مقارنة بين منهج الرسول صلى الله عليه وسلم في التعليم وبين المنهج السائد

أعرض المحتوى باللغة الأصلية anchor

translation লেখক : মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
1

রাসূলুল্লাহ সা. -এর শিক্ষাক্রম ও বর্তমান শিক্ষাক্রমের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা

2 MB DOC
2

রাসূলুল্লাহ সা. -এর শিক্ষাক্রম ও বর্তমান শিক্ষাক্রমের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা

197.9 KB PDF

تحدَّث الكاتب عن منهج الرسول - صلى الله عليه وسلم - في التدريس، وأنه كان يُربِّي أصحابه على الاهتمام بالدار الآخرة، ومعرفة الحلال والحرام، بخلاف كثيرٍ من المناهج الدراسية والتعليمية اليوم فإنها لا تنصبُّ غالبًا إلا على الحياة الدنيا، وذكر نماذج حيَّة على ذلك، كما ذكر سلبيات المناهج التعليمية الحالية، وذكر أسباب فشلها للوصول إلى الهدف المنشود.

    বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাক্রম

    বর্তমান শিক্ষাক্রমের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা

    [বাংলা - bengali - بنغالي]

    ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    সম্পাদনা

    ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    2011- 1432

    ﴿ مقارنة بين منهج الرسول صلى الله عليه وسلم في التعليم وبين المنهج السائد ﴾

    « باللغة البنغالية »

    د. محمد منظور إلهي

    مراجعة: د. أبو بكر محمد زكريا

    2011- 1432

    মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাক্রম

    বর্তমান শিক্ষাক্রমের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা

    - ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    যুগের উন্নতির সাথে সাথে আমাদের শিক্ষাক্রমেও সাধিত হয়েছে প্রভূত উন্নয়নের ছোঁয়া। আমাদের শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানামুখী গবেষণার যে বিশাল সম্ভারের সমারোহ আমরা দেখতে পাচ্ছি তা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। মূলত শিক্ষাকে সকল মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য যে বিরাট সুযোগ-সুবিধা ও সম্ভাবনার দ্বার আজ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্মোচিত হয়েছে, সে তুলনায় আমাদের আগে যারা অতিবাহিত হয়েছেন তাদের সুযোগ-সুবিধা ছিল অনেক বেশী সংকুচিত। বর্তমান সময়ের এত বিশাল সুযোগ-সুবিধা স্বত্ত্বেও আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, আমাদের শিক্ষা সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাঙ্খিত ইতিবাচক পরবির্তন সাধন করতে পারছে না এবং স্বাধীন জাতিসত্ত্বা হিসেবে সত্যিকার শিক্ষার যে মৌলিক লক্ষ্যমাত্রা আমাদের রয়েছে বর্তমান শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে সে লক্ষ্যও আমাদের অর্জিত হয়নি। এর বিপরীতে যদি আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাদের যুগের শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকাই তাহলে ফলাফলের দিক থেকে দেখব যে, তা শতভাগ সফল ও সার্থক। অথচ সে যুগে শিক্ষাপোকরণ ছিল সীমিত এবং প্রযুক্তি ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে তারা ছিল আমাদের চেয়ে অনেক বেশী পিছিয়ে। ফলে স্বভাবতই একটি প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সফল শিক্ষাক্রম ও আমাদের আধুনিক শিক্ষাক্রমের মধ্যে তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? সেটা কি শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করার ক্ষেত্রে, নাকি সিলেবাসের ক্ষেত্রে অথবা যারা কারিকুলাম তথা শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেন তাদের ক্ষেত্রে? নাকি পার্থক্য রয়েছে উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই?

    হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করে দেখা যায় যে, উপরোক্ত তিনটি ক্ষেত্রেই আমাদের বর্তমান শিক্ষাক্রম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাক্রমের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ প্রবন্ধে আমরা সে পার্থক্যগুলো কিছুটা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাক্রম থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা খূঁজে পাওয়ার চেষ্টা করব।

    প্রথমত: শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে পার্থক্যঃ

    আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। প্রথম শ্রেণীর মানুষের মূল লক্ষ্য হলো আখিরাতের সাফল্য অর্জন এবং দুনিয়ায় সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ। এরা দুনিয়ার কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব ও উন্নয়নের জন্য যত কাজই করে সেটি করে আখিরাতের সাফল্য অর্জনের সোপান হিসেবে। শুধু দুনিয়া অর্জনই এদের মূল লক্ষ্য নয়।

    দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ দুনিয়ার ভোগ-বিলাস এবং নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব লাভকেই নিজেদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে নিয়েছে। আর তা উপার্জনের প্রচেষ্টায় পরিচালিত হয় তাদের জীবনের সকল কর্মকান্ড ও আন্দোলন।

    এ দু শ্রেণীর লোকদের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

    ﴿مِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الدُّنْيَا وَمِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الْآخِرَةَ﴾

    ‘‘তোমাদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা দুনিয়া চায় এবং তোমাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যারা চায় আখিরাত।’’ [সূরা আলে ইমরান: ১৫২]

    তিনি আরো বলেন,

    ﴿فَإِذَا قَضَيْتُمْ مَنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَذِكْرِكُمْ آبَاءَكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْراً فَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلاقٍ* وَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ* أُولَئِكَ لَهُمْ نَصِيبٌ مِمَّا كَسَبُوا وَاللَّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ﴾

    ‘‘মানুষের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা বলে, ‘‘হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়ার (প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব) দান করুন।’’ এদের জন্য আখিরাতে কোন অংশই থাকবে না। আর মানুষের মধ্যে এমন অনেক লোকও রয়েছে যারা বলে, ‘‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়ার কল্যাণ প্রদান করুন এবং আখিরাতেও কল্যাণ প্রদান করুন। আর জাহান্নামের আযাব থেকে আমাদের রক্ষা করুন।’’ এদের জন্য (আখিরাতে) রয়েছে একটা অংশ তারা যা অর্জন করেছে সে জন্য।’’ [সূরা আল-বাকারাহঃ ২০০-২০2]

    কোন সন্দেহ নেই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণ ছিলেন প্রথম শ্রেণীভূক্ত। কেননা আখিরাতের প্রশ্ন তাঁদের সকলের কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তাঁরা সব সময় এ ভেবেই তটস্থ থাকতেন যে, আখিরাতে কিভাবে আল্লাহর কাছে আমি নাজাত পাব এবং পুরষ্কৃত হব?

    নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের বহু ক্ষেত্রে আমরা এ ব্যাপারটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করি। এর কিছু দৃষ্টান্ত আমরা এখানে উল্লেখ করেছি-

    ১। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রকাশ্য দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করেন তখন তিনি এ ঘোষণাও প্রদান করেন যে, ইসলাম গ্রহণের লক্ষ্য কি হওয়া উচিত। হাদীসের ভাষায় সে লক্ষ্যটি হলো জাহান্নামের অগ্নি থেকে নিজেকে রক্ষা করা। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘‘যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হলো, ‘আর আপনি আপনার নিকট আত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন’ [সূরা আশ-শু’আরাঃ ২১৪] তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণ ও খাস সব লোককে ডেকে বললেন, ‘হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে বাঁচাও। হে নবী কা’ব সম্প্রদায়! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে বাঁচাও। হে ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ! তুমি নিজেকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে বাঁচাও। আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহর কাছে তোমাদের কোন কাজেই আসব না।’’ [সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ২৫৪৮, ৪৩৯৮, সহীহ মুসলিম হাদীস নং- ৩০৫, আর-রহীক, আল-মাখতুম, পৃঃ ৬৯]

