الإساءة للرسول الكريم: ما فعلوا بنبينا وما نفعل به
أعرض المحتوى باللغة الأصلية
تهدف هذه المقالة إلى التعريف بالنبي الخاتم محمد - صلى الله عليه وسلم - وبيان شمائله وأخلاقه وصفاته وسيرته ودوره على جميع البشر كما تحدث الكاتب في هذه المقالة عما وقع في الغرب من الإساءة للنبي - صلى الله عليه وسلم – وجوانبه الخلفية وما يجب علينا في مثل هذه المصائب، وأن علينا أن نواجه هذه التهم والإساءة بالحكمة والحنكة، والتعريف بالنبي وأعماله الخالدة.
মহানবীর অবমাননা : ওরা যা করেছে আমরা যা করব
[ বাংলা – Bengali – بنغالي ]
আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
2012 - 1433
الإساءة للرسول الكريم
ما فعلوا بنبينا وما نفعل به
« باللغة البنغالية »
علي حسن طيب
مراجعة: د. أبو بكر محمد زكريا
2012 - 1433
মহানবীর অবমাননা : ওরা যা করেছে আমরা যা করব
ঘটনার সূত্রপাত : সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, বিশ্বশান্তি ও মানবতার মুক্তিদূত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার ও তাঁর প্রচারিত শান্তির ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার ও বিদ্বেষমূলক চলচ্চিত্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি সারা মুসলিম বিশ্বে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। প্রতিটি মুসলিমের অন্তরে বইছে ক্রোধের আগুন। ইন্টারনেটে ওই চলচ্চিত্রের দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ার পর ইতিমধ্যে কমপক্ষে ২০টি দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এসব বিক্ষোভের সময় সহিংসতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৫ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছে। [প্রথম আলো, ১৯ সেপ্টম্বর ২০১২ সংখ্যা]
পশ্চিমাদের অব্যাহত দ্বৈতনীতি ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে কেবল মুসলিমরাই নন, বিবেকবান প্রতিটি মানুষই সোচ্চার ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, বিশ্বজুড়ে সহিংসতা উসকে দেওয়া ইসলামবিরোধী চলচ্চিত্র ইনোসেন্স অব মুসলিমস-এর নির্মাণকারীরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছেন। চলচ্চিত্রটি অসম্মানজনক ও লজ্জার। ইন্টানেট ব্লগগুলোয় দেখলাম, অনেক নাস্তিকও এ কাজের নিন্দা জানিয়েছেন।
সিনেমার প্রযোজক পরিচালক : সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ইয়াহূদী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক স্যাম বাসিল এ ফিল্ম তৈরি করেন। এটি তার ছদ্মনাম। তার মূল নাম নাকুলা বাসিলে নাকুলা (Nakoula Basseley Nakoula)। বয়স পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই। লন্ডনের বিখ্যাত ডেইলি মেট্রো জানিয়েছে, এই বাসেলি মূলত মিশরীয় বংশোদ্ভূত কপটিক খ্রিস্টান। বাসেলির শিক্ষাগত যোগ্যতার খবরও কেউ দিতে পারে নি। এর আগে ২০১০ ইংরেজি সালে ব্যাংক জালিয়াতির কারণে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার আদালতে তার ২১ মাসের জেল হয়েছিল। এই রকম এক ভয়ংকর প্রতারক মুসলিম ধর্মের ওপর আঘাত করে এমন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের সাহস পেল কোথায় সেটাই এখন ভাবার বিষয়।
আমেরিকায় বসবাসরত ১০০ জন ইয়াহূদী ব্যবসায়ীর অর্থানুকূল্যে ৫০ লাখ ডলার ব্যয়ে নির্মাণ করেন ‘ইনোসেন্স অব মুসলিমস’ (Innocence of Muslims) নামে রহস্যপূর্ণ এ চলচ্চিত্র। সিনেমাটির কিছু অংশ ইন্টারনেটে প্রকাশের পর বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের ক্ষুব্ধ প্রতিবাদের দ্বিতীয়দিন আমেরিকার শীর্ষ চলচ্চিত্র নির্মাতাগণ বিবৃত দিয়ে বলেন, এ সম্পর্কে বা এর পরিচালক সম্পর্কে কিছুই তারা জানেন না। মার্কিন ফিল্ম মেকাররা এর দায় নেবেন না।
