×
এ নিবন্ধে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসলামী শারীয়াহ্ এর পরিচয়, বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

    ইসলামী শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য : বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব

    [ বাংলা – Bengali – بنغالي ]

    ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    2012 - 1434

    مقاصد الشريعة الإسلامية وأهميتها

    في الوقت المعاصر

    « باللغة البنغالية »

    الدكتور محمد منظور إلهـي

    مراجعة: الدكتور أبو بكر محمد زكريا

    2012 - 1434

    ইসলামী শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য :

    বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব

    ভূমিকাঃ

    আল্লাহ রাববুল আলামীন মানুষ ও এ বিশ্বজগতসহ সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। সুস্থ, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবন-ব্যবস্থা হিসাবে মানুষকে প্রদান করেছেন ইসলামী শরীয়াহ্।

    শারীয়াহ্ এর সংজ্ঞাঃ

    ‘শারীয়াহ্’ একটি আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ দীন, ধর্ম, জীবন-পদ্ধতি, নিয়ম-নীতি ইত্যাদি[1]। তবে আরবী ভাষায় শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল - পানির উৎসস্থল বা যে স্থান থেকে পানি উৎসারিত হয়ে গড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ সেখানে এসে পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করে[2]

    পরিভাষায় শারীয়াহ্ এর সংজ্ঞায় ইমাম ইবনু তাইমিইয়াহ বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যে সব আকীদা ও আমল মানুষের জন্য প্রণয়ন করেছেন, তা-ই শারীয়াহ্’[3]। অন্যত্র তিনি বলেছেন, শারীয়াহ্ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উলুল আমর (তথা মুসলিম প্রশাসক ও আমীর) এর আনুগত্য করা’[4]

    ইসলামী শারীয়াহ্ এর সংজ্ঞা আরো সহজভাবে আমরা এভাবে দিতে পারি, ‘‘মহান আল্লাহ তা‘আলা জীবন ও জগত পরিচালনার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে স্বীয় বান্দাদেরকে যে সার্বিক হুকুম ও বিধান প্রদান করেছেন, তা-ই হল ইসলামী শারীয়াহ্’’।

    ইসলামী শরীয়াহ্ এর বৈশিষ্ট্যঃ

    ইসলামী শরীয়াহ্ এর অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তন্মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহ নীচে তুলে ধরা হল।

    ১। এটি রাববানী তথা আল্লাহ প্রদত্তঃ

    এ শরীয়াহ্ প্রণয়ন করেছেন সে মহান স্রষ্টা, যিনি মানুষ ও জগত সৃষ্টি করেছেন এবং জগতের স্থান কাল ও পাত্র ভেদে মানুষের জন্য কি কি সবচেয়ে কল্যাণকর তা তিনি জানেন। আল্লাহ বলেন,

    ﴿ وَرَبُّكَ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُ وَيَخۡتَارُۗ مَا كَانَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُۚ سُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٦٨ ﴾ [القصص: ٦٨]

    ‘‘আপনার প্রতিপালক যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং যাকে ইচ্ছা মানোনীত করেন, এতে তাদের কোনো এখতিয়ার নেই। আল্লাহ পবিত্র, মহান এবং তারা যে শরীক করে তা হতে তিনি উর্ধ্বে’’[5]

    ﴿ أَلَا يَعۡلَمُ مَنۡ خَلَقَ وَهُوَ ٱللَّطِيفُ ٱلۡخَبِيرُ ١٤ ﴾ [الملك: ١٤]

    ‘‘যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না? তিনি সুক্ষ্মদর্শী ও সম্যক অবহিত’’[6]

    ﴿ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ ٧١ ﴾ [الانفال: ٧١]

    ‘‘আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’’[7]

    অতএব ইসলামী শরীয়াহ সকল প্রকার ত্রুটিমুক্ত ও মানবতার জন্য সবচেয়ে বেশী কল্যাণকর।

    ২। এটি গোটা বিশ্ব মানবতার জন্যঃ

    ইসলামী শরীয়াহ এর সমস্ত আহকাম, বুনিয়াদী নীতিমালা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জাতি, দেশ ও বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। মহান আল্লাহ বলেন,

    ﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٠٧ ﴾ [الانبياء: ١٠٧]

    ‘‘আর আমি তো আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্য রহমতস্বরূপই পাঠিয়েছি’’[8]

    ﴿ قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُمۡ جَمِيعًا ﴾ [الاعراف: ١٥٧]

    ‘‘বলুন, হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সকলের কাছে প্রেরিত আল্লাহর রাসূল’’[9]

    ﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا كَآفَّةٗ لِّلنَّاسِ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗا وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعۡلَمُونَ ٢٨ ﴾ [سبا: ٢٨]

    ‘‘আর আমি তো আপনাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি’’[10]

    ৩। ব্যাপকতাঃ

    ইসলামী শরীয়াহ্-এ রয়েছে মানব জীবনের প্রতিটি দিকের সাথে সম্পর্কিত নীতিমালা, আহকাম ও আইন-কানুন, চাই তা মানুষের আকীদা, ইবাদাত ও চরিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট হোক কিংবা ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিচার পদ্ধতি সংক্রান্ত হোক। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

    ﴿وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ ٨٩ ﴾ [النحل: ٨٩]

    ‘‘আমি প্রত্যেক বিষয়ে ব্যাখ্যাস্বরূপ এবং মুসলিমদের জন্য হিদায়াত, রহমাত ও সুসংবাদস্বরূপ আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি’’[11]

    ৪। মৌলিকত্ব ও চিরস্থায়ীত্ব:

    ইসলামী শরীয়াহ্ এর নীতিমালা মৌলিক এবং এর উৎস সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ নিজে নিয়েছেন বলে তা কিয়ামত পর্যন্ত চিরস্থায়ী। আল্লাহ বলেন,

    ﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [الحجر: ٩]

    “নিশ্চয়ই আমিই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক’’[12]

    ৫। পালনে সহজতা ও কঠোরতা বিলোপঃ

    মানুষ যাতে ইসলামী শারীয়াহ্ এর আহকাম অত্যন্ত সহজে পালন করতে পারে মহান আল্লাহ তা‘আলা সেভাবেই শারয়ী নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। তদুপরি পালন করতে গিয়ে যখনই কেউ কোন যুক্তিগ্রাহ্য সমস্যার মুখোমুখি হয়, তখনই তার উপর থেকে হুকুমের ভার হালকা করে দেয়া হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]

    ‘‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান এবং তোমাদের জন্য কঠোরতা তিনি চান না’’[13]

    ﴿ وَمَا جَعَلَ عَلَيۡكُمۡ فِي ٱلدِّينِ مِنۡ حَرَجٖۚ ﴾ [الحج : ٧٨]

    ‘‘আল্লাহ দীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেন নি’’[14]

    ﴿ لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَاۚ ﴾ [البقرة: ٢٨٦]

    ‘‘আল্লাহ কারো উপর এমন কোন দায়িত্ব অর্পণ করেন না যা তার সাধ্যাতীত’’[15]

    ৬। বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক ব্যাপারে চমৎকার সমন্বয়ঃ

    ইসলামী শরীয়াহ্ একদিকে যেমন ইবাদাত পালনের মাধ্যমে মানুষকে আখিরাতমুখী হবার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে, অন্যদিকে দুনিয়ার বাস্তব জীবনের প্রয়োজন ও দাবী পূরণের নির্দেশও তাকে দিয়েছে। দুনিয়ার কাজ ও ব্যস্ততার মধ্যেও যাতে মানুষ আল্লাহর ইবাদাত পালন করে সেদিকে ইঙ্গিত করে কুরআনে বলা হয়েছে,

    ﴿ رِجَالٞ لَّا تُلۡهِيهِمۡ تِجَٰرَةٞ وَلَا بَيۡعٌ عَن ذِكۡرِ ٱللَّهِ وَإِقَامِ ٱلصَّلَوٰةِ وَإِيتَآءِ ٱلزَّكَوٰةِ يَخَافُونَ يَوۡمٗا تَتَقَلَّبُ فِيهِ ٱلۡقُلُوبُ وَٱلۡأَبۡصَٰرُ ٣٧ ﴾ [النور : ٣٧]

    ‘‘সে সব লোক যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং সালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান হতে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেদিনকে যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে’’[16]

    আবার ইবাদাত পালনের পাশাপাশি তাদেরকে জীবিকা অর্জনের নির্দেশও প্রদান করা হচ্ছে।

    ﴿ فَإِذَا قُضِيَتِ ٱلصَّلَوٰةُ فَٱنتَشِرُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَٱبۡتَغُواْ مِن فَضۡلِ ٱللَّهِ ﴾ [الجمعة: ١٠]

    ‘‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) সন্ধান কর’’[17]

    ৭। ব্যক্তি ও সমষ্টির যথার্থ মূল্যায়নঃ

    ইসলামী শরীয়াহ্ ব্যক্তি ও সমষ্টির কারো স্বার্থহানি না করে সকলের স্বার্থের প্রতি সমান দৃষ্টি রেখেছে। ইসলামে ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তিস্বার্থকে কখনো অবজ্ঞা করা হয় না, তবে ব্যক্তি ও সামষ্টিক স্বার্থের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তখন সামষ্টিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।

    ৮। যুগোপযোগিতাঃ

    ইসলামী শরীয়াহ্ প্রগতিশীল। কেননা কালের আবর্তনে উদ্ভূত সকল সমস্যার সমাধানের জন্য কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক চিন্তা-গবেষণার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এতে রয়েছে। সুতরাং যাবতীয় নতুন অবস্থার সাথে তা সামঞ্জস্যশীল হতে সক্ষম। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেমন এর সফল কার্যকারিতা রয়েছে, তেমনি কিয়ামত পর্যন্ত এর কার্যকারিতা অক্ষুন্ন থাকবে। কেননা কিয়ামত পর্যন্ত এটিই আল্লাহর দেয়া সর্বশেষ ও একমাত্র জীবন ব্যবস্থা।

    ৯। উদারতাঃ

    ইসলামী শারীয়াহ্ উদারতা সম্পন্ন। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

    بُعِثْتُ بِالْحَنِيفِيَّةِ السَّمْحَةِ

    ‘‘আমাকে উদারতাসম্পন্ন দীন সহকারে প্রেরণ করা হয়েছে’’[18]। এর ফলে এমন কি অমুসলিমগণ ইসলামী রাষ্ট্রে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করে থাকেন।

    ১০। সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ

    জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য ন্যায়পরয়ণতার ভিত্তিতে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ইসলামী শরীয়াহ্ এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

