন, মদীনার জন্য সে পরিমাণ এবং তদনুরূপ আরেকগুণ বরকতের দো‘আ আমি তোমার কাছে করছি।’’ [সহীহ মুসলিম: ৩৪০০]

অন্য বর্ণনায় এরকম দো‘আ এসেছে,

«اللَّهُمَّ اجْعَلْ بِالْمَدِينَةِ ضِعْفَىْ مَا بِمَكَّةَ مِنَ الْبَرَكَة»

‘‘হে আল্লাহ! মক্কায় যতটুকু বরকত রয়েছে, মদীনায় তার দ্বিগুণ বরকত দাও।’’ [সহীহ মুসলিম - ৩৩৯২]

 মদীনাকে ‘হারাম’ বলে ঘোষণা:

হারাম শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে নিষিদ্ধ এবং আরেকটি পবিত্র। দু’টো অর্থই এ নগরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

«الْمَدِينَةُ حَرَمٌ مَا بَيْنَ عَيْرٍ إِلَى ثَوْر»

‘‘মদীনার ‌‘আইর ও সওর পর্বতের মাঝখানের স্থানটুকু হারাম’’। [সহীহ মুসলিম: ৩৩৯৩]

«إِنَّ إِبْرَاهِيمَ حَرَّمَ مَكَّةَ وَإِنِّى حَرَّمْتُ الْمَدِينَةَ مَا بَيْنَ لاَبَتَيْهَا لاَ يُقْطَعُ عِضَاهُهَا وَلاَ يُصَادُ صَيْدُهَا»

‘‘ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মক্কাকে ‘হারাম’ বলে ঘোষণা করেছিলেন, আর আমি মদীনাকে তথা এর প্রস্তরময় দু’ভূমির মাঝখানের অংশকে ‘হারাম’ বলে ঘোষণা করছি- এর বৃক্ষসমূহ কাটা যাবে না এবং এর প্রাণী শিকার করা যাবে না।’’ [সহীহ মুসলিম - ৩৩৮৩]

1.    ফেরেশতাদের প্রহরায় মদীনাকে মহামারী ও দাজ্জাল থেকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা:

আল্লাহ তা’আলা মদীনার প্রবেশদ্বারসমূহে ফেরেশতাদের মধ্য থেকে প্রহরী নিযুক্ত করেছেন, যারা এতে মহামারী ও দাজ্জালের প্রবেশকে প্রতিহত করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«عَلَى أَنْقَابِ الْمَدِينَةِ مَلاَئِكَةٌ لاَ يَدْخُلُهَا الطَّاعُونُ ، وَلاَ الدَّجَّالُ».

‘‘মদীনার পথে-প্রান্তরে রয়েছে (প্রহরী) ফেরেশতাগণ, (তাই) এখানে মহামারী ও দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না।’’ [সহীহ বুখারী - ১৮৮০, ৫৭৩১ ও সহীহ মুসলিম - ৩৩৩৭]

 মদীনায় বসবাসের আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে:

মদীনায় বসবাসের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি এখানে বসবাসের ফলে দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হলেও ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন এবং মদীনা ছেড়ে যেতে অনুৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন,

«يَأْتِى عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ يَدْعُو الرَّجُلُ ابْنَ عَمِّهِ وَقَرِيبَهُ هَلُمَّ إِلَى الرَّخَاءِ هَلُمَّ إِلَى الرَّخَاءِ وَالْمَدِينَةُ خَيْرٌ لَهُمْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ يَخْرُجُ مِنْهُمْ أَحَدٌ رَغْبَةً عَنْهَا إِلاَّ أَخْلَفَ اللَّهُ فِيهَا خَيْرًا مِنْهُ أَلاَ إِنَّ الْمَدِينَةَ كَالْكِيرِ تُخْرِجُ الْخَبِيثَ. لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَنْفِىَ الْمَدِينَةُ شِرَارَهَا كَمَا يَنْفِى الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ».