সিনেমায় কী ছিল দেখানো হয়েছে : মাত্র ১০ মিনিটের যে অংশ ইন্টারনেটে ছাড়া হয়েছে তা দেখে কোনো মুসলিমের রক্ত ঠান্ডা থাকার কথা নয়। সিনেমাটিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত চরিত্রে কালিমা লেপনের চেষ্টা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নারী লিপ্সু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। একসঙ্গে একাধিক নারীর শয্যাগ্রহণকারী হিসেবেও দেখানো হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। স্ত্রীদের কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুতাপেটা করার দৃশ্যও সংযোজন করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অমুসলিম নিধনকারী হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কখনও দাড়ি বিহীন সন্ত্রাসী হিসেবে আবার কখনো জুব্বা গায়ে ভণ্ড চরিত্রে উপস্থান করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একান্ত সাহাবী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমরা রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ অন্যান্য সাহাবীদের চরমভাবে অপমান করা হয়েছে। উম্মাহাতুন মুমিনীন তথা নবীর স্ত্রীদেরও উপস্থাপন করা হয়েছে বেপর্দা ও নগ্নভাবে। [নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক]
প্রতারক বাসেলি : কুলাঙ্গার বাসেলি শুধু কোটি কোটি মুসলিমের হৃদয়ে আঘাত দেয়ার অপরাধই করে নি। তার সহকর্মীদের সঙ্গে যথারীতি অমার্জনীয় প্রতারণাও করেছেন। ওই চলচ্চিত্রে নায়িকা চরিত্রে অভিনয়কারী আন্না গোর্জি বলেন, ‘আমরা প্রতারিত। আমাদের কস্মিনকালেও জানানো হয় নি এ বদ মতলবের কথা। পরিচালক নিকোলা আমাদের ব্ল্যাকমেইল করেছেন।’ একুশ বছর বয়সী এই অভিনেত্রী আরও বলেন, ‘জর্জির (সিনেমায় মহানবীর চরিত্র অভিনয়কারী নায়ক) বিপরীতে তরুণী বধূ হিসেবে অভিনয়ের সময় আমি মোটেও জানতাম না আমাকে ইসলামের মহানবীর স্ত্রী (আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা)র ভূমিকায় রাখা হয়েছে। আমি আজ তিনদিন যাবত ঘুমোতে পারছি না। আমার চোখ থেকে কেবল অশ্রু ঝরছে। আমি কখনোই আমার দর্শকদের মনে আঘাত দিতে চাই না। মধ্যপ্রাচ্যের দর্শকরা আমাকে এর জন্য অভিশাপ দেবেন, আমার মুণ্ডুপাত করবেন, এ আমি কখনো চাইনি।’ [ডেইলি মেইল থেকে অনূদিত আরবি সূত্রে প্রাপ্ত]
এদিকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবমাননা করে নির্মিত কুখ্যাত চলচ্চিত্রটি গুগলের ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউব থেকে বাদ দেয়ার জন্য আদালতের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন খোদ ছবির আরেক অভিনেত্রী সিনডি লি গার্সিয়া। ১৯/০৯/২০১২ ইং তারিখ (বুধবার) যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি আদালতে তিনি এ বিষয়ে নিজের মতামত তুলে ধরেন। চলচ্চিত্রটির নির্মাতা নিকোলা বাসিলে তাকে প্রতারণা করে ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম’ নামে এই ঘৃণ্য ছবিতে অভিনয় করিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন সিনডিও। এছাড়া তার এই ছবিতে অভিনয়ের ফলে মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগায় তিনি সবার কাছে ক্ষমাও প্রার্থনা করেছেন।
ছবিতে অভিনয়ের বিষয়ে সিনডি লি বলেন, বাসেলি যখন তাকে এর পাণ্ডুলিপিটি দিয়েছিল তখন এর মধ্যে কোথাও মহানবীর নাম কিংবা কোনো ধর্ম সম্পর্কে উল্লেখ ছিল না। ছবিটির ভিডিও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই তিনি হত্যার হুমকি পাচ্ছেন বলেও দাবি করেন। উল্লেখ্য, মার্কিন অভিনেত্রী সিনডি লি গার্সিয়া এই চলচ্চিত্রটিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেয়ে ফাতেমার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। [সূত্র : রয়টার্স থেকে অনূদিত আরবী পত্রিকা]
পৃথীবির সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব : যে মানুষটি শুধু তাঁর সমকালীন মিত্র ও সঙ্গীদের প্রিয়তম ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন আদর্শিকভাবে তাঁর ঘোর শত্রুদের চোখেও শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য। সমসাময়িক অনুচরবৃন্দ থেকে নিয়ে কিয়ামত দিন পর্যন্ত যে মানুষটি সকল বিবেকবান চক্ষুষ্মান অনুসারীর দৃষ্টিতে সবচে ভালোবাসার পাত্র। যাকে ‘সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী’ অভিধায় ভূষিত করেছেন খোদ নিখিল সৃষ্টির নিপুণ স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। [আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় রাসূল সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিয়ে বলেন,
﴿ وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٖ ٤ فَسَتُبۡصِرُ وَيُبۡصِرُونَ ٥ بِأَييِّكُمُ ٱلۡمَفۡتُونُ ٦ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ٧ ﴾ [القلم: ٤، ٧]