    ইসলামী শারীয়াহ্ এর গুরুত্বঃ

    শারীয়াহ্ ও সমাজের মধ্যে একটি নিবীড় বন্ধন রয়েছে। বহু ব্যক্তির সমন্বয়ে সমাজ গড়ে উঠে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রয়োজনের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সমাজের প্রত্যেকের রয়েছে নানাবিধ চাহিদা। ব্যক্তি একাই নিজের সে সব চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সমাজের অন্যদের সহযোগিতার প্রতি তাকে মুখাপেক্ষী হতে হয়। ফলে স্বভাবতই মানুষের জীবন হয়ে পড়েছে সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সমাজবদ্ধ। সমাজের সকলের অধিকারকে সুশৃংখলভাবে সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজন একটি পরিপূর্ণ আইনী ব্যবস্থা ও বিধানের, যা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করবে, অধিকারের সীমা নির্দিষ্ট করে দেবে ও প্রত্যেকের স্বেচ্ছাচারিতাকে আইনের দ্বারা সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত করবে। এ ব্যবস্থা না হলে মানুষের সামষ্টিক জীবন হয়ে পড়বে খুবই দুষ্কর। কেননা মানুষের একটা প্রবণতা হচ্ছে নিজের সুবিধা ও স্বার্থকে বড় করে দেখা। এ প্রবণতা যদি আইন দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে পারস্পরিক যুলুম-নির্যাতন বেড়ে যাবে, অধিকার ক্ষুন্ন হবে এবং সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। আর প্রতাপশালী ও কূটজাল বিস্তারকারীদের দৌরাত্ম প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং মানুষ সবসময়ই সুশৃংখল আইন-কানুন সম্বলিত এমন এক ব্যবস্থা মেনে চলার তীব্র প্রয়োজন অনুভব করেছে, যাতে সমাজের সকলের অধিকার নিশ্চিত হয়, কেউ কারো অধিকার হরণ করতে না পারে এবং কেউ-ই তার নিজের সীমা লংঘন করে অন্যের সীমায় অনুপ্রবেশ করতে না পারে। বস্তুত একটা সুষম, কল্যাণমুখী ও সর্বাত্মক ব্যবস্থা ছাড়া মানুষের পক্ষে সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ জীবন যাপন করা কোনমতেই সম্ভবপর নয়। এজন্যই আল্লাহর অবতারিত শরীয়ত তাঁর অগণিত অন্য সব নিয়ামতের মতই বিশ্বমানবতার প্রতি এক বিরাট রহমাত হয়ে দেখা দিয়েছে। এর ভিত্তিতেই হতে পারে মানুষের যাবতীয় সমস্যার সার্থক সমাধান ও তাদের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের সুষ্ঠু মীমাংসা ও নিষ্পত্তি।

    বস্তুত আল্লাহর শারীয়াহ্ই হচ্ছে তাঁর বান্দাদের মধ্যে পারস্পরিক ন্যায়পরায়নতা স্থাপনের যথার্থ বিধান। নিঃসন্দেহে সমগ্র মানবতার প্রতি এটা তাঁর অনুগ্রহ ও করূণা। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে নিজ নিজ জীবন, সংগঠন ও সমাজের উৎকর্ষ সাধনের ব্যাপারে কেবলমাত্র তাদের নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধির উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী করে ছেড়ে দেন নি। বরং তাদেরকে প্রবৃত্তির স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্ত করেছেন ইসলামী শারীয়াহ্ এর বিধান উপস্থাপন করে। মানব রচিত কোনো বিধানই প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ও স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্ত ও পবিত্র নয়। তা থেকে মুক্ত ও পবিত্র হচ্ছে আল্লাহর শারীয়াহ্ এর বিধান।

    ইসলামী শরীয়াহ্ ও প্রচলিত আইনের মধ্যে পার্থক্যঃ

    ইসলামী শারীয়াহ্-এর মতই প্রচলিত মানব রচিত আইনসমূহ যদিও জনস্বার্থের কল্যাণ সাধনের অঙ্গীকার করে এবং সমাজের আইন, শৃংখলা, নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করার আশাবাদ ব্যক্ত করে, কিন্তু এর সাথে ইসলামী শারীয়াহ্-এর রয়েছে অনেক পার্থক্য, যাতে ইসলামী শরীয়াহ্-এর শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ত্ব ও মর্যাদা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে সকল মানব রচিত মতবাদ ও আইনের উপর, যা মানুষ তার সীমাবদ্ধ বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে রচনা করেছে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য তুলে ধরা হলঃ

    ১। ইসলামী শরীয়াহ্ আল্লাহ প্রদত্তঃ

    মানব রচিত নয় বলে শারীয়াহ্ সব ধরনের ত্রুটিমুক্ত। পক্ষান্তরে মানুষ যেহেতু তার সকল কাজে পদে পদে ভুল-ত্রুটি, অজ্ঞতা ও অক্ষমতার মুখোমুখি হয়, ফলে তাদের তৈরী আইন ও মতবাদ হয়ে থাকে নানাপ্রকার ভুল-ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতায় পরিপূর্ণ। তদুপরি পরিবেশ, প্রবৃত্তি ও ভাবাবেগের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া থেকে তা মোটেই মুক্ত নয়। অথচ শারীয়াহ্ প্রণয়ন করেছেন সর্বজ্ঞানী মহাবিজ্ঞানময় এমন এক ইলাহ, আসমান ও যমীনের অনু পরিমাণ কোনো বস্তুও যার থেকে অদৃশ্য ও অজ্ঞাত থাকে না, যিনি মানুষকে সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। ফলে স্বভাবতই তিনি তাদের সার্বিক কল্যাণের উপযোগী বিধান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন। ‘মাআ’লিম ফিত-তরীক’ গ্রন্থকার বলেন, ‘‘যে শারীয়াহ্ আল্লাহ মানব জীবনকে সুসংবদ্ধ করার জন্য প্রণয়ন করেছেন তা এমনই এক বিধান যা জগতের সাধারণ নিয়মের সাথে সম্পর্কিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। ............সুতরাং মানবজীবন ও যে জগতে সে মানব বাস করে তার মধ্যে একটা সুসামঞ্জস্য বিধানের প্রয়োজনেই এ শারীয়াহ্ মেনে চলার আবশ্যকতা সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, বরং যে আইন মানুষের ভেতরের স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে ও যে আইন মানুষের বাহ্যিক জীবনকে পরিচালনা করে এতদুভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়োজনে এবং মানব ব্যক্তিত্বের ভেতর ও বাহিরের দুটি দিকের মধ্যে একটা সঙ্গতি বিধানের তাড়নায়ও এ শারীয়াহ্ মেনে চলা উচিত। মানুষ যখন জগতের সকল নিয়ম নীতি জানার সামর্থ রাখে না এবং সাধারণ জাগতিক নিয়মের সকল দিক আয়ত্বও করতে পারে না, এমন কি যে সত্ত্বা তাদের ফিতরাত ও প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেন ও তাদেরকে নিজের অধীনস্ত করে রাখেন, তারা চাক বা না চাক - সে সত্ত্বাকেও তারা আয়ত্ব করার সামর্থ রাখে না, তাহলে মানব জীবনের জন্য এমন বিধান রচনার অধিকার তাদের নেই, যদ্বারা মানুষের জীবন ও জগতের সঞ্চালনে এবং তাদের সুপ্ত স্বভাব ও বাহ্যিক জীবনে একটা ব্যাপক সামঞ্জস্য সাধিত হতে পারে।.....এ কাজের অধিকার রাখেন জগতের স্রষ্টা, মানুষের স্রষ্টা, যিনি নিজের ইচ্ছামত একটি নিয়মের অধীনে জগত ও মানবকে পরিচালিত করেন...’’[19]

    নিয়ম-কানুন ও আইন প্রণয়নে মানুষের মধ্যে বিস্ময়কর বিরোধিতার উপস্থিতি উপরোক্ত বক্তব্যকে দৃঢ়ভাবে সত্যায়ন করছে। কেননা পুঁজিবাদে মানুষ অসীম সম্পত্তির মালিক হতে পারে। পক্ষান্তরে কম্যুনিজম ও সমাজতন্ত্র এর পুরোপুরি বিপরীত। সেখানে ব্যক্তি সম্পদের মালিক হতে পারে না। সুতরাং প্রকৃত সত্য কথা হল, মানুষ যত বুদ্ধিমানই হোক না কেন, সে আসলে অক্ষম এবং তার জ্ঞান যতই বিস্তৃত হোক না কেন, তা সীমিত। অতএব মানুষের পক্ষে এমন বিধান রচনা অসম্ভব যা পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, সকল মানুষের জন্য কল্যাণকর ও উপযোগী এবং সকল জাতির সুখ-শান্তির নিশ্চয়তাদানকারী।

    ২। ইসলামী শরীয়াহ্ চারিত্রিক তারবিয়াতের উপর গুরুত্ব আরোপ করেঃ

    ইসলামী শরীয়াহ্ এর দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের সুষ্ঠু পরিচালনা, ব্যক্তি ও সমষ্টির সার্বিক কল্যাণ এবং জান, মাল, ইজ্জত-আব্রুর হেফাযতের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আখলাক। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

    إِنَّمَا بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ صَالِحَ الْأَخْلَاقِ

    ‘‘আমাকে উত্তম ও সৎ চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরণ করা হয়েছে’’[20]

    আর তাই ইসলামী শারীয়াহ্-এর যাবতীয় হুকুম আহকাম চারিত্রিক মূলনীতি ও নৈতিকতার সঙ্গে সর্বতোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ। যারা তাদের আচারে ব্যবহারে, কর্মে ও জীবনের পথ পরিক্রমায় চারিত্রিক সততার দাবী অনুযায়ী চলে, ইসলামী শারীয়াহ্ তাদের সাওয়াব ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করে। আর যারা এর বিপরীত পথে চলে ইসলামী শারীয়াহ্ দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের জন্য ব্যবস্থা করেছে যথার্থ শাস্তির। অন্যদিকে মানবরচিত আইনে এদিকের প্রতি কোন গুরুত্ব নেই। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চারিত্রিক অধঃপতন হিসেবে বিবেচিত হওয়া সত্বেও মানবরচিত আইনে যিনা বা ব্যভিচারের শাস্তি মাত্র দু’টো অবস্থাতেই দেয়া হয়।

    (ক) যখন জবরদস্তিমূলক ব্যভিচারে বাধ্য করা হয়।

    (খ) যখন একপক্ষের সম্মতি ও অপর পক্ষের অসম্মতি থাকে।

    এছাড়া অন্য সকল অবস্থায় ব্যভিচারের শাস্তির কোনো ব্যবস্থা মানবরচিত আইনে নেই। মদ্যপান, সমকামিতা ইত্যাদি আরো অনেক ক্ষেত্রের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। অথচ ইসলামী শারীয়ায় এ সব কিছুই পুরোপুরি নিষিদ্ধ ও আইনত দন্ডনীয়।

    ৩। ইসলামী শরীয়াহ্-এর দৃষ্টিতে আল্লাহ ও তাঁর দেয়া বিধানের প্রতি সঠিক আকীদা পোষণ হচ্ছে সমাজে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় উপকরণ এবং ব্যক্তি ও ব্যষ্টির কল্যাণ সাধনের মৌল ভিত্তি। কেননা তাকওয়াই শুধু সমাজের সকল মানুষকে সততা ও সত্যের পথে পরিচালিত করতে পারে এবং অন্যায়-অবিচার ও যুলুম থেকে রক্ষা করতে পারে। পক্ষান্তরে মানব রচিত কোনো আইনেই মানুষের স্রষ্টার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের কোন গুরুত্ব নেই। ফলে সে আইন সমাজ থেকে সকল অন্যায় ও অবিচার দূর করতে অক্ষম।

    ইসলামী শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যঃ

    সংজ্ঞা, উদাহরণ ও প্রমাণ

    ইসলামী শারীয়াহ্-এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কথাটিকে আরবীতে নাম দেয়া হয়েছে ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’। শারীয়াহ্-এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এর আরবী পরিভাষাটির কিছুটা বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

    ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ শিরোনামটিতে দু’টি শব্দ রয়েছে। একটি হচ্ছে মাকাসিদ, যা ‘মাকসাদ’ শব্দের বহুবচন। আরবীতে ‘মাকসাদ’ শব্দটির একাধিক আভিধানিক অর্থ রয়েছে, তন্মধ্যে প্রধানতম অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য[21]। বাংলায় বলা হয় ‘মনযিলে মাকসূদ’ অর্থাৎ গন্তব্যস্থল, যার উদ্দেশ্যে মানুষ যাত্রা করে থাকে। এদিক থেকে ‘মাকসাদ’ ও মাকসূদ শব্দদ্বয়ের অর্থ প্রায় একই।