‘‘মানুষের কাছে এমন এক সময় আসবে, মদীনায় বসবাসরত ব্যক্তি তার চাচাত ভাই ও আত্মীয়কে বলবে চল স্বচ্ছলতার দিকে, চল স্বচ্ছলতার দিকে। অথচ মদীনাই তাদের জন্য উত্তম, যদি তারা জানত। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, মদীনার প্রতি বিরাগভাজন হয়ে যে ব্যক্তিই এখান থেকে বের হয়ে যায়, আল্লাহ তদস্থলে তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তি স্থলাভিষিক্ত করে দেন। সাবধান, মদীনা (কামারের) হাঁপরের ন্যায় নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে বের করে দেবে। হাঁপর যেভাবে লোহার ময়লা বের করে দেয়, তেমনি, মদীনা ও তার মন্দ ব্যক্তিদের বের না করা পর্যন্ত ক্বিয়ামত হবেনা।’’ [সহীহ মুসলিম - ৩৪১৮]

হিজরী ৬৩ সালে মদীনায় লুট-পাটের যে ফিতনা হয়েছিল সে সময়ে আবু সাঈদ নামক জনৈক ব্যক্তি সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এসে মদীনা থেকে চলে যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ চাইলো। আর অভিযোগ করল যে, মদীনায় পণ্যের দাম বেশী ও তার পরিবার বড়। মদীনার কষ্ট, বিপদ ও সমস্যায় তার পক্ষে ধৈর্যধারণ করা সম্ভব নয় বলে সে জানাল। তখন আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘‘তোমার ধ্বংস হোক! তোমাকে আমি (কি করে) সে আদেশ করব? অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি,

«لاَ يَصْبِرُ أَحَدٌ عَلَى لأْوَائِهَا فَيَمُوتَ إِلاَّ كُنْتُ لَهُ شَفِيعًا أَوْ شَهِيدًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا كَانَ مُسْلِمًا».

‘যে ব্যক্তি মদীনার কষ্টে ধৈর্যধারণ করে তথায় মৃত্যুবরণ করবে, ক্বিয়ামতের দিন আমি তার জন্য শাফায়াত করব অথবা তার পক্ষে সাক্ষ্য দেব, যদি সে মুসলিম হয়।’’ [সহীহ মুসলিম - ৩৪০৫]

 মদীনার দু:খ-কষ্ট ও বালা-মুসিবতে ধৈর্যধারণের মর্যাদা:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لاَ يَصْبِرُ أَحَدٌ عَلَى لأْوَائِهَا فَيَمُوتَ إِلاَّ كُنْتُ لَهُ شَفِيعًا أَوْ شَهِيدًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا كَانَ مُسْلِمًا».

‘‘যে ব্যক্তি মদীনার কষ্ট ও বালা-মুসিবতে ধৈর্যধারণ করবে, ক্বিয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে সাক্ষ্য দেব কিংবা তার জন্য শাফায়াত করব।’’ [সহীহ মুসলিম - ৩৪০৫]

 মদীনায় মৃত্যু হওয়ার মর্যাদা:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ اسْتَطَاعَ أَنْ يَمُوتَ بِالمَدِينَةِ فَلْيَمُتْ بِهَا ، فَإِنِّي أَشْفَعُ لِمَنْ يَمُوتُ بِهَا».

‘‘যে ব্যক্তি মদীনায় মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম, সে যেন তা করে। কেননা যে তথায় মৃত্যুবরণ করবে, আমি তার জন্য শাফায়াত করব।’’ [সহীহ সূত্রে ইমাম আহমাদ: ৫৮১৮]

2.    মদীনা ঈমানের স্থান:

মদীনা দারুল ঈমান বা ঈমানের গৃহ। তাইতো এখান থেকেই ঈমানের আলো সারা বিশ্বে বিচ্ছুরিত হয়েছিল। পরিশেষে মানুষ যখন ঈমান হতে বিচ্যুত হতে থাকবে, তখন ঈমান তার গৃহে তথা মদীনার দিকে ফিরে আসবে, যেভাবে সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«إِنَّ الإِيمَانَ لَيَأْرِزُ إِلَى الْمَدِينَةِ كَمَا تَأْرِزُ الْحَيَّةُ إِلَى جُحْرِهَا».