‘আর নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের ওপর অধিষ্ঠিত। অতঃপর শীঘ্রই আপনি দেখতে পাবেন এবং তারাও দেখতে পাবে- তোমাদের মধ্যে কে বিকারগ্রস্ত? নিশ্চয় আপনার রবই সম্যক পরিজ্ঞাত তাদের ব্যাপারে যারা তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, আর তিনি হিদায়াতপ্রাপ্তদের সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞাত’। {সূরা আল-কলম, আয়াত : ৪-৭}]
যে মানুষটির জীবনেতিহাস ও মানবজাতির প্রতি তাঁর অপরিসীম অবদানের আলেখ্য পড়ে ভক্তিগদগদ হয়ে ওঠেন আধুনিক বিশ্বের নিরপেক্ষ অসংখ্য মনীষী, আমেরিকারই নাগরিক মাইকেল এইচ হার্ট তাঁর সারা জাগানো বই ‘দ্যা হানড্রেড’ এ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহামানব হিসেবে এক নাম্বারে রেখেছেন। ইউলিয়াম ম্যুর থেকে নিয়ে অসংখ্য পণ্ডিত ও মনীষী তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হিসেবে অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেই মানুষকে নিয়ে যখন ব্যঙ্গ কার্টুন আঁকা হয়, সিনেমা বানিয়ে তাঁর চরিত্রে ইচ্ছে মত কালিমা লেপন করা হয়, তখন শুধু সারাবিশ্বের ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ পাঠকারীদের অন্তরই নয়, বিবেকবান প্রতিটি মানুষের হৃদয়ই কেঁদে ওঠে। মুহাম্মদ নামের এই নিরক্ষর মহাজ্ঞানী ব্যক্তিটি শুধু অসংখ্য মানুষের নবীই নন, তিনি সবার ভালোবাসার বাতিঘর। তাঁকে সবচে বেশি ভালোবাসা ঈমানের অপরিহার্য অংশ। যেমন, আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ»
‘তোমাদের কেউ সে অবধি মুমিন হতে পারবে না, যাবৎ আমি তার কাছে প্রিয়তর হই তার পিতা ও সন্তান থেকে এবং সকল মানুষ থেকে।’ [বুখারী : ১৫; মুসলিম : ৪৪]
পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি : পশ্চিমাদের বিবেক-বিবেচনা দেখে তখনই দুঃখটা জাগে যখন দেখি তারা চিন্তা-বাকস্বাধীনতার শ্লোগান দিতে দিতেই আইন করে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করে। যখন তারা কেবল নিজেদের ভোগ-বিলাসের অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে রাজনীতির বলী বানায় অসংখ্য নিরীহ বনি আদমকে। যে নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে তারা বিশ্বজুড়ে শোরগোল করে অবলীলায় তাদেরই মিসাইল আর বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে নির্দয়ভাবে। পক্ষান্তরে কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসায় আঘাত করে যে কুলাঙ্গার সিনেমা বানায় তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে প্রশ্রয় দেয়া হয়। তথাকথিত চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে আর কত অন্যায়কে জায়েয করা হবে?
বৃটিশ রাজপুত্র ইউলিয়াম তার স্ত্রী কেটকে নিয়ে ফ্রান্সের সাগরপারে বেডরুমের বিনোদন করেছেন তাঁর ‘বিশ্বব্যাপী’ দীর্ঘ মধুচন্দ্রিমার অংশ হিসেবে। সেখানে তোলা তাদের কিছু নগ্ন ছবি পত্রিকায় প্রকাশ করায় তিনি ও বৃটিশরা বেজায় চটেছেন পত্রিকার ওপর। এটাকে তিনি ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে অপমান জ্ঞানে মামলা করেছেন। আদালত কালবিলম্ব না করে তাঁর পক্ষে রায়ও দিয়েছে। অথচ একই সময়ে পৃথিবীর সবচে ত্যাগী মানুষ, মানুষের মুক্তি ও শান্তির চিন্তায় অস্থির রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদাহানী করে আমেরিকায় সিনেমা বানানো হলো। তথাপি এ ব্যাপারে পশ্চিমা নেতারা পরিষ্কার নিন্দাসূচক কিছু বলেন নি। মুসলিম ঔরসে জন্ম নেয়া ইয়াহূদীবান্ধব খাঁটি খ্রিস্টান বারাক ওবামাও কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নেন নি।
তাকে গ্রেফতার করা হয় নি। উপরন্তু মাত্র সাত দিনের মাথায় সিনেমা নির্মাণের ক্ষোভ প্রশমিত না হতেই আবার ফ্রান্সের ‘শার্লি হেবদো’ সাময়িকী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যঙ্গাত্মক দুটি কার্টুন প্রকাশ করেছে। ফ্রান্সের মুসলিম নেতারা সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই কার্টুন প্রকাশের নিন্দা জানিয়েছেন। বিক্ষোভের আশঙ্কায় ফ্রান্স ২০টি দেশে তাদের দূতাবাস ও কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমাদের তথাকথিত নীতিকথা আর আদর্শের পুরোটাই যে ভেক আর ভণ্ডামি তা আরও সপ্রমাণ হলো।