    আরেকটি শব্দ হচ্ছে শারীয়াহ্। ইতোপূর্বে ‘শারীয়াহ্’ এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ ইসলামী আইন বিষয়ক জ্ঞনের একটি সমৃদ্ধ শাখা, যা স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি শাস্ত্র হিসাবে আজ মুসলিম বিশ্বেও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পঠিত হচ্ছে। সেজন্য ‘ইসলামী শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ কথাটির বদলে এ প্রবন্ধে আমরা ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ কথাটিই বেশী ব্যবহার করব।

    ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর পারিভাষিক সংজ্ঞাঃ

    পূর্ববর্তী মুসলিম পন্ডিতগণ ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর কোন সুক্ষ্ম পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রদান করেন নি, যদিও বিষয়টি তাদের অনেকেরই জানা ছিল। তারা ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর নানা বিষয় যেমন হিকমাত বা প্রজ্ঞা, ইল্লাত বা কার্যকারণ, মাসালিহ বা কল্যাণ এবং মাফাসিদ বা অকল্যাণ প্রভৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। শারীয়াহ্ এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন[22]। পরবর্তী সময়ে মুসলিম পন্ডিতগণ ইসলামী জ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখার সংজ্ঞা প্রদানে ব্রতী হন। তারই অংশ হিসেবে ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর একাধিক সংজ্ঞা তারা দিয়েছেন। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা দেয়া হলঃ

    1. তিউনিসিয়ার প্রখ্যাত মুসলিম পন্ডিত মুহাম্মাদ তাহির ইবনু ‘আশূর বলেন, ‘‘ব্যাপকার্থে মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ হচ্ছে সে সব উদ্দেশ্য ও হিকমাত, শরীয়াহ্ এর সকল কিংবা অধিকাংশ হুকুমের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ যেগুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন’’[23]

    2. প্রফেসর ড. আহমাদ রাইসূনী বলেন, ‘‘সকল বান্দার কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে যে সব লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য শরীয়াহ্ প্রণয়ন করা হয়েছে তা-ই হল মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’’[24]

    3. ড. মুহাম্মাদ সা‘দ আল-ইয়ূবী মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ এর সংজ্ঞায় বলেন, ‘‘মাকাসিদ হচ্ছে সে সকল উদ্দেশ্য, তাৎপর্য ও হিকমাত, শরীয়াহ্ প্রণয়নের সময় সকল বান্দার কল্যাণ সাধনের জন্য সাধারণভাবে ও বিশেষভাবে যেগুলোর প্রতি আল্লাহ লক্ষ্য রেখেছেন’’[25]

    এ সংজ্ঞাগুলো খুবই কাছাকাছি। এগুলোর আলোকে সংক্ষেপে বলা যায় যে, মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ হচ্ছে সে সকল মাসালিহ ও কল্যাণমুখী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সমষ্টি, শরয়ী হুকুম মেনে চলার মাধ্যমে বান্দাদের জন্য যা অর্জিত হওয়ার ইচ্ছা আল্লাহ করে থাকেন।

    উদাহরণঃ

    মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ এর উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শারীয়াহ্ এর বিভিন্ন হুকুম-আহকাম ও বিষয়সমূহে। ইবাদাত, মুয়া’মালাত, বিবাহ-শাদী, অপরাধ আইন ও কাফফারা প্রভৃতি সকল অধ্যায়েই শারীয়াহ্-এর উদ্দেশ্য ও মাকাসিদ বর্ণিত আছে।

    এতে কোন সন্দেহ নেই যে, শারীয়াহ্ এর প্রতিটি হুকুম ও শিক্ষা প্রণীত হয়েছে বিশেষ কিছু হিকমাত, উদ্দেশ্য ও এমন সব কল্যাণকে সামনে রেখে যার সুফল বান্দা দুনিয়া ও আখিরাতে লাভ করে থাকে। এ সকল হিকমাত, উদ্দেশ্য ও কল্যাণের অনেকগুলো আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, আবার বেশ কিছু উল্লেখ করা হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহে এবং কিছু কুরআন ও সুন্নাহের মূলনীতির আলোকে উদ্ভাবন করেছেন আলেম, তাফসীরকারক ও মুজতাহিদগণ[26]। সেসবের কিছু উদাহরণ আমরা নিচে উল্লেখ করছি।

    • অযু ও গোসলের বিধান দেয়া হয়েছে সালাত ও তাওয়াফের কার্য সম্পাদনের জন্য এবং প্রত্যেক মুসলিমের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার জন্য, যাতে একটি পরিচ্ছন্ন সভ্য মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সকল জাতির মধ্যে ফুলের মতই সৌন্দর্যের আধার হয়ে বিরাজ করবে।
    • জামায়াতবদ্ধ সালাত ও জুমুয়া’হ্ এর সালাতের বিধান এসেছে মহান আল্লাহর স্মরণকে জাগরূক করার জন্য, মুসলিমদেরকে সত্য, সততা ও পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য এবং ঈমান-আকীদাকে নবায়ন করা, সহীহ জ্ঞানার্জন করা ও ইবাদাতকে বিশুদ্ধ পন্থায় আদায় করার জন্য।
    • সালাতের উদ্দেশ্যে আযানের বিধান দেয়া হয়েছে ইবাদাতের সময় হওয়ার ঘোষণা দেয়ার জন্য এবং মানুষকে আল্লাহর ইবাদাতের উদ্দেশ্যে একত্রিত করার জন্য। বস্তুতঃ আযান হচ্ছে মানুষের বাস্তব জীবনে ইসলামের নীতি ও আদর্শ প্রচারের একটি শক্তিশালী মাধ্যম এবং আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব ও সার্বভৌম ক্ষমতা প্রকাশের একটি উত্তম পন্থা।।
    • পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের বিধান দেয়া হয়েছে আল্লাহর ইবাদাত পালনের জন্য, দিনে পাঁচবার তাঁর সাথে সম্পর্ক নবায়ন করে স্থির আদর্শ ও আনুগত্যের উপর নিজেকে অভ্যস্ত করার জন্য, অলসতা ঝেড়ে ফেলে সময়ানুবর্তিতা ও শৃংখলার অনুসারী হওয়ার জন্য এবং সালাত আদায়কারীকে দুনিয়ার সকল কষ্ট, জীবনের নানাবিধ সমস্যা ও শয়তানের কুপ্ররোচনা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য।
    • শুকর, মৃতদেহ ও রক্তের ন্যায় অপবিত্র ও নিকৃষ্ট বস্তুসমূহ মুসলিমদের উপর হারাম করার পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য ও আদেশ পালন এবং শারীরিক, মনস্তাত্বিক ও সামাজিক বিপর্যয় ও ক্ষতি পরিহার। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে এ সকল হারাম ও নিকৃষ্ট বস্তু মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
    • সমাজের সবার মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ এজন্যই দেয়া হয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি যেন নিজ নিজ অধিকার লাভ করে এবং সমাজের ফিতনা, ফাসাদ ও বিবাদ-বিসম্বাদ দূরীভূত হয়। আর মানুষ যেন আইন ও শৃংখলার পথে অধিকার অর্জনের পথে অগ্রসর হয়।
    • বিবাহ-শাদী, নানাবিধ ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য অনেক মু‘য়ামালাত ইসলামী শারীয়াহ্-এর মধ্যে বৈধ করা হয়েছে মানুষের জীবন-ধারণকে সহজতর করার জন্য এবং মানুষের জরুরী ও প্রয়োজনীয় লেনদেনকে সহজ করে মানুষের জীবনযাত্রাকে সমৃদ্ধ ও সুন্দর করার জন্য।

    এভাবে ইসলামী শারীয়াহ্ এর সকল বিধানেই নিহিত রয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য, হিকমাত ও কারণ।

    ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর দলীল ও প্রমাণঃ

    আল-কুরআনে ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ তথা ইসলামী শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিভিন্ন পদ্ধতি ও পন্থায় পেশ করা হয়েছে্। নিম্নে তার কিছু উদ্ধৃত করা হলঃ

    1. আল্লাহ কুরআনের বহু জায়গায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি হাকীম ও প্রজ্ঞাবান। আল্লাহ বলেন,

    ﴿ تَنزِيلٞ مِّنۡ حَكِيمٍ حَمِيدٖ ٤٢ ﴾ [فصلت: ٤٢]

    ‘‘এটি প্রজ্ঞাবান প্রশংসিত আল্লাহর নিকট হতে অবতারিত’’[27]। তিনি অন্যত্র বলেন,

    ﴿ تَنزِيلُ ٱلۡكِتَٰبِ مِنَ ٱللَّهِ ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡحَكِيمِ ١ ﴾ [الزمر: ١]

    ‘‘এটি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ প্রন্থ’’[28]

    আয়াতসমূহের এ কথাগুলোর অনিবার্য দাবী হল, তাঁর প্রণীত প্রতিটি বিধানের অবশ্যই একটি হিকমাত ও উদ্দেশ্য রয়েছে এবং কোনো কিছুই তিনি অনর্থক উদ্দেশ্যহীনভাবে প্রচলন করেন নি।

    2. আল্লাহ কুরআনের একাধিক স্থানে তিনি নিজেকে সবচেয়ে দয়ালু ও করুণাময় বলে উল্লেখ করেন।

    ﴿ وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ ﴾ [الاعراف: ١٥6]

    ‘‘আর আমার দয়া প্রতিটি বস্তুতে ব্যপ্ত হয়েছে’’[29]

    একটি দোয়ায় তিনি এভাবে বলা শিখিয়ে দিয়েছেন যে,

    ﴿ رَبَّنَآ ءَامَنَّا فَٱغۡفِرۡ لَنَا وَٱرۡحَمۡنَا وَأَنتَ خَيۡرُ ٱلرَّٰحِمِينَ ١٠٩ ﴾ [المؤمنون : ١٠٩]

    ‘‘হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি, অতএব আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে রহম করুন। আর আপনিই তো সর্বোত্তম দয়ালু’’[30]

    আর মানুষের প্রতি তাঁর করুণা হচ্ছে, তাদের জন্য এমন সকল বিধান প্রণয়ন যা তাদের জন্য কল্যাণকর। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল কাইয়েম শিফাউল ‘আলীল গ্রন্থে বলেন, ‘‘তাঁর হিকমাত ও তাঁর উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করার অর্থই হল প্রকৃতপক্ষে তাঁর রহমাত ও দয়াকে অস্বীকার করা’’[31]

    3. কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি এই এই কাজ এই এই উদ্দেশ্যে করেছেন। যেমন তিনি বলেন,

    ﴿ وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَٰكُمۡ أُمَّةٗ وَسَطٗا لِّتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ وَيَكُونَ ٱلرَّسُولُ عَلَيۡكُمۡ شَهِيدٗاۗ ﴾ [البقرة: ١٤٣]

    ‘‘আর অনুরূপভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থাবলম্বী জাতি করে দিয়েছি, যাতে তোমরা সকল মানুষের উপর সাক্ষী হয়ে যাও এবং রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হয়ে যান...’’[32]

    তিনি আরো বলেন,

    ﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ لِتَحۡكُمَ بَيۡنَ ٱلنَّاسِ بِمَآ أَرَىٰكَ ٱللَّهُۚ ﴾ [النساء : ١٠٥]

    ‘‘নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্য সহকারে গ্রন্থ নাযিল করেছি যাতে আপনি মানুষের মধ্যে সে বিষয় দিয়ে মীমাংসা করেন যা আল্লাহ আপনাকে দেখিয়েছেন’’[33]