 “ঈমান মদীনার দিকে ফিরে আসবে, যেভাবে সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে’’। [সহীহ বুখারী - ১৮৭৬ ও মুসলিম - ৩৭২]

 মদীনায় ইলম শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেয়ার মর্যাদা:

মদীনা ছিল প্রথম বিদ্যালয় যা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতের এমন এক প্রজন্মের তারবিয়াতের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, ইতিহাসে যাদের আর কোন জুড়ি মেলে না। তাইতো এখান থেকে বের হয়েছে অসংখ্য সৎ ও বিজ্ঞ আলেম, যারা স্বীয় ইলম ও তারবিয়াতের মাধ্যমে জগতকে আলোকিত করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«يَضْرِبُونَ أَكْبَادَ الإِبِلِ يَطْلُبُونَ الْعِلْمَ فَلاَ يَجِدُونَ عَالِمًا أَعْلَمَ مِنْ عَالِمِ الْمَدِينَة»

‘‘মানুষ হন্যে হয়ে ইলম অনুসন্ধান করবে, তবে মদীনার আলেমের চেয়ে অধিক বিজ্ঞ কোন আলেম তারা খুঁজে পাবে না।’’ [নাসায়ী: ৪২৭৭ ও হাকেম: ৩০৭ সহীহ সূত্রে]

তিনি আরো বলেন,

«مَنْ جَاءَ مَسْجِدَنَا هَذَا يَتَعَلَّمُ خَيْرًا أَوْ يُعَلِّمُهُ فَهُوَ كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ»

‘‘যে ব্যক্তি আমার মসজিদে শুধু এই জন্যেই আসে যে, সে কোন কল্যাণের দীক্ষা নেবে কিংবা অন্যদের শিক্ষা দেবে, সে আল্লাহর পথে জিহাদকারীর সমতূল্য।’’[হাকিম: ৩০৯, বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী]

 মদীনায় রয়েছে পবিত্র মাসজিদে নববী:

স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে তৈরী এ মাসজিদের অসংখ্য ফযিলত রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«صَلاَةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ إِلاَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ».

‘‘আমার এ মাসজিদে নামায আদায় (মক্কার) মাসজিদুল হারাম ছাড়া অন্য যে কোন মাসজিদে নামায আদায় অপেক্ষা এক হাজার গুণ উত্তম।’’ [সহীহ বুখারী: ১১৯০ ও সহীহ মুসলিম: ৩৪৪০]

মাসজিদে নববী হচ্ছে সেই তিন মাসজিদের একটি, যার উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত হতে সওয়াবের উদ্দেশ্যে সফর করা বৈধ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لاَ تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلاَّ إِلَى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ مَسْجِدِى هَذَا وَمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَسْجِدِ الأَقْصَى».

‘‘তিনটি মাসজিদ ছাড়া আর কোথাও (সাওয়াবের নিয়তে) সফর করা জায়েয নেই। এগুলো হল: (মক্কার) মাসজিদুল হারাম, আমার এই মাসজিদ এবং মাসজিদুল আকসা।’’ [সহীহ বুখারী: ১১৮৯ ও সহীহ মুসলিম: ৩৪৫০]

আর এ মাসজিদ নববীতে ‘রাওদাতুম মিন রিয়াদুল জান্নাহ’ রয়েছে যার সম্পর্কে স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«مَا بَيْنَ مِنْبَرِى وَبَيْتِى رَوْضَةٌ مِنْ رِيَاضِ الْجَنَّةِ».

‘‘আমার মিম্বর ও ঘরের মাঝখানের অংশটুকু জান্নাতের বাগিচা সমূহের একটি বাগিচা।’’ [সহীহ বুখারী: ১১৯৫ ও সহীহ মুসলিম: ৩৩৫৬]

 মদীনায় রয়েছে মাসজিদে কুবা:

এ মাসজিদে নামায পড়ার ফযিলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«مَنْ تَطَهَّرَ فِي بَيْتِهِ ثُمَّ أَتَى مَسْجِدَ قُبَاءٍ ، فَصَلَّى فِيهِ صَلاَةً، كَانَ لَهُ كَأَجْرِ عُمْرَةٍ».