পশ্চিমাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে বলে যথার্থ মন্তব্য করেছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহম্মদ। ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার’ ওপর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের এক বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে মাহাথির এ মন্তব্য করেন। ওই চলচ্চিত্র তৈরি প্রসঙ্গে হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, এর প্রচার ও প্রকাশ বন্ধ করা হলে মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবমাননা করায় সারা বিশ্বের মুসলিমরা যখন তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এবং বিভিন্ন জায়গায় সংঘাত-সংঘর্ষে বহু মানুষ হতাহত হচ্ছে তখন চলচ্চিত্রটির প্রচার বন্ধ না করে বরং সংঘাতকে আরো উস্কে দিলেন হিলারি।
এর জবাবে মাহাথির মুহম্মদ তার ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ‘মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের অধিকারের দোহাই দিয়ে হিলারি মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী এ চলচ্চিত্রের পক্ষে কথা বলেছেন। আমি মনে করি, পশ্চিমাদের মূল্যবোধ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের কথা বলে তারা একে অপরকে অপমান করতেও আর দ্বিধা করছে না।’
মাহাথির মুহাম্মদ আরও বলেন, ‘মানুষ যদি একে অপরকে অবজ্ঞা ও অপমান করতে থাকে তাহলে কি ধরনের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে? রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি কোথাও কোন শান্তি থাকবে না।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই থাকবে। কিন্তু অপমান করার অধিকার কারও নেই।’
মাহাথির মুহাম্মদ জোর দিয়ে বলেন, অন্য জাতির ধর্ম ও মূল্যবোধকে আঘাত করা হলে বিশ্ব থেকে শান্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও ঘৃণা ও সংঘাত বেড়ে যাবে। [দৈনিক সংবাদ ২২/৯/২০১২ সংখ্যা]
বিশ্ব মানবতার প্রতি শান্তির ধর্ম ইসলাম ও মহানবীর অবিস্মরণীয় অবদান : যে ধর্মের নাম থেকে নিয়ে কর্ম ও চিন্তার প্রতিটি পর্যায়ে লক্ষ্যণীয় ‘শান্তিশব্দে’র সক্রিয় উপস্থিতি, যে ধর্ম শুধু তার অনুসারীদেরই নয়, বিধর্মীদেরও দেয় নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার ও মর্যাদা। সে ধর্মকে জোর করে উগ্র বানাবার উন্মাদ প্রচেষ্টা বড়ই হাস্যকর। বলতে দ্বিধা নেই আজ বিশ্ব সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে যে মৌলিক চেতনাগুলোর ওপর, তার অধিকাংশের চারা রোপন করেছে এই ইসলাম। এত অত্যাচার অপপ্রচারেও যে ধর্মের অনুসারীদের দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না, বিশ্বের সব মতবাদ আর ইজমের কাছে হতাশ হয়ে যে ধর্মের শান্তির শীতল ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছেন পাশ্চাত্যের সর্বোচ্চ শিক্ষিত ও সভ্য মানুষগুলো, সে ইসলামের ওপর কেন এত রাগ আর এত বদনাম গাওয়া তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
পাশ্চাত্যের জানা উচিত, আল্লাহর ওহী প্রাপ্তির মাধ্যমে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বমানবতাকে মানুষের দাসত্ব থেকে একমাত্র শরীকবিহীন আল্লাহর ইবাদতের পথ দেখিয়েছেন। এর ফলে আল্লাহ বৈ সব কিছুর দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে মানুষ। তিনি বিশ্বমানবতাকে সকল কল্পকথা ও কুসংস্কার এবং সব রকমের মিথ্যা ও প্রতারণার সামনে শির না নোয়াবার শিক্ষা দিয়েছেন। অক্ষম প্রতিমা ও অলীক প্রভুদের বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করেছেন। মুক্ত করেছেন অসুস্থ চিন্তাধারা থেকে। বিশ্ব মানবতার চেতনায় ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার চারা রোপন করেছেন। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ গ্রন্থ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ لَآ إِكۡرَاهَ فِي ٱلدِّينِۖ قَد تَّبَيَّنَ ٱلرُّشۡدُ مِنَ ٱلۡغَيِّۚ فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ لَا ٱنفِصَامَ لَهَاۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ٢٥٦ ﴾ [البقرة: ٢٥٦]
‘দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় হিদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’। {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৫৬}