    4. কুরআনের অনেক স্থানে শারীয়াহ্ এর কতিপয় ব্যাপক মাকাসিদ ও উদ্দেশ্যের কথা বর্ণিত হয়েছে আবার কোথাও সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে।

    ব্যাপক মাকাসিদের উদাহরণঃ যেমন দীনের সকল ক্ষেত্রে কঠোরতা বিলোপ ও অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশ্য। আল্লাহ বলেন,

    ﴿ وَمَا جَعَلَ عَلَيۡكُمۡ فِي ٱلدِّينِ مِنۡ حَرَجٖۚ ﴾ [الحج : ٧٨]

    ‘‘তিনি দীনের মধ্যে তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেন নি’’[34]

    আর কুরআনে সুনির্দিষ্টভাবে জিহাদ, সালাত, সিয়াম, যাকাত ও হাজ্জ প্রভৃতি ইবাদাতসমূহের উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সালাত সম্পর্কে বলা হয়েছে,

    ﴿ وَأَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ لِذِكۡرِيٓ ١٤ ﴾ [طه: ١٤]

    ‘‘এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য সালাত কায়েম কর’’[35]। আর সিয়াম সম্পর্কে বলা হয়েছে,

    ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣ ﴾ [البقرة: ١٨٣]

    ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার’’[36]

    মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ চেনার পন্থাসমূহ

    ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, শারীয়াহ্ এর প্রতিটি হুকুমের পশ্চাতেই রয়েছে একটি বিশেষ মাকসাদ ও উদ্দেশ্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে সে উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এটি শারীয়াহ্-এর উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে কোন একটি বিষয়কে শারীয়াহ্ প্রণেতার উদ্দেশ্য বলে দাবী করা কিংবা উদ্দেশ্য নয় বলে ঘোষণা করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার, এর জন্য প্রয়োজন ধীরস্থিরভাবে গভীর চিন্তা-ভাবনা, বিশুদ্ধ নিয়ম-প্রণালীর অনুসরণ এবং সেসব সুস্পষ্ট উপায় ও পন্থাসমূহ সুনির্দিষ্ট করা যদ্বারা সেগুলোকে সহজেই চেনা যাবে।

    মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ সম্পর্কে জানার এ ধরনের উপায় হচ্ছে মোট পাঁচটি[37]

    1. আল-ইস্তেকরা তথা গবেষণাভিত্তিক অনুসন্ধানঃ

    ইস্তেকরা হচ্ছে শরীয়াহ্-এর সকল দলীল ও হুকুম-আহকাম পূর্ণ অনুসন্ধান করে শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও মাকাসিদ এর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া। যেমন, শরীয়াহ্-এর সকল দলীল ও হুকুম-আহকাম অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, মানব জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ (আদ্-দারুরিয়্যাত) সর্বমোট পাঁচটিঃ দীন, প্রাণ বা জীবন, বিবেক-বুদ্ধি, সম্পদ ও বংশধারার হেফাযত। অতএব সহজেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, এ পাঁচটি বিষয়ের হেফাযত ও সংরক্ষণ শারীয়াহ্ প্রণেতার অন্যতম উদ্দেশ্য।

    2. শার‘য়ী নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞাসমূহের কারণ জানাঃ

    ইসলামী শারীয়াহ্-তে যে সকল নির্দেশাবলী কিংবা নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে যে কারণ দর্শানো হয়েছে তদ্বারা শারীয়াহ্-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,

    ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ﴾ [البقرة: ٢١]

    ‘‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের সে প্রতিপালকের ইবাদাত কর যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার’’[38]

    ﴿ وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ ٨٩ ﴾ [النحل: ٨٩]

    ‘‘আর আমি আপনার উপর গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি সকল কিছুর স্পষ্ট ব্যাখ্যা করার জন্য এবং মুসলিমদের উদ্দেশ্যে হেদায়াত ও রহমাত এবং সুসংবাদ প্রদানের জন্য...’’[39]

    ﴿ مَّآ أَفَآءَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ مِنۡ أَهۡلِ ٱلۡقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِ كَيۡ لَا يَكُونَ دُولَةَۢ بَيۡنَ ٱلۡأَغۡنِيَآءِ مِنكُمۡۚ ﴾ [الحشر: ٧]

    ‘‘আল্লাহ জনপদবাসীদের নিকট হতে তাঁর রাসূলকে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহর, তাঁর রাসূলের, রাসূলের স্বজনগণের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্ত ও পথচারীদের, যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই সম্পদ আবর্তন না করে’’[40]

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

    إِنَّمَا نَهَيْتُكُمْ مِنْ أَجْلِ الدَّافَّةِ الَّتِى دَفَّتْ فَكُلُوا وَادَّخِرُوا وَتَصَدَّقُوا

    ‘‘মদীনায় আগমনকারী ভ্রমণ কাফেলার কারণেই আমি তোমাদেরকে (কুরবানীর গোশ মজুদ করতে) নিষেধ করেছিলাম। তবে এখন তোমরা তা ভক্ষণ করতে পার, মজুদ করতে পার এবং সদকা প্রদান করতে পার’’[41]

    3. প্রাথমিকভাবে আরোপিত যে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ কিংবা নিষেধাজ্ঞাঃ

    এ থেকে বুঝা যায় যে, নির্দেশটি কার্যে পরিণত করা হোক এবং নিষেধকৃত বস্তু থেকে বিরত থাকা হোক - এটাই শারীয়াহ্ প্রণেতার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য। অতএব কেউ যদি শারীয়াহ্ এর নির্দেশ বাস্তবায়ন না করে কিংবা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে সে শারীয়াহ্-এর মাকাসিদ ও উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করল।

    4. যে বক্তব্য থেকে সরাসরি মাকাসিদ সম্পর্কে জানা যায়ঃ

    এ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে শারীয়াহ্ প্রণেতা স্বয়ং তার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করা। যেমন আল্লাহর বাণী,

    ﴿ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]

    ‘‘আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য ক্লেশকর তা চান না’’[42]

    তিনি আরো বলেন,

    ﴿ يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمۡ وَيَهۡدِيَكُمۡ سُنَنَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ وَيَتُوبَ عَلَيۡكُمۡۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٢٦ وَٱللَّهُ يُرِيدُ أَن يَتُوبَ عَلَيۡكُمۡ وَيُرِيدُ ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلشَّهَوَٰتِ أَن تَمِيلُواْ مَيۡلًا عَظِيمٗا ٢٧ ﴾ [النساء : ٢٦، ٢٧]

    ‘‘আল্লাহ ইচ্ছা করেন তোমাদের কাছে বিশদভাবে বিবৃত করতে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি তোমাদেরকে অবহিত করতে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করতে চান, আর যারা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা চায় যে, তোমরা ভীষণভাবে পথচ্যুত হও’’[43]

    ﴿مَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيَجۡعَلَ عَلَيۡكُم مِّنۡ حَرَجٖ وَلَٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمۡ﴾ [المائ‍دة:٦]

    ‘‘আল্লাহ তোমাদেরকে কষ্ট দিতে চান না, বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান...’’[44]

    এ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে আরো রয়েছে - নির্ধারণ করে দেয়া, ফরয করা, হুকুম দেয়া, নির্দেশ প্রদান করা, অনুমতি দেয়া, হারাম করা ইত্যাদি। যেমন আল্লাহ বলেন,

    ﴿ ۞وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ ﴾ [الاسراء: ٢٣]

    ‘‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদাত না করতে এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে’’[45]

    ﴿ذَٰلِكُمۡ حُكۡمُ ٱللَّهِ يَحۡكُمُ بَيۡنَكُمۡۖ ﴾ [الممتحنة : ١٠]

    ‘‘এটাই আল্লাহর বিধান। তিনি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করে থাকেন’’[46]

    ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ ﴾ [البقرة: ١٨٣]

    ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে’’[47]

    ﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُ بِٱلۡعَدۡلِ وَٱلۡإِحۡسَٰنِ ﴾ [النحل: ٩٠]

    ‘‘আল্লাহ নির্দেশ প্রদান করছেন ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচারণের...’’।[48]

    এ সকল বক্তব্যের মধ্যে আরো রয়েছে - কল্যাণকর, অকল্যাণকর কিংবা উপকারী বা ক্ষতিকর অথবা প্রিয় বা অপ্রিয় বলে উল্লেখ করা। যেমন আল্লাহ বলেন,

    ﴿ وَأَن تَصُومُواْ خَيۡرٞ لَّكُمۡ ﴾ [البقرة: ١٨٤]

    ‘‘আর সাওম পালন তোমাদের জন্য উত্তম’’[49]

    ﴿ فَإِن كَرِهۡتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَيَجۡعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيۡرٗا كَثِيرٗا ١٩ ﴾ [النساء : ١٩]

    ‘‘তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর তবে এমন হতে পারে যে, তোমরা কিছু অপছন্দ করছ অথচ আল্লাহ তাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন’’[50]

    ৫. নির্দেশ দান বা নিষেধ করার বাস্তব কারণ থাকা সত্ত্বেও তা না করে শারীয়াহ্ প্রণেতার চুপ থাকা। যদি প্রয়োজনীয় কার্যকারণ থাকা সত্বেও শারীয়াহ্-এর নির্দেশ না আসে তাহলে বুঝতে হবে উক্ত কাজে শারীয়াহ্-এর অনুমোদন নেই। আবার নিষেধ করার যথার্থ কারণ ও উপলক্ষ থাকা সত্ত্বেও যদি শারীয়াহ্ কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত না হয়, তাহলে বুঝতে হবে কাজটি শারীয়াহ্-এর দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ নয়।

    মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ এর প্রকরণসমূহ

    আমরা জানি ইসলামী শারীয়াহ্-এর প্রতিটি বিধানেরই রয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য। শারীয়াহ্-এর এ সকল মাকাসিদ ও উদ্দেশ্যকে তিনটি প্রকরণে ভাগ করা যায়, যার প্রত্যেকটিতে রয়েছে আলাদা আলাদা প্রকারভেদ[51]

    প্রথম প্রকরণঃ মৌলিকত্বের দিক থেকে মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ দু’ প্রকারঃ

    1. মৌলিক মাকাসিদঃ এ দ্বারা শারীয়াহ্-এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ও মাকাসিদ বুঝানো হয়েছে অর্থাৎ শরীয়ত প্রণেতা কোনো নির্দেশ দ্বারা প্রথম যে উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেছেন তা বুঝানো হয়েছে। যেমন, সালাত আদায়ের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য, স্মরণ এবং অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে মুক্তি।

    2. গৌণ ও আনুষাঙ্গিক মাকাসিদঃ যে সব মাকাসিদ মৌলিক মাকাসিদের সাথে কিংবা পরে অর্জিত হয় সেগুলো হচ্ছে গৌণ ও আনুষাঙ্গিক মাকাসিদ। যেমন, সালাত আদায়ের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক প্রশান্তি লাভ, অযুর মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতা অর্জন ইত্যাদি।

    দ্বিতীয় প্রকরণঃ ব্যাপকতার দিক থেকে মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ তিন প্রকারঃ

    1. ব্যাপক মাকাসিদঃ ইসলামী শারীয়াহ্-এর সকল ক্ষেত্রে ও সকল অধ্যায়ে যে সকল মাকাসিদ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ব্যাপক মাকাসিদ। যেমন,