‘‘যে ব্যক্তি নিজ ঘরে ত্বাহারাত তথা পবিত্রতা অর্জন করে মাসজিদে কুবায় গিয়ে কোনো নামায পড়ে, তার জন্য উমরার সমান সাওয়াব অর্জিত হবে।’’ [সহীহ সূত্রে আহমাদ, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ]

 মদীনায় অবস্থানের আদবসমূহ

 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কুদওয়া ও আদর্শ হিসাবে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়া:

কেননা তিনিই মদীনাবাসী সবার মাঝে হেদায়াতের আলো বিতরণ করেছেন এবং তারা তাঁর হেদায়েত লাভে ধন্য হয়েছে। সুতরাং বর্তমানেও যারা মদীনায় অবস্থান করছে, স্থায়ীভাবে হোক কিংবা সাময়িক ভাবে, তাদের জন্যেও ওয়াজিব হচ্ছে তাঁকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ করা, যাতে তারা তাঁর প্রচারিত হেদায়াতের দিশা লাভে ধন্য হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١ ﴾ [الاحزاب : ٢١] 

‘‘রাসূলুল্লাহর মধ্যে তোমাদের (সে লোকদের) জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে খুব বেশী স্মরণ করে।’’ [সূরা আল-আহযাব: ২১]

 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত অনুসরণের ব্যাপারে সজাগ থাকা এবং সর্বপ্রকার বেদআ‘ত ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা:

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«مَنْ أَحْدَثَ فِيهَا حَدَثًا فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلاَئِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لاَ يَقْبَلُ اللَّهُ مِنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ صَرْفًا وَلاَ عَدْلاً».

‘‘যে ব্যক্তি মদীনায় কোন পাপ করে, অথবা পাপাচারী আশ্রয় দান করে, তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতাগণ ও  সকল মানুষের লা’নত পড়বে। ক্বিয়ামতের দিন তার কাছ থেকে আল্লাহ কোন ইবাদাত ও দান গ্রহণ করবেন না।’’ [সহীহ বুখারী: ১৮৭০ ও সহীহ মুসলিম: ৩৩৮৯]

 মদীনায় অবস্থানরত অপরাপর কোন ব্যক্তির উপর চড়াও না হওয়া, কারো জান-মাল ও ইজ্জতের উপর হামলা করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা এবং কারো প্রতি মন্দ ইচ্ছা পোষণ না করা:

এগুলো সবস্থানেই হারাম। তবে মদীনায় শক্তভাবে নিষিদ্ধ। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«مَنْ أَرَادَ أَهْلَ هَذِهِ الْبَلْدَةِ بِسُوءٍ - يَعْنِى الْمَدِينَةَ - أَذَابَهُ اللَّهُ كَمَا يَذُوبُ الْمِلْحُ فِى الْمَاءِ».

‘‘যে ব্যক্তি এ নগরীর অধিবাসীদের কোন ক্ষতি সাধন করতে চায়, আল্লাহ তাকে মিশিয়ে দেবেন (নিশ্চিহ্ন করে দিবেন) যেভাবে লবন পানির মধ্যে মিশে যায়’’। [সহীহ মুসলিম - ৩৪২৪]

 পবিত্র মদীনায় অবস্থানকালে কোন প্রকার বালা-মুসীবত ও দু:খ-কষ্টের মুখোমুখি হলে ধৈর্যধারণ করা:

এ সম্পর্কে ইতোপূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী উল্লেখ করা হয়েছে।

1.    ইবাদত, দো‘আ, ইস্তেগফার ইত্যাদিতে বেশী বেশী সম্পৃক্ত থাকা:

বিশেষ করে মাসজিদে নববীতে নামায জামায়াত সহকারে আদায় করা, মাঝে মাঝে মাসজিদে কুবায় নামায পড়া এবং বাকী‘ কবরস্থান ও উহুদের শহীদ সাহাবাদের কবরস্থান যিয়ারত করা উত্তম।

আল্লাহ আমাদেরকে পবিত্র মদীনার ফযিলত হৃদয়ঙ্গম করে সে অনুযায়ী বেশী বেশী উত্তম কাজ করার তওফীক দান করুন।