জীবদ্দশায় তিনি নিজেও দ্ব্যর্থহীনভাবে মুসলিমের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসকারী অমুসলিমদের সকল অধিকার নিশ্চিত করেছেন। ধর্ম-বর্ণ-বংশ নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর শিক্ষার মধ্যে বরং এমন উপাদানেরও অভাব নেই যা পক্ষী ও প্রাণীকুলের প্রতি মায়া-মমতা ও কোমলতা দেখাতেও গুরুত্ব দেয়। নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এদের অকারণে কষ্ট প্রদান কিংবা এদের প্রতি বিরূপ আচরণকে।
তিনি তাঁর অগ্রবর্তী সকল নবীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের এক উজ্জ্বল চিত্র উপস্থাপন করেছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন নবী ইবরাহীম, মুসা ও ঈসা (ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের নবী) প্রমুখ। ছোট-বড়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছেন। প্রস্থানের তিন মাস আগে বিদায় হজে প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি মানুষের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানে আঘাত হানাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি মানুষের সহজাত প্রকৃতিবান্ধব এক দীন নিয়ে আবির্ভূত হন যা আত্মিক খোরাক ও দৈহিক চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রাখে। পার্থিব কাজ ও আখিরাতের আমলের মধ্যে ভারসাম্য বিধান করে। মানুষের সহজাত বাসনা ও ঝোঁককে করে পরিশীলিত ও পরিমার্জিত। অপরাপর জাতিগুলোর সভ্যতার মতো একে ধ্বংস বা অবদমিত করে না।
মানবতার কল্যাণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আন্তঃসম্প্রদায় ভ্রাতৃত্বের পূর্ণাঙ্গ নমুনা পেশ করেছেন। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, কোনো মানব সম্প্রদায়ের ওপর অন্য কোনো মানব সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মূল সৃষ্টি, অধিকার ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে তারা সবাই সমান। শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচিত হবে কেবল ঈমান ও তাকওয়া তথা বিশ্বাস ও আল্লাহভীতির নিরিখে। তিনি তাঁর সকল সঙ্গী-সাহাবীকে ধর্মসেবা এবং তাতে সম্পৃক্ত হবার সমান সুযোগ দিয়েছেন। তাইতো তাঁদের মধ্যে আরবদের পাশাপাশি ছিলেন (রোম দেশের) সুহাইব রূমী, (হাবশার) বিলাল হাবশী এবং (পারস্যের) সালমান ফারসী রাদিআল্লাহু আনহুম প্রমুখ।
পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক হামিদ মীরের অনুভূতি : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক, জিও টিভির প্রধান নির্বাহী হামিদ মীর তাঁর দৈনিক জং-এর এক কলামে লিখেছেন, ‘আমার কষ্ট ও যন্ত্রণা ছিল বর্ণনাতীত। এটা আমার সাংবাদিকতাসুলভ অনুসন্ধিৎসু মনোভাবের কারণে। সিএনএনে ইসলামবিরোধী একটি চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে লিবিয়ায় বিক্ষোভের খবর দেখার পর ইন্টারনেটে ওই চলচ্চিত্রটি খোঁজা শুরু করি। আমার এক সহকর্মী কোথাও থেকে ভিডিওটি ডাউনলোড করে আমার কাজ সহজ করে দেন। যখন ওই চলচ্চিত্রটি দেখা শুরু করি তখন আমার কাছে মনে হতে লাগল, কেউ যেন আমার মন ও মস্তিষ্কে হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে।
নিজেকে অনেক শক্ত মনের মানুষ বলে জানি, কিন্তু স্যাম ভাসেলির নির্মিত ইনোসেন্স অব মুসলিম নামের এই চলচ্চিত্র বর্তমান যুগের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদ। কারণ এই চলচ্চিত্রের দৃশ্য ও সংলাপগুলো বোমা বিস্ফোরণের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আলকায়েদার হামলায় তিন হাজার লোক মারা গিয়েছিল। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বর ২০১২ ইউটিউবে প্রচারিত এই ভিডিওচিত্রটি কোটি মুসলিমের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওই চলচ্চিত্র কয়েক মিনিটের বেশি দেখতে পারি নি। এই ভয়াবহ চলচ্চিত্রের বিবরণ দেয়াও আমার জন্য অনেক কষ্টকর। শুধু এতটুকু বলব, এই চলচ্চিত্রের কয়েকটি দৃশ্য দেখে স্যাম বেসিলের বিপরীতে ওসামা বিন লাদেনের সন্ত্রাসবাদকে অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়েছে। আমেরিকার জন্য এটা বড় পুরস্কার, এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী স্যাম বেসিল এত বড় অপকর্ম করার পরও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশ্রয়েই আছে। আল্লাহ তা‘আলার কাছে লাখো শুকরিয়া যে, আজ পর্যন্ত কোথাও কোনো মুসলিম ঈসা আলাইহিস সালাম অথবা অন্য কোনো নবীর ব্যাপারে এ ধরনের বেয়াদবী করেন নি।’