    (ক) মাসালিহ তথা কল্যাণ সাধন এবং মাফাসিদ তথা অকল্যাণ ও ক্ষতি প্রতিহতকরণ।

    (খ) সহজীকরণ ও কঠোরতা বিলোপ ইত্যাদি।

    2. নির্দিষ্ট মাকাসিদঃ শারীয়াহ্ এর নির্দিষ্ট অধ্যায় ও বিষয়ভিত্তিক যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় নির্দিষ্ট বা খাস মাকাসিদ। যেমন, সালাতের উদ্দেশ্য, সাওম ও হাজ্জের বিশেষ উদ্দেশ্য ইত্যাদি।

    3. ক্ষুদ্র মাকাসিদঃ শারীয়াহ্-এর যে সকল মাকাসিদ শুধুমাত্র কোন একটি নির্দিষ্ট মাসআলার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় ক্ষুদ্র মাকাসিদ। যেমন, অযুর সময় নাকে পানি দেয়ার উদ্দেশ্য কিংবা সালাতে রুকু আদায়ের উদ্দেশ্য ইত্যাদি।

    তৃতীয় প্রকরণঃ মাসালিহ বা মানব কল্যাণ সাধনের যে উদ্দেশ্যে শারীয়াহ্ প্রণীত হয়েছে সে দিক থেকে মাকাসিদ তিন প্রকার :

    1. মানব জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ (আদ্-দারুরিয়্যাত)

    2. মানব জীবনের প্রয়োজনসমূহ (আল-হাজিয়্যাত)

    3. মানব জীবনের শোভাবর্ধনকারী বিষয়সমূহ (আত-তাহসীনীয়্যাত)

    মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ এর দৃষ্টিতে মানব জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ (আদ্-দারুরিয়্যাত)

    মহান রাববুল আ’লামীন মানব জাতির সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্যই ইসলামী শারীয়াহ্ এর সকল বিধান প্রণয়ন করেছেন। মানব জীবনের সর্বাধিক জরুরী বিষয়সমূহের সংরক্ষণ ও হেফাযত সে বিধানেরই এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসলামী শারীয়াহ্ এর পরিভাষায় এ বিষয়সমূহের নাম দেয়া হয়েছে ‘আদ-দারুরিয়্যাত’।

    ‘আদ-দারুরিয়্যাত’ এর সংজ্ঞাঃ

    ইমাম শাতিবী রহ্. এর সংজ্ঞায় বলেন, ‘‘আদ-দারুরিয়্যাত হচ্ছে দীন ও দুনিয়ার সে সকল অত্যাবশকীয় বিষয়সমূহ যার অনুপস্থিতিতে দুনিয়ার কল্যাণের সঠিক গতিধারা ব্যাহত হয়, বরং এ ক্ষেত্রে দেখা দেয় বিপর্যয়, সীমাহীন ক্ষতি ও প্রাণ হারানোর ঘটনা। আর আখিরাতে নাজাত ও নেয়ামত লাভ হয় সুদূর পরাহত এবং সুস্পষ্ট ক্ষতিতে লিপ্ত হওয়া হয়ে ওঠে অবধারিত’’[52]

    প্রখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত আল-মুহাল্লী বলেন, ‘‘যে সব বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা জরুরী পর্যায়ে পড়ে, সেগুলোই হচ্ছে আদ-দারুরিয়্যাত’’[53]

    ‘আদ-দারুরিয়্যাত’এর বিষয়সমূহঃ

    ‘আদ-দারুরিয়্যাত’ পাঁচটি[54]। সেগুলো হল :

    • দীনের হেফাযত
    • জীবনের হেফাযত
    • আকল বা বিবেকের হেফাযত
    • বংশধারা ও ইজ্জতের হেফাযত
    • সম্পদের হেফাযত

    এ পাঁচটি বিষয়কে বলা হয় আল-মাকাসিদ আল-খামসাহ্ বা শারীয়াহ্-এর পাঁচটি উদ্দেশ্য। এগুলো ছাড়া পৃথিবীতে মানব জীবন কোনোভাবেই চলতে পারে না। আর এ জন্যই দীন, জীবন, আকল, সম্পদ এবং বংশধারা ও ইজ্জতের হেফাযত ইসলামী শারীয়াহ এর একটি মৌলিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এ পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দীন, তারপর মানুষের জীবন, আকল, বংশধারা ও ইজ্জত এবং সর্বশেষে সম্পদ।

    নিচে দলীলসহ এ পাঁচটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হলঃ

    প্রথম বিষয়ঃ দীনের হেফাযত

    দীনকে সচরাচর আমরা ধর্ম বলে থাকি। যদিও আল-কুরআনে ‘দীন’ বলতে নিছক ধর্ম বুঝানো হয় নি। আল-কুরআনের ‘দীন’ মানব জীবনের প্রতিটি বিষয়ে সমাধান প্রদান করে থাকে। সেখানে মানুষের সামগ্রিক জীবনই থাকে দীনের গণ্ডিভূত। ধর্মীয় জীবন সেখানে মানুষের পুরো জীবন থেকে বিচ্ছন্ন কোনো অংশ নয়।

    মানুষ স্বভাবতই কোন না কোন ধর্মের অনুসারী হয়ে থাকে, চাই সে ধর্ম সত্য হোক বা বাতিল হোক। এর বাইরে অবস্থান রয়েছে খুবই কম মানুষের। এখানে দীন বলতে যে কোনো ধর্মকে বুঝানো হয় নি, বরং সে সত্য দীনকে বুঝানো হয়েছে যা মহান রাববুল ‘আলামীনের কাছ থেকে অবতীর্ণ তথা ইসলাম। কেননা মানব রচিত কোন ধর্ম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, আবার অন্যান্য আসমানী দীনসমূহ সর্বশেষ দীন ইসলাম দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। মহান আল্লাহ বলেন,

    ﴿ إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ ﴾ [ال عمران: ١٩]

    ‘‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন হচ্ছে ইসলাম’’[55]

    ﴿ وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥ ﴾ [ال عمران: ٨٥]

    ‘‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন অনুসন্ধান করে, আল্লাহ কখনোই তার কাছ থেকে তা কবুল করবেন না। সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’’[56]

    দীনের হেফাযতের উপায় ও পন্থাঃ

    মহান আল্লাহ নিজেই এ দীনকে হেফাযতের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

    ﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [الحجر: ٩]

    ‘‘নিশ্চয়ই আমি এ যিক্‌র নাযিল করেছি এবং আমিই তার হেফাযতকারী’’[57]। যিক্‌র বলতে এ আয়াতে কুরআন, সুন্নাহ এবং দীন সবকিছুকেই বুঝানো হয়েছে। দীনকে হেফাযতের জন্য আল্লাহ যে সকল পন্থা ও উপায় অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন তা হচ্ছেঃ

    1. দীনের নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করাঃ

    আল্লাহ এ দীন প্রণয়ন করেছেন সে অনুযায়ী আমল করার জন্য, দীনের কিছু বচন ও উক্তি হেফাযত করার জন্য শুধু নয়। কেননা দীন হচ্ছে আকীদা-বিশ্বাস ও আমলের সমন্বয়। আকীদা হচ্ছে দীনের মূল, আর আমল ছাড়া দীনের সুফল কোনো মতেই পাওয়া যাবে না। প্রত্যেক মুসলিম বাস্তব জীবনে দীনকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলে অচিরেই তার সুফল দেখতে পাবে। অতএব দীনের সুরক্ষার জন্য সে অনুযায়ী আমল করা অত্যন্ত জরুরী। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা মানুষের উপর সালাত, সাওম, হজ্জ ও যাকাতসহ আরো অনেক আমল ফরয করেছেন।

    দীন অনুযায়ী আমলের একটা সর্বনিম্ন সীমা রয়েছে যা অতিক্রম করার অনুমতি কাউকে দেয়া হয় নি। তা হচ্ছে ফরয-ওয়াজিব মেনে চলা এবং হারাম পরিত্যাগ করা। ড. আবদুল্লাহ আহমাদ আল-কাদরী বলেন, ‘‘এ থেকেই আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের প্রত্যেক ব্যক্তির উপর একটি সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন যদ্বারা দীনের সুরক্ষা হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে ফরযে আ’ইন যা পালন থেকে কেউই অব্যাহতি পায় না যতক্ষণ পর্যন্ত শারীয়াহ্-এর অর্পিত দায়িত্ব পালনের বুদ্ধিগত সামর্থ ও কার্যে পরিণত করার বাস্তব সক্ষমতা তার থাকে। এর উদাহরণ হচ্ছে, ঈমান ও ইসলামের মূলভিত্তিসমূহ। আল্লাহ প্রত্যেককেই ঈমান ও ইসলাম অনুযায়ী আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন...’’[58]

    দীনের আমল মানুষের জীবনে সত্যিকার অর্থে ফলপ্রসূ ও প্রভাবশালী করার জন্য প্রয়োজন এগুলোকে আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত পন্থায় পালন করা। এভাবে আমল করতে পারলেই তা হবে প্রকৃত দীন। কিন্তু যখনই বাস্তবায়নে ত্রুটি দেখা দেবে এবং প্রকৃত দীন ও আমলে পার্থক্য সূচিত হবে তখন এ আমলকারীকে প্রকৃত দীনের অনুসারী আমলদার হিসাবে গণ্য করা হবে না। এখান থেকেই আমরা মুসলিম ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য উপলদ্ধি করতে পারি। কেননা মুসলিমদের কাজ কখনো ঠিক হতে পারে কখনো ভুল হতে পারে, কখনো হক ও কখনো বাতিল হতে পারে, কিন্তু ইসলাম শুধুই হক ও সত্যাশ্রয়ী, এতে বাতিল থাকার কোনই সম্ভাবনা নেই। ফলে আজকের মুসলিমদের কাজকর্ম দীনের বিরুদ্ধে কোনো দলীল হতে পারে না বরং প্রকৃত দীনের আলোকেই সকলের কর্মধারা যাচাই করা হবে।

    2. দীনের নির্দেশনা অনুযায়ী যাবতীয় হুকুম পরিচালনাঃ

    দীনের নির্দেশনা অনুযায়ী যাবতীয় হুকুম পরিচালনা দীনের হেফাযতের একটি অন্যতম জরুরী পন্থা। কেননা দীনই যদি হুকুম পরিচালনার মূল অথরিটি না হয় তাহলে সে দীন কিভাবে হেফাযত করা সম্ভব? দীনের হেফাযতের অর্থ শুধু কাগজে-কলমে কিংবা কিতাবে একে সংরক্ষণ করা নয়। বরং মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে দীনের নির্দেশ মেনে চলাই হচ্ছে দীনের সবচেয়ে বড় হেফাযত[59]

    এদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, দীনকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর অবতারিত নির্দেশ ও গ্রন্থ ছাড়া অন্য আইন দ্বারা হুকুম পরিচালনা করার মানে দাঁড়ায় আল্লাহর দীন ও হুকুমের স্থলে মানব প্রবৃত্তি ও মতবাদকে সেখানে স্থলাভিষিক্ত করা। দীনকে ধ্বংস করার জন্য এর চেয়ে আর বড় কোনো পন্থা আছে কি?? এবং দীনের বিরুদ্ধে কৃত এর চেয়েও বড় কোনো অপরাধ আছে কি??

    মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥ ﴾ [النساء : ٦٥]

    ‘‘কখনোই নয়, আপনার রবের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদে আপনাকে হুকুমদাতা হিসাবে স্থির করে, অতপর আপনি যে ফয়সালা করে দেন তাতে নিজেদের মনে কোনরূপ দ্বিধা না রেখে পুরোপুরি মেনে নেয়’’[60]

    ﴿ وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ ٤٤ ﴾ [المائ‍دة: ٤٤]

    ‘‘যারা আল্লাহর অবতারিত বিধান অনুযায়ী হুকুম প্রদান করে না তারা কাফির’’[61]

    3. দীনের প্রতি মানুষকে আহ্বান করাঃ

    দীনের প্রতি আহবান মূলত নবী ও রাসূলগণেরই সুমহান কাজ। এ দায়িত্ব পালনের জন্যই তারা জীবনভর সংগ্রাম করেছেন, কষ্ট করেছেন এবং সকল বিপদে-আপদে চরম ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে দাওয়াত ও আহবানের এ মহান দায়িত্ব পালন ব্যতীত কোনো দীনকে প্রতিষ্ঠিত করা ও প্রসারিত করা সম্ভব নয়।

    দেখা যায়, অনেকে তাদের নিজ নিজ মতবাদ বাতিল হওয়া সত্বেও অন্যদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য বিভিন্ন পন্থায় তা প্রচার ও বর্ণনার কাজে লিপ্ত হয়। ইসলামের শত্রুরাও আজ ইসলামকে বিকৃতভাবে প্রচারের জন্য উঠে পড়ে লেগে গেছে। তাহলে মহান আল্লাহর দেয়া সত্যকে প্রচারের জন্য এবং বিশেষ করে একে শত্রুদের বিকৃতি থেকে রক্ষা করার জন্য দাওয়াতী পন্থার আশ্রয় নেয়া মুসলিমদের উপর অত্যন্ত জরুরী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٠٤ ﴾ [ال عمران: ١٠٤]

    ‘‘তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। তারাই হবে সফলকাম’’[62]

    ﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ ﴾ [ال عمران: ١١٠]

    ‘‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মাত মানব জাতির জন্য যাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ প্রদান করবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে ও আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে’’[63]

    ﴿ وَٱدۡعُ إِلَىٰ رَبِّكَۖ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ٨٧ ﴾ [القصص: ٨٧]

    ‘‘আর আপনার প্রভুর প্রতি আহবান করুন এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না’’[64]। ‘‘আপনার প্রভূর পথের দিকে হিকমাত ও উত্তম উপদেশ সহকারে আহবান করুন’’[65]

    ﴿ قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا۠ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِيۖ ﴾ [يوسف: 108]

    ‘‘বলুন, এটাই আমার পথ। আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি আহবান করি জেনেশুনে - আমি ও আমার অনুসারীগণ..’’[66]

    4. জিহাদ ফি সাবীলিল্লাহঃ

    দীনকে হেফাযতের একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে আল্লাহর পথে জিহাদ। জিহাদ একটি ব্যাপকার্থক শব্দ। ব্যাপকার্থে জিহাদ আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সাথে সম্পর্কিত সকল কর্মকাণ্ডকেই বুঝায়। এ হিসাবে আল্লাহর দীনের প্রতি দাওয়াত ও আহবান জিহাদের প্রাথমিক অধ্যায়। আর বিশেষ অর্থে আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার জন্য, ইসলাম ও মুসলিমদেরকে ইসলামের শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ও ইসলামকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য উলীল আমরের নেতৃত্বে যে যুদ্ধ হয়ে থাকে তাকে জিহাদ বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ إِنَّ ٱللَّهَ ٱشۡتَرَىٰ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ أَنفُسَهُمۡ وَأَمۡوَٰلَهُم بِأَنَّ لَهُمُ ٱلۡجَنَّةَۚ يُقَٰتِلُونَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيَقۡتُلُونَ وَيُقۡتَلُونَۖ ﴾ [ال عمران: ١٤٢]

    ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের নিকট হতে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, বিনিময়ে তাদের জন্য আছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, নিধন করে ও নিহত হয়’’[67]

    5. দীন বিরোধী সকল কথা ও কাজ প্রতিরোধ করাঃ

    এটিও মূলত জিহাদের ব্যাপকার্থের অন্তর্গত। দীনের হেফাযতের জন্য এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিধায় একে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হল। কেননা যদি দীন বিরোধী বাতিল কথা, বিভ্রান্ত আকীদা, ভ্রষ্ট চিন্তাধারা এবং ক্ষতিকর মতবাদসমূহকে কোনো প্রকার বাদ-প্রতিবাদ ছাড়াই মুসলিমদের চিন্তাজগতে আঘাত হানার সুযোগ করে দেয়া হয়, তাহলে দীনের মৌলিক ধারণা লোপ পেতে থাকবে, সত্যকে বাতিল ও মিথ্যার সাথে গুলিয়ে ফেলা হবে। ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে দীন হতে মানুষ সরে যেতে থাকবে। তা যেন না হয় সেজন্য অতীতে যেমন বহু আলেম দীন সম্পর্কে সকল বিভ্রান্তি ও সংশয় অপনোদনের জন্য কলম ধরেছিলেন এবং সত্যের পক্ষে বাকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন, বর্তমানেও তেমনি মুসলিম স্কলারগণ বিভিন্ন ভাবে কাজ করছেন।

    দ্বিতীয় বিষয়ঃ জীবনের হেফাযত

    মানব জীবনের হেফাযতের জন্য ইসলাম খুব বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছে। জীবনের সুরক্ষার জন্য এবং জীবনকে সকল ক্ষতি ও বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ইসলামে প্রণীত হয়েছে বহু হুকুম-আহকাম ও দেয়া হয়েছে অনেক বিধান। জীবনের হেফাযতের উপায় হিসাবে বিবেচিত এ বিধানের মধ্যে রয়েছেঃ

    1. মানুষের জীবনের উপর চড়াও হওয়া হারাম।
    2. হত্যার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী সকল উপায়-উপকরণ নিষিদ্ধ।
    3. কিসাস (হত্যার শাস্তি) নির্দ্ধারণ।
    4. কোনো ব্যক্তি নিহত হলে হত্যাকারীর বিরুদ্ধে শাস্তি কার্যকর করার জন্য তার অপরাধ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করা, যাতে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তি হত্যার শাস্তি না পায়।
    5. আক্রান্ত হওয়ার কারণে জীবনের যে সকল ক্ষতি হয়ে থাকে তার ক্ষতিপূরণ দিতে আক্রমণকারীর বাধ্য থাকা।
    6. কিসাসের শাস্তি ক্ষমা করার বিধান।
    7. জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে জরুরী অবস্থায় নিষিদ্ধ বস্তু ভক্ষণের অনুমতি।

    তৃতীয় বিষয়ঃ আকল বা বিবেকের হেফাযত

    আকল বা বিবেক মানুষকে দেয়া আল্লাহর একটি বিশাল নেয়ামত। মূলত আকলের মাধ্যমেই মানুষকে আর সব প্রাণীর উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এবং এর কারণেই মানুষকে তিনি শারীয়াহ্ অনুসরণের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আকল বা বিবেককে সকল বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার গুরুত্ব সকল যুগে সকল শারীয়াহ্ এর মধ্যেই ছিল। আল-কুরআনে মহান আল্লাহ বার বার বিবেক সম্পন্ন লোকদের সম্বোধন করেছেন এবং বিবেকবান লোকেদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলী নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন।

    ইসলামে দু’ভাবে আকলকে হেফাযত করার দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছেঃ

    1. আকল নষ্টকারী বাহ্যিক উপকরণসমূহ থেকে একে হেফাযতে রাখা। এ সব উপকরণের মধ্যে রয়েছে মদ, ড্রাগ, হিরোইন ও নেশাগ্রস্তকারী অন্যান্য মাদকদ্রব্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡخَمۡرُ وَٱلۡمَيۡسِرُ وَٱلۡأَنصَابُ وَٱلۡأَزۡلَٰمُ رِجۡسٞ مِّنۡ عَمَلِ ٱلشَّيۡطَٰنِ فَٱجۡتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٩٠ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱلشَّيۡطَٰنُ أَن يُوقِعَ بَيۡنَكُمُ ٱلۡعَدَٰوَةَ وَٱلۡبَغۡضَآءَ فِي ٱلۡخَمۡرِ وَٱلۡمَيۡسِرِ وَيَصُدَّكُمۡ عَن ذِكۡرِ ٱللَّهِ وَعَنِ ٱلصَّلَوٰةِۖ فَهَلۡ أَنتُم مُّنتَهُونَ ٩١ ﴾ [المائ‍دة: ٩٠، ٩١]

    ‘‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর যাতে তোমরা সফল হতে পার। শয়তান তো মদ জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’’[68]

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

    «كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ، وَكُلُّ خَمْرٍ حَرَامٌ»

    ‘‘নেশা সৃষ্টিকারী সকল বস্তুই মদ এবং সকল মদই হারাম’’[69]। তিনি আরো বলেন,

    وَلَا يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ

    ‘‘কোন ব্যক্তি ঈমানদার অবস্থায় মদ পান করতে পারে না’’[70]

    অন্যত্র তিনি বলেন,

    «مَا أَسْكَرَ كَثِيرُهُ فَقَلِيلُهُ حَرَامٌ»

    ‘‘যা বেশী পরিমাণে পান করলে নেশাগ্রস্ত হয়, তা কম পরিমাণে পান করাও হারাম’’[71]

    2. আকল নষ্টকারী আভ্যন্তরীন উপকরণসমূহ থেকে একে হেফাযতে রাখা। এ সবের মধ্যে রয়েছে দীন, সমাজ, রাজনীতি প্রভৃতি ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণা যা আকলকে বিভ্রান্ত করে এবং শরীয়তের আলোকে সঠিক চিন্তাধারা থেকে আকলকে অকার্যকর করে রাখে। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে কাফিরদের নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। কারণ তারা কুরআনের আয়াতসমূহ ও আল্লাহর অন্যান্য নিদর্শন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার ব্যাপারে নিজেদের আকলকে কোন কাজে লাগায় নি। ফলে তারা সত্যপথের দিশা লাভ করে নি। আল্লাহ বলেন,

    ﴿ أَمۡ تَحۡسَبُ أَنَّ أَكۡثَرَهُمۡ يَسۡمَعُونَ أَوۡ يَعۡقِلُونَۚ إِنۡ هُمۡ إِلَّا كَٱلۡأَنۡعَٰمِ بَلۡ هُمۡ أَضَلُّ سَبِيلًا ٤٤ ﴾ [الفرقان: ٤٤]

    ‘‘তুমি কি মনে কর যে, তাদের অধিকাংশ শোনে ও বোঝে? তারা তো পশুর মতই; বরং তারা অধিক পথভ্রষ্ট’’[72]

    ﴿ وَجَعَلۡنَا لَهُمۡ سَمۡعٗا وَأَبۡصَٰرٗا وَأَفۡ‍ِٔدَةٗ فَمَآ أَغۡنَىٰ عَنۡهُمۡ سَمۡعُهُمۡ وَلَآ أَبۡصَٰرُهُمۡ وَلَآ أَفۡ‍ِٔدَتُهُم مِّن شَيۡءٍ إِذۡ كَانُواْ يَجۡحَدُونَ بِ‍َٔايَٰتِ ٱللَّهِ ﴾ [الاحقاف: ٢٦]

    ‘‘আমি তাদেরকে দিয়েছিলাম কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর, কিন্তু তাদের কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর তাদের কোনো কাজে আসে নি। কেননা তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছিল’’[73]

    অতএব আকলকে সত্যের পথে পৌঁছার জন্য কাজে লাগানো উচিত এবং আকল বিনষ্টকারী সকল বিষয় থেকে একে হেফাযতের ব্যবস্থা করা উচিত।

    চতুর্থ বিষয়ঃ বংশধারার হেফাযত

    বংশধারার হেফাযত জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এর মাধ্যমেই পৃথিবীতে মানুষ বহুকাল ধরে বেঁচে আছে এবং থাকবে। এতেই নিহিত রয়েছে জাতির শক্তি, মান ও মর্যাদা। ইসলাম বংশধারা রক্ষার প্রতি সর্বাত্মক গুরুত্ব আরোপ করেছে। আর এজন্য নিম্নলিখিত উপায় ও পন্থা অবলম্বন করেছেঃ