হামিদ মীরের একটি যুক্তি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমেরিকার পক্ষ থেকে আমাদের দেশের মাদরাসাগুলোর ওপর অনেক অভিযোগ আরোপ করা হয়। অথচ দ্বীনি মাদরাসার ছাত্ররা কখনো খ্রিস্টান অথবা ইয়াহূদী ধর্মের এমন অবমাননার কথা চিন্তাও করে না যা করেছে স্যাম বাসেলি ইসলাম ও ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে।
আমার আফসোস হয়, এ ব্যাপারে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তার প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া লোকদেখানো। এই চলচ্চিত্রকে আমেরিকার প্রশাসনবিরোধী হিসেবে অভিহিত করাই যথেষ্ট নয়, বরং এটাও স্বীকার করতে হবে, কিছু খ্রিষ্টান ও ইয়াহূদী সন্ত্রাসী আমেরিকাকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের অপচেষ্টা করছে। তারা তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আলকায়েদা, তালেবান ও হাক্কানী নেটওয়ার্ক থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর। আমি বারাক ওবামার কাছে স্যাম বাসেলের মতো সন্ত্রাসীর বিচার প্রার্থনা করব না, তবে আমেরিকান মিডিয়ার বন্ধুদের কাছে আবেদন করব, তারা যেন এটা খুঁজে বের করেন, তাদের দেশের সন্ত্রাসীদের কোন কোন গোপন সংগঠন সহযোগিতা করে। আমি বিশ্বাস করি, ডেরি জনস ও স্যাম ভাসেলি গোটা আমেরিকার প্রতিনিধিত্ব করে না। আমেরিকায় রমস ক্লার্কের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিও আছেন, যিনি পাকিস্তানি ডাক্তার আফিয়া সিদ্দিকীর মুক্তির জন্য আন্দোলন করছেন।
আমার কাছে মনে হচ্ছে, মুসলিম বিশ্বে আজ আমেরিকা ক্লার্কের দেশ হিসেবে পরিচিত নয়, পরিচিত হচ্ছে স্যাম বাসিলের দ্বারা।
স্যাম বাসিলের সন্ত্রাসবাদ আমাকে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। মুসলিমদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননা করায় খ্রিস্টান বাদশাহর প্রতি রাগান্বিত হয়ে তলোয়ার হাতে নিয়েছিলেন। আর শেষ পর্যন্ত বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয় করেছিলেন। কিন্তু আফসোস, আজ মুসলিম বিশ্বের কোনো শাসকের মধ্যে এই অনুভূতি ও উদ্যমটুকু নেই যে, নবীজীর অবমাননাকারী কুচক্রীদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে।’ [বার্তা ২৪ এর সৌজন্যে]
আমেরিকার খোঁড়া যুক্তি : সহিংসতায় উসকানি দেয়ার মতো এ সিনেমার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে বড় যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে। বাস্তবে দেখা যায় আমেরিকায় যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে তা একেবারেই সীমারেখার বাইরে নয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার তাত্ত্বিক সংজ্ঞা অনুযায়ী একজনের স্বাধীনতা যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যের অধিকারকে আঘাত না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীনতা ভোগ করা যাবে। অন্যের মাথায় আঘাত করার অধিকার ব্যক্তিস্বাধীনতায় দেয়া হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের অস্তিত্বের বিপক্ষে কথা বলার ওপর আইনি বিধিনিষেধ রয়েছে। এটাকে বলা হয়েছে ঘৃণা ছড়ানো। বাসিলের সিনামাটি মোটেই মত প্রকাশের বিষয় ছিল না। এটি ছিল ঘৃণা ছড়ানোর একটি অপচেষ্টা। বিশ্বের দেড় শ’ কোটি মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুসরণের কেন্দ্রবিন্দু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে কলঙ্কলেপন করে সহিংসতা সৃষ্টিকে আইনের আওতায় আনতে অপারগতা প্রকাশ প্রশ্নসাপেক্ষ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সিনেমাটিকে একটি জঘন্য কাজ বলে উল্লেখ করলেও একই সঙ্গে তিনি আমেরিকার মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেন।
কেন এই ঘটনা : লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইদানীং কুরআন পুড়িয়ে ফেলা, রাসূলকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন প্রকাশ, ইসলামকে খাটো করে বক্তব্য প্রদানের ঘটনা বেড়ে গেছে। এর কারণও সবার বোধগম্য। স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন তার clash of civilisation বা ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ বইয়ে বর্তমান বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে ইসলাম ও মুসলিমকে আখ্যায়িত করেছেন। অতএব মুসলিমকে চারদিক থেকে আক্রমণ করতে হবে। এ কারণেই কথায় কথায় মুসলিমকে জঙ্গি বলা, ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম আখ্যায়িত করা এবং রাসূলকে বিতর্কিত করার হীন প্রচেষ্টা চলছে অহরহ। এক্ষেত্রে মিডিয়া হলো বড় হাতিয়ার; বোমা কামান তো আছেই।