    1. বংশবৃদ্ধির বৈধ পন্থা হিসাবে বিবাহের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ।

    2. জন্মদানে সক্ষম নারীকে বিবাহ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান।

    পঞ্চম বিষয়ঃ সম্পদের হেফাযত

    সম্পদ বলতে এখানে মানুষের জীবনে যে সকল বস্তু ও টাকা পয়সার প্রয়োজন সে সবকেই বুঝানো হয়েছে[74]। সম্পদ ছাড়া মানুষের পার্থিব জীবন কোন মতেই চলতে পারে না। ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও উম্মাহ্ (জাতি) - সকলেরই প্রয়োজন সম্পদের। ব্যক্তি পর্যায়ে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান, যা ছাড়া একদিনও গুজরান করা সম্ভব নয়। জনগোষ্ঠী ও উম্মাহর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ব্যক্তির দারিদ্রের প্রভাব সমগ্র উম্মাহর উপর পড়ে। এভাবে বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র দেখা দিলে উম্মাহও সংকটাপন্ন হয় এবং মান মর্যাদা হারায়। তদুপরি শত্রুর হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের জন্য প্রয়োজন অর্থ ও সম্পদের। আল্লাহ বলেন,

    ﴿ وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم مِّن قُوَّةٖ وَمِن رِّبَاطِ ٱلۡخَيۡلِ تُرۡهِبُونَ بِهِۦ عَدُوَّ ٱللَّهِ وَعَدُوَّكُمۡ ﴾ [الانفال: ٦٠]

    ‘‘তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে, যদ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে ও তোমাদের শত্রুকে...’’[75]

    এভাবে প্রয়োজনীয় সম্পত্তির ব্যবস্থা হলেই শুধু উম্মাহ্ তার শত্রুদের মুখাপেক্ষিতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। কেননা আজকের বিশ্ব-ব্যবস্থায় এটা স্পষ্ট যে, দরিদ্র জাতি ও দরিদ্র রাষ্ট্র শত্রুদের নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয় এবং এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে শত্রুরা সে জাতি ও রাষ্ট্রের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা যেমন চালায়, তেমনি তাদের মধ্যে নিজেদের সংস্কৃতি, মতবাদ ও ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারার প্রসার ঘটায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি জলজ্যান্ত ও বাস্তব।

    সুতরাং ইসলামে সম্পত্তির হেফাযতের গুরুত্ব অত্যন্ত প্রকট। ইসলামী শারীয়াহ্-এর দৃষ্টিতে সম্পদ অর্জন ও তা সঠিকভাবে হেফাযতের জন্য নিম্নবর্ণিত উপায় ও পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছেঃ

    1. হালাল পন্থায় সম্পদ অর্জনে উদ্বুদ্ধকরণ।

    2. কারো সম্পদের উপর চড়াও হওয়া হারাম ঘোষণা।

    3. সম্পদ বিনষ্ট করা কিংবা অপচয় করা হারাম ঘোষণা।

    4. সম্পদের সুরক্ষার জন্য শারীয়াহ্ কর্তৃক চুরি ও ডাকাতির শাস্তি নির্ধারণ।

    5. বিনষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত সম্পত্তির জামানাত ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান।

    6. সম্পদ রক্ষার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার বৈধতা।

    7. ঋণ প্রদানের সময় সাক্ষী রাখা ও এর লিখিত কাগজপত্র করা।

    কুড়ানো সম্পদ মালিকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।

    মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ এর দৃষ্টিতে মানব জীবনের প্রয়োজনসমূহ (আল-হাজিয়্যাত) ও শোভাবর্ধনকারী বিষয়সমূহ (তাহ্-সিনিয়্যাত)

    মানব জীবনের প্রয়োজনসমূহ (আল-হাজিয়্যাত):

    জরুরী বিষয়গুলো দিয়ে মানব জীবনের সকল চাহিদা মেটে না। জীবনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করার জন্য তার প্রয়োজন আরো অনেক কিছু। এগুলো হল আল-হাজিয়্যাত। ইমাম শাতিবী রহ্ এর সংজ্ঞায় বলেন, ‘তা হল সে সকল বিষয়, মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ আনয়নের জন্য এবং কঠোরতা, সমস্যা ও অসুবিধা দূরীভূত করার জন্য যা প্রয়োজন। এ বিষয়গুলোর প্রতি যদি বিশেষ নজর দেয়া না হয় তাহলে সাধারণভাবে বান্দার উপর সমস্যা ও অসুবিধা আরোপিত হয়, তবে তা জনকল্যাণের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বিপর্যয় সৃষ্টির পর্যায়ে পড়ে না’[76]

    আল-হাজিয়্যাত এর হেফাযতের জন্য ইসলামী শারীয়াহ্ নিম্নলিখিত উপায় অবলম্বন করেছেঃ

    1. ইবাদাতের ক্ষেত্রে উদ্ভূত অসুবিধাসমূহ উঠিয়ে নিয়েছে, যা সচরাচর মানুষের পক্ষে মানিয়ে নেয়া কষ্টকর। আল্লাহ বলেন,

    ﴿ وَمَا جَعَلَ عَلَيۡكُمۡ فِي ٱلدِّينِ مِنۡ حَرَجٖۚ ﴾ [الحج : ٧٨]

    ‘‘আর তিনি দীনের মধ্যে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নি’’[77]

    ﴿ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]

    ‘‘আল্লাহ তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করতে চান না...’’[78]

    এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ইবাদাতে রুখসাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন অসুস্থ ও মুসাফির ব্যক্তির জন্য রমযানে সাওম ভঙ্গের রুখসাত ও অনুমতি রয়েছে। এছাড়াও মুসাফির ব্যক্তির জন্য সফরে কসর সালাত আদায়ের বিধান রাখা হয়েছে। এ রকম রুখসাত শারীয়ায় আরো অনেক রয়েছে।

    2. মানুষ যাতে স্বাচ্ছন্দের সাথে জীবন যাপন করতে পারে সেজন্য অন্ন, বস্ত্র ও সংস্থান হিসাবে নানা প্রকার অসংখ্য পবিত্র বস্তুও ব্যবহার তাদের জন্য বৈধ করে দেয়া হয়েছে।

    3. মুয়ামিলাতের ক্ষেত্রে ইজারাহ, বাই’ সালাম, মুদারাবাহ প্রভৃতি ব্যবসায় পদ্ধতি জায়েয করা হয়েছে।

    জীবনের শোভাবর্ধনকারী বিষয়সমূহ (তাহ্-সিনিয়্যাত) :

    তাহ‌-সিনিয়্যাত হচ্ছে যা জরুরত ও প্রয়োজনীয়তার পর্যায়ে পড়ে না। বরং তা শোভাবর্ধনকারী সৌন্দর্যের পর্যায়ে পড়ে। এর সংজ্ঞায় বলেন ইমাম শাতিবী রহ, ‘যা উত্তম বলে বিবেচিত তা গ্রহণ করা এবং সুস্থ সবল বিবেক ঘৃণা করে এমন সব নিকৃষ্ট জিনিস পরিহার করা..’’[79]

    তাহ্-সিনিয়্যাত এর উদাহরণঃ

    1. সুন্দর খাবার গ্রহণ ও সুন্দর পোষাক পরিধান।

    2. শরীর ও পোষাক হতে নাজাসত, ময়লা উত্যাদি দূর করা।

    3. শারীয়াহ্ এর সুন্নাত ও মুস্তাহাব পর্যায়ের কাজসমূহ।

    4. সকল প্রকার শিষ্টাচারিতা।

    5. বৈধ বিলাসী সামগ্রীর ব্যবহার।

    মাকাসিদ আশ-শারীয়াহ্ এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইনী রীতি-নীতি

    মাকাসিদ আশ-শারীয়াহ্ এর আলোকে আলেমগণ সংক্ষিপ্ত ও সুন্দর বেশ কিছু আইনী রীতি-নীতি পেশ করেছেন, যার উপর ভিত্তি করে ইসলামী আইন বিষয়ক অনেক বিধান সহজেই উদ্ভাবন করা যায়। নিচে উদাহরণস্বরূপ অল্প কিছু উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে।

    1. মাকাসিদ আশ-শারীয়াহ্ বা ইসলামী শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য জানা যাবে কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা’ দ্বারা[80]

    2. যা দ্বারা পাঁচটি জরুরী বিষয়ের হেফাযত সম্পন্ন হবে, তা মাসলাহা ও কল্যাণ বলে গণ্য হবে এবং যা দ্বারা উক্ত পাঁচটি বিষয়ের ক্ষতি সাধিত হবে তা মাফসাদা বা অকল্যাণ বলে গণ্য হবে[81]

    3. যখন দু’টো মন্দ বা ক্ষতি পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে, এমনভাবে যে, এর যে কোন একটি মোকবেলা করতেই হবে, তাহলে শারীয়াহ্ প্রণেতার উদ্দেশ্য ও ইচ্ছা হল অধিকতর ক্ষতিকে প্রতিরোধ করা[82]

    4. শারীয়াহ্ প্রণেতার উদ্দেশ্য ও ইচ্ছা হচ্ছে নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে সকল কঠোরতা ও অসুবিধা বিলোপ করা[83]

    5. নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কঠোরতা ও অসুবিধা বজায় থাকবে[84]

    6. কোন কাজের নির্দেশ প্রদানের অর্থই হচ্ছে শারীয়াহ্ প্রণেতা চান সে কাজ বাস্তবায়িত হোক, এবং কোন কাজ থেকে নিষেধ করার অর্থই হল শারীয়াহ্ প্রণেতা চান সে কাজ বাস্তবায়িত না হোক[85]

    7. শারীয়াহ্ প্রণেতা কোন কাজের প্রশংসা করার দ্বারা বোঝা যায় যে, তিনি চান সে কাজ বাস্তবায়িত হোক[86]

    8. সামষ্টিক কল্যাণ ব্যক্তি কল্যাণের উপর প্রধান্য পাবে[87]

    9. মৌলিক কল্যাণ গৌণ ও আনুষাঙ্গিক কল্যাণের উপর প্রাধান্য পাবে[88]

    10. কল্যাণ অর্জনের আগে অকল্যাণ দূর করা শারীয়াহ্ প্রণেতার দৃষ্টিতে অগ্রগণ্য[89]

    মাকাসিদ আশ-শারীয়াহ্ ও ইজতিহাদ

    ইমাম শাতেবীর মতে মুজতাহিদের জন্য মাকাসিদের জ্ঞান থাকা শর্ত। কেননা মাকাসিদ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে ইজতিহাদ ভুল-ভ্রান্তিতে পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী[90]। আল্লামা তাহির ইবন ‘আশূরও অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন যে, ইজতিহাদের সকল ক্ষেত্রে ইলমুল মাকাসিদ এর জ্ঞান থাকা অপরিহার্য[91]

    যে কোন বিষয়ে মুজতাহিদ হুকুম দেয়ার সময় অবশ্যই লক্ষ্য রাখবেন যে, এতে শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য কি, যাতে করে একই রকম অন্যান্য বিষয়ে অনুরূপ হুকুম প্রদান করা যায়। শারীয়াহ্ এর একটি অন্যতম দলীল কিয়াস বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মাকাসিদ এর জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে অনেক বেশী। তাছাড়া মাসালিহ মুরসালা শারীয়াহ্ সমর্থিত কিনা তা পুরোপুরি নির্ভর করে ইলমুল মাকাসিদ এর উপর।

    বর্তমান প্রেক্ষাপটে মাকাসিদ আশ-শারিয়াহ্ এর প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব

    বান্দার কল্যাণ সাধনে আল্লাহর যে উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে মাকাসিদ আশ-শারীয়াহ বলতে মূলত তাকেই বুঝানো হয়। আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা। বান্দার পার্থিব ও পারলৌকিক প্রয়োজন পূরণই ইসলামী শারীয়াহ্ প্রণয়ণের উদ্দেশ্য। তাই মাকাসিদ আশ-শারীয়াহ্ মূলত জীবন ঘনিষ্ঠ উদ্দেশ্যেরই একরাশ সমষ্টি।

    পৃথিবীতে আল্লাহর হুকুমের বাস্তবায়ন শুধু তাঁর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব। যে লক্ষ্যে আল্লাহ মানব জাতির জন্য কালজয়ী ইসলামী আদর্শ প্রদান করেছেন, সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন না করে শুধু কতগুলো প্রথা ও Rituals পালন করা তাঁর কাছে কোন অর্থ বহন করে না। সকল নিষেধাজ্ঞার পেছনে আল্লাহর যে সব হিকমাত ও উদ্দেশ্য রয়েছে সেগুলো এক সুত্রে গাঁথা, সেগুলোতে কোন অসঙ্গতি নেই।

    কিন্তু মাকাসিদ আশ-শারীয়াহ্ না জানার কারণে আজ মুসলিমদের প্রাত্যহিক কর্মে দেখা দিয়েছে বৈসাদৃশ্য। অনেক সময় দেখা যায়, যে মুসলিম প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে আল্লাহর আনুগত্যের ঘোষণা দেয়, সে আবার তার অর্থনৈতিক লেনদেনে কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শে এই আল্লাহরই নাফরমানি করতে দ্বিধা করে না। ইসলামী শরীয়াহ এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবতার সার্বিক কল্যাণ সাধন এবং যাবতীয় অকল্যাণ থেকে সমগ্র মানবতাকে রক্ষা করা। গভীরভাবে মাকসিদ উপলব্ধি না করার কারণেই আজ মুসলিমের অনেকে ইসলামকে আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম মনে করছে। ফলশ্রুতিতে তারা ঈমান হারা হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অন্যদিকে যেহেতু এবিষয়টি আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম শিক্ষার অপরিহার্য পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত হয় নি, ফলে এ সম্পর্কিত ব্যাপক অজ্ঞানতা বিরাজ করছে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষকদের মধ্যেও। বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে যেসকল ফাতওয়া দেওয়া হয় কিংবা চাঁদ দেখা সহ আরো অন্যান্য বিষয় নিয়ে বাক-বিতণ্ডা সৃষ্টি হয় তা মাকাসিদ এর জ্ঞান না থাকার কারণেই; কেননা মাসআ’লার বিভিন্নতা ইসলামী শরীয়াহ এর মধ্যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শরীয়াহ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন। এজন্যই আমরা পূর্ববর্তী ইমাম ও স্কলারদেরকে দেখি তারা পরস্পর অনেক মতানৈক্য করেছেন, কিন্তু মাকাসিদের আলোকে তাদের মধ্যে কোন বিভেদ ছিল না। তাদের মধ্যে গবেষণা ছিল একটা অব্যাহত প্রক্রিয়া, নিজেদের কোন ভুল প্রমানিত হলেই তারা সঠিক সিদ্ধান্তের প্রতি ফিরে যেতেন।

    যারা আজ দীনের দা‘ঈ হিসেবে কাজ করছেন, ইসলামী জ্ঞান বিস্তারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তাদের জন্য এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব অনেক বেশি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁর শরীয়াহ্-এর জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে দীন পালন ও প্রসারের তাওফীক দান করুন। আমীন!

    [1] ইসমাইল ইবন হাম্মাদ আল-জাওহারী, আস-সিহাহ ৩/১২৩৬, ইবন মানযূর, লিসানুল আরব, ৮/১৭৪

    [2] লিসানুল আরব, ৮/১৭৪

    [3]ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমু’ আল-ফাতাওয়া ১৯/৩০৬

    [4] প্রাগুক্ত, ১৯/৩০৯

    [5] সূরা আল-কাসাস:৬৮

    [6] সূরা আল-মূলক:১৪

    [7] সূরা আল-আনফাল:৭১

    [8] সূরা আল-আম্বিয়া:১০৭

    [9] সূরা আল-আ’রাফ:১৫৮

    [10] সূরা সাবা:২৮

    [11] সূরা আন-নাহল:৮৯

    [12] সূরা আল-হিজর:

    [13] সূরা আল-বাকারাহ:১৮৫

    [14] সূরা আল-হাজ্জ:৭৮

    [15] সূরা আল-বাকারাহ:২৮৬

    [16] সূরা আন-নূর:৩৭

    [17] সূরা আল-জুমুআ’হ:১০

    [18] মুসনাদ ইমাম আহমাদ, হাদীস নং ২৩৭১০, ২৪৭৭১।

    [19] মাআ’লিম ফিত-তরীক, সাইয়েদ কুতুব, পৃঃ ১১১

    [20] মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হাদীস-৩৩৫৭ ও মুসনাদ আহমাদ, হাদীস-৮৯৫২

    [21] আস-সিহাহ, ২/৫২৪, লিসানুল আরব, ৩/৩৫৩, আল-মু’জাম আল-ওয়াসীত, ২/৭৩৭

    [22] মাকাসিদুশ-শারীয়াহ্ আল-ইসলামিয়াহ, ড. মুহাম্মাদ সা‘দ আল-ইয়ূবী, পৃঃ ২৩-২৪

    [23] মাকাসিদুশ শারীয়াহ্, মুহাম্মাদ তাহির ইবন ‘আশূর, পৃঃ ৫১

    [24] ইমাম শাতিবীর মাকাসিদ তত্ত্ব, ড. আহমাদ আল-রাইসূনী, পৃঃ ৭

    [25] মাকাসিদুশ-শারীয়াহ্ আল-ইসলামিয়াহ, ড. মুহাম্মাদ সা‘দ আল-ইয়ূবী, পৃঃ ৩৭

    [26]আল-মাকাসিদ আল-শারইয়াহ্, ড. নূরুদ্দীন ইবন মুখতার আল-খাদিমী, পৃঃ ৩০-৩৩

    [27] সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ : ৪২

    [28] সূরা আয্-যুমার : ১, আল-মু‘মিন : ২, আল-জাসিয়া : ২, আল-আহকাফ :

    [29] সূরা আল-আ’রাফ : ১৫৬

    [30] সূরা আল-মু‘মিনূন : ১০৯

    [31] শিফাউল আ’লীল, ইমাম ইবনুল কাইয়েম, পৃঃ ৪২৬

    [32] সূরা আল-বাকারাহ : ১৪৩

    [33] সূরা আন-নিসা : ১০৫

    [34] সূরা আর-হাজ্জ : ৭৮

    [35] সূরা ত্বহা : ১৪

    [36] সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৩

    [37] মাকাসিদুশ-শারীয়াহ্ আল-ইসলামিয়াহ, ড. মুহাম্মাদ সা‘দ আল-ইয়ূবী, পৃঃ ১২৩।

    [38] সূরা আল-বাকারাহ : ২১

    [39] সূরা আন-নাহল : ৮৯

    [40] সূরা আল-হাশর :

    [41] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫২১৫

    [42] সূরা আল-বাকারাহঃ ১৮৫

    [43] সূরা আন-নিসাঃ ২৬-২৭

    [44] সূরা আল-মায়িদাহঃ ৬

    [45] সূরা আল-ইসরা (বনী ইসরাঈল): ২৩

    [46] সূরা মুমতাহিনা : ১০

    [47] সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৩

    [48] সূরা আন-নাহলঃ : ৯০

    [49] সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৪

    [50] সূরা আন-নিসা : ১৯

    [51] মাকাসিদুশ-শারীয়াহ্ আল-ইসলামিয়াহ, ড. মুহাম্মাদ সা‘দ আল-ইয়ূবী, পৃঃ ১৭৯

    [52] আল-মুয়াফাকাত, ২/৮

    [53] শারহ আল-মুহাল্লী আ’লা জামঈ’ল জাওয়ামি’, জালালইদ্দিন মুহাম্মাদ ইবন আহমাদ আল-মুহাল্লী, ২/২৮

    [54] আল-মুয়াফাকাত, ১/৩৮, মাকাসিদুশ-শারীয়াহ্ আল-ইসলামিয়াহ, ড. মুহাম্মাদ সা‘দ আল-ইয়ূবী, পৃঃ ১৮৩

    [55] সূরা আলে-‘ইমরান : ১৯

    [56] সূরা আলে-‘ইমরান : ৮৫

    [57] সূরা আল-হিজর :

    [58] ইসলাম ও জীবনের অপরিহার্য বিষয়সমূহ, পৃঃ ৩১

    [59] ইসলাম ও জীবনের অপরিহার্য বিষয়সমূহ পৃঃ ৩১, মাকাসিদুশ শারীআ’হ আল-ইসলামিইয়াহ পৃঃ ১৯৭-১৯৮

    [60] সূরা আন-নিসা : ৬৫

    [61] সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৪

    [62] সূরা আলে-‘ইমরান : ১০৪

    [63] সূরা আলে-‘ইমরান : ১১০

    [64] সূরা আল-কাসাস : ৮৭

    [65] সূরা আন-নাহল : ১২৫

    [66] সূরা ইউসুফ : ১০৮

    [67] সূরা তাওবাহ : ১১১

    [68] সূরা আল-মায়িদাহ : ৯০-৯১

    [69] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২০০৩

    [70] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৪৭৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১১

    [71] মুসনাদ ইমাম আহমাদ, ২/৯১,১৬৭,১৭৯, সুনান আবি দাউদ, ৩/৩২৭, হাদীস নং ৩৬৮১, সুনান তিরমিযী, ৪/২৯২, হাদীস নং ১৮৬৫, সুনান ইবন মাজাহ, ২/১১২৪, হাদীস নং ৩৩৯২-৩৩৯৪

    [72] সূরা আল-ফুরকান : ৪৪

    [73] সূরা আল-আহক্বাফ : ২৬

    [74] মাকাসিদুশ শারীআ’হ আল-ইসলামিইয়াহ পৃঃ ২৮৫

    [75] সূরা আত-তাওবাহ : ৬০

    [76] আল-মুয়াফিকাত ২/১১

    [77] সূরা আর-হাজ্জ : ৭৮

    [78] সূরা আল-মায়িদাহ :

    [79] আল-মুয়াফিকাত ২/১১

    [80] আলমুস্তাসফা, ইমাম আল-গাযালী, পৃঃ ২৫৮

    [81] প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫১

    [82] প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৮

    [83] আল-কাওয়ায়েদ, মাক্কারি, ২/৪৩২

    [84] আল-মুয়াফাকাত, ইমাম শাতিবী, ১/১৮৩

    [85] প্রাগুক্ত, ২/৩৯৩, ৩/১২২

    [86] প্রাগুক্ত, ২/২৪

    [87] কাওয়ায়েদুল আহকাম, ইযযুদ্দীন ইবন আবদুস সালাম, ১/৭১, আল-মুওয়াফাকাত, ২/৩৫০

    [88] আলমুয়াফাকাত, ২/১৪

    [89] আল-কাওয়ায়েদ, মাক্কারি, ২/৪৪৩

    [90] আল-মুয়াফাকাত, ৪/১৭৯

    [91] মাকাসিদ আশ-শারীয়াহ্ আল-ইসলামিয়াহ, পৃঃ ১৫-১৬