বিশ্লেষকগণ আলোচ্য সিনেমা ও তা থেকে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার হীন প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য করছেন। ইরানে হামলা চালাতে ওবামা প্রশাসনে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে ইয়াহূদী লবির পক্ষ থেকে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো নাইন-ইলেভেনের পরে ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জাতিকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচারণা নতুন করে শুরুর প্রেক্ষিত তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক কট্টরপন্থী ইয়াহূদী লবিস্টদের মাধ্যমে। এ প্রচেষ্টা সফল হলে মুসলিম বিশ্বে চলমান অনেক কিছুর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
টার্গেট মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট মধ্যপ্রাচ্য : এসব অবমাননাকর ঘটনার পেছনে মূল লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যকে। মধ্যপ্রাচ্যের তাৎপর্যপূর্ণ কিছু উন্নয়ন রয়েছে বিগত কয়েক বছরের। এর পেছনে মার্কিন নীতির কিছুটা প্রভাবও রয়েছে। আমেরিকান নীতি এক সময় ছিল আমেরিকার স্বার্থের জন্য সহায়ক হলে রাজা সামরিক বা রাজনৈতিক একনায়কদের সহায়তা করা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের একনায়কত্ব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থাভাজন হয় না। তারা নিজেদের সর্বাত্মকবাদী শাসন কায়েম রাখতে বিভিন্ন ধরনের জুলুম নিপীড়ন করেন। এসব রাষ্ট্রনায়কের পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে সঙ্গে ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রক হিসেবে টিকিয়ে রাখার মতো করে আমেরিকা তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি বিন্যাস করে। কিন্তু এই নীতি মধ্যপ্রাচ্যের বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে ক্ষোভের কারণ হয়। বুশ প্রশাসন ও নিওকনদের বিপরীতে এ ধারা ওবামা প্রশাসনে প্রাধান্য লাভ করে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমের পরিবর্তিত ভূমিকার পেছনে আমেরিকান পরিস্থিতি ও উদার নীতির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কট্টরপন্থী ইসরাইলী নেতৃত্ব মধ্যপন্থী ইসলামিস্টদের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যে গণবিপ্লব চলেছে তাতে আমেরিকান নীরবতা অথবা সমর্থনের বিপক্ষে ছিল। কট্টরপন্থী ইসরাইলীরা মনে করে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে শক্তি দিয়েই টিকে থাকতে হবে, সমঝোতার মাধ্যমে নয়। তাদের ধারণা, ব্রাদারহুড ধারার নেতৃত্ব মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সংহত হলে ইসরাইল অনেক বেশি চাপে পড়বে। ডেমোক্র্যাট রিপাবলিকান নির্বিশেষে সব মার্কিন সরকার ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেও ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য শক্তি ও সংলাপের ভারসাম্য প্রয়োজন বলে মনে করে ডেমোক্র্যাটরা। এ কারণে ইসরাইলের সঙ্গে ক্যাম্পডেভিট শান্তিচুক্তিসহ প্রায় সব শান্তি আলোচনা ও চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে ডেমোক্র্যাটদের আমলে।
বারাক ওবামা ইসরাইলের স্বার্থের বিরুদ্ধে তার চার বছরের শাসনামলে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ না নিলেও দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন ফিলিস্তিন সঙ্কটের সমাধানের জন্য। ইসরাইলের কট্টরপন্থী নেতৃত্ব এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বারবার বাধা তৈরি করেছে। এর অংশ হিসেবে ইরানের পরমাণু ইস্যুটিকে বয়কট অবরোধের পর্যায় থেকে বেরিয়ে যুদ্ধ ও আক্রমণের পর্যায়ে নিতে নেতানিয়াহু ও এহুদ বারাক অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু হোয়াইট হাউজ ভালো করেই জানে এ মুহূর্তে ইরান আক্রমণের ঘটনা ঘটলে তা মধ্যপ্রাচ্য, বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত করবে।
এ ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টির জন্য ইসরাইলী কট্টরপন্থীরা বেছে নিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়টিকে। নেতানিয়াহু ও ইসরাইলী নেটওয়ার্ক ইরান আক্রমণের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং এর ফলে মধ্যপন্থী ইসলামী দলগুলোর ক্ষমতারোহণের প্রক্রিয়াকে উল্টোমুখী করতে চাপ সৃষ্টি করেছে ওবামা প্রশাসনের ওপর। এ চাপ সৃষ্টি করতে গিয়ে ওবামার সঙ্গে দূরত্বও তৈরি হয় নেতানিয়াহু চক্রের।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনির প্রতি সরাসরি সমর্থন জানান নেতানিয়াহু।
ক্যালিফোর্নিয়ায় ইসলাম ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কুরুচিপূর্ণ বিদ্বেষ সংবলিত সিনেমা সৃষ্টি করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ যোগসূত্র রয়েছে। সিনেমাটি নির্মাণকারী বাসিল নিজেই বলেছেন, এটি ধর্মকেন্দ্রিক সিনেমা নয়, এই হলো রাজনৈতিক সিনেমা। [সৌজন্যে : মাসুমুর রহমান খলিলী, মধ্যপ্রাচ্যে আকস্মিক উত্তাপে নতুন শঙ্কা, দৈনিক নয়া দিগন্ত]
আমাদের করণীয় : এমতাবস্থায় মুসলিমের পা ফেলতে হবে খুব বুঝে শুনে। ওদের যে কোনো উস্কানিমূলক বক্তব্য ও কর্মকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। ইসলামের শত্রুরা হাজারো ফাঁদ তৈরি করে রেখেছে আমাদের জন্য। ইতোমধ্যে তা প্রমাণও হয়ে গেছে। লিবিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিহত হওয়ার ঘটনার ছুতোয় দুটি মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ ইতোমধ্যে লিবিয়ার জলসীমা স্পর্শ করেছে। এক ব্যক্তি খুনের ঘটনায় দুটি রণতরী পাঠানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে লিবিয়ার তেল-গ্যাস ও অন্যান্য সম্পদ লুট করা। এভাবেই ওরা উসিলা তৈরি করে মুসলিমের সম্পদ লুট করে দুনিয়ায় টিকে আছে।
তাই এসব চক্রান্তের মোকাবিলা করতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে। যেমন- আইনের আশ্রয় নেয়া যায়, গণ স্বাক্ষর সংগ্রহ করা যায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া যায়, বিশ্ব গণমাধ্যম ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে দেন-দরবারেও এর শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে। মুসলিমদের মিডিয়াগুলোকে এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। রাষ্ট্র প্রধানগণ আন্তর্জাতিক সব ফোরামে এ নিয়ে চাপ সৃষ্টি করবেন।
এক সিনেমার বিপরীতে হাজার সিনেমা বানিয়ে ইসলাম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্দর চরিত্রকে গোটা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হবে। নিত্য নতুন পেপার-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল খুলে ইসলামের পক্ষে মানুষকে ডাকতে হবে। ফেইসবুক, ব্লগ, ইন্টারনেটকে ইসলামের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। বাতিলের প্রোপাগান্ডাকে সত্যের প্রোপাগান্ডা দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। ইসলামের স্বপক্ষে একদল উৎসর্গিতপ্রাণ কলম সৈনিক গড়ে তুলতে হবে। ঘরে বসে না থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় পারদর্শিতা অর্জন করে প্রমাণ করতে হবে মুসলিমই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। আর এসব কাজ করতে হবে সম্মিলিত পরিকল্পনা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়। তবে সবার আগে আমরা মুসলিমদের আত্মসমালোচনা করতে হবে। সীরাত ও সুন্নাহর কাছে ফিরে আসতে হবে। জীবনের প্রতিটি পর্বে ইসলামের সুমহান আদর্শ ও কুরআন-সুন্নাহকে বাস্তব অনুশীলন ও প্রয়োগ করে দেখাতে হবে।
শেষ কথা : নৈতিক অধঃপাতে নিপতিত মানবজাতি যখন মহানবীর কালজয়ী আদর্শকে যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ভাবছে তেমনই মুহূর্তে তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ চিত্র কিংবা অবমাননাকর সিনেমা নির্মাণ কেবল পাশ্চাত্যের দেউলিয়াপনাকেই নয়; তাদের কূটমানসিকতা ও ইসলাম বিদ্বেষকেও সপ্রমাণ করছে। আল্লাহর কাছে আমাদের সবিনয় প্রার্থনা, আয় মাবুদ, তোমার হাবিবের প্রতি বেয়াদবিকারীদের হেদায়াত দাও, নয়তো সমূলে ধ্বংস কর। আর আমাদের অক্ষমতা ও অযোগ্যতাকে ক্ষমা কর।