    ২। সহল ইবনু সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা খন্দকের যুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। সাহাবাগণ তখন মাটি থেকে খোঁড়ার কাজ করছিলেন। আমরা আমাদের কাঁধে মাটি বহন করছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘হে আল্লাহ! আখিরাতের জীবন ছাড়া আর কোন জীবন নেই। সুতরাং আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করুন।’’ [সহীহ বুখারী, আল-মাগাযী, হাদীস নং ৬৪১৪ ]

    ৩। জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি লাভ ও জান্নাতে প্রবেশের আমল সম্পর্কে সাহাবাদের জিজ্ঞাসা ও জানার আগ্রহ প্রমাণ করে যে, এটা তাদের ভাল কাজে লিপ্ত হওয়ার এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার মৌলিক লক্ষ্য।

    মুয়ায ইবনু জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন আমল সম্পর্কে অবহিত করুন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে।’ ....... [মুসনাদ আহমাদঃ ৫/২৩০, সুনাম তিরমিযী, হাদীস নং- ২৬১৬]

    জাবের ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘আমি যদি ফরয সালাতসমূহ আদায় করি, রমদানের সাওম পালন করি, হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম বলি, আর এর অতিরিক্ত আর কোন আমল না করি, তাহলে কি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব?’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ।’’ [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১৫]

    এভাবে দেখা যায় যে, ইসলামের প্রথম প্রজন্ম তথা সাহাবাদের আগ্রহ, কামনা-বাসনা সবই ছিল আখিরাতমুখী। তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা ছিল একটাই, ‘‘কিভাবে জাহান্নাম থেকে নাজাত পাব এবং জান্নাত লাভ করতে পারব?’’ এ জিজ্ঞাসার উত্তরের মধ্যেই নিহিত ছিল তৎকালীন শিক্ষাদান, শেখা ও শিখন ফল তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাক্রমের প্রকৃত অবয়ব।

    আল্লাহ তায়ালা যখন আদম আলাইহিস সালামকে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠালেন তখন তাঁকে ও তাঁর পরবর্তী বংশধরকে শিক্ষাক্রমের এমনই দিক নির্দেশনা দিয়ে বলেছিলেন,

    ﴿فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدىً فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ﴾

    ‘‘আর আমার পক্ষ হতে তোমাদের কাছে হিদায়াত এলে যারা সে হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’’ [সূরা আল-বাকারাহঃ ৩৮]

    আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি ও আখিরাতে সফলতার পূর্বশর্ত হলো আল্লাহর হিদায়াতের অনুসরণ। আর হিদায়াত তো শুধু অহীর মাধ্যমে অর্জন করা যায়। অনুরূপভাবে অহীর জ্ঞান ভালভাবে না বুঝলে তা অনুসরণ করা যায় না এবং একমাত্র শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই সে জ্ঞান মানুষ অনুধাবন করতে পারে। এজন্যই ইসলাম শিক্ষার প্রতি চূড়ান্ত গুরুত্বারোপ করেছে এবং একে ফরয বলে ঘোষণা করেছে। ইসলাম দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণকর সকল জ্ঞান অর্জনের প্রতিই গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে দুনিয়া হলো আখিরাতের সফলতা লাভের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কর্মক্ষেত্র। সে প্রস্ত্ততি গ্রহণের জন্য আল্লাহর হিদায়াত ও guidance -কে সঠিকভাবে বোঝা, উপলদ্ধি করা ও আমল করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ সাধন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাক্রমের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।

    আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় দু’টি ধারা বহমান। একটি হলো সাধারণ শিক্ষা ও অপরটি হলো মাদরাসা শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে সকল প্রকার জাগতিক উন্নতি সাধন। এ লক্ষ্যেই বার বার ঢেলে সাজানো হয়েছে আমাদের সকল স্ত্তরের শিক্ষাক্রমকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও খোলা হয়েছে আধূনিক সব বিষয়। পার্থিব উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখছে না বলে ধর্মীয়, বিশেষ করে ইসলাম শিক্ষাকে ধীরে ধীরে সাধারণ শিক্ষাক্রম থেকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা চলছে। এ Common objective -এর পাশাপাশি আমরা দেখি যে, দেশের শাসকশ্রণী, কর্তৃত্বলোভী বহিঃশক্তি, রাজনৈতিক দলসমূহ, এনজিওসমূহ, পরিবার, শিক্ষক ও ছাত্র প্রত্যেকেরই শিক্ষা বিষয়ে নিজ নিজ বিশেষ লক্ষ্য রয়েছে। বিদেশী শক্তি আমাদের শিক্ষাক্রমে তার সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। শাসক শ্রেণী তথাকথিত ‘‘সৎ নাগরিক’’ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে শিক্ষাক্রমকে নিজেদের মনমত সাজিয়ে নিচ্ছে, রাজনৈতিক দলসমূহ নিজেদের চিন্তা-চেতনা ও আদর্শকে প্রচার করার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রকে উপযোগী ময়দান হিসেবে গ্রহণ করছে, শিক্ষকগণ একে অর্থোপর্জনের হাতিয়ার মনে করছেন, পরিবার শিক্ষাকে তার সন্তানের ভবিষ্যতের গ্যারান্টি মনে করছে এবং শিক্ষা লাভ করে একজন ছাত্র ভাল কোন পদে চাকরি করাকেই লক্ষ্য হিসেবে স্থির করছে।

    মাদরাসার শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যদিও ইসলামী চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা, কিন্তু সেখানে পার্থিব শিক্ষার সাথে যথেষ্ট সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। মাদরাসাসমূহ সত্যিকার ভাল আলেম ও ‘ইনসান কামেল’ উপহার দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে এ ধারণা যে কারো জন্মাতে পারে যে, শিক্ষার এ ধারায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম আজো তৈরি করা হয়নি।

    লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাক্রম ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাক্রমের মধ্যে পার্থক্য উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

    দ্বিতীয়ত: শিক্ষার Contents ও সিলেবাসের পার্থক্য:

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার উপকরণ ও বিষয়সমূহ এতটাই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল যে, তাতে উম্মাহর পরিচয় বিশ্ববাসীর সামনে ফুটে উঠত, উম্মাহর স্বাতন্ত্র্যবোধ ও আত্মমর্যাদা প্রকাশ পেত এবং সে শিক্ষা মুসলিম-অমুসলিম জগতের সকল মানুষের খেদমত ও কল্যাণ সাধন করত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষালয়ে তাঁর সাহাবা ছাত্রগণ ধর্মীয় প্রকৃত শিক্ষা যেমন অর্জন করতেন, তেমনি সে যুগের উপযোগী সকল প্রয়োজনীয় জ্ঞানও তাঁরা লাভ করতেন।

    এ শিক্ষালয় থেকে যেমন তৈরি হয়েছিল ইবনু আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো মুফাসসির, ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো ফকীহ, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো মুহাদ্দিস এবং এরকম আরো হাজার হাজার ব্যক্তিত্ব, তেমনি এ শিক্ষালয় থেকে তৈরি হতে দেখেছি বহু সফল সেনাপতি, সৈনিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ প্রমুখ।

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাক্রমের যে সিলেবাস ছিল, তা এতই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল যে, তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিতরা কখনো পরষ্পরের প্রতি কাদা ছোঁড়ছুড়িতে লিপ্ত হত না, বরং তা ছিল এক ধারার শিক্ষা - পার্থিবতা ও পরলৌকিকতার সমন্বয়ে গড়া একমুখী শিক্ষা।

    আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা দ্বিমুখী শিক্ষার অস্তিত্ব দেখতে পাই। শিক্ষার contents ও সিলেবাসের বিভিন্নতায় আমাদের দেশের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় একদল গড়ে উঠছে নাস্তিকরূপে, আরেক দল গড়ে উঠছে ধর্মনিরপেক্ষরূপে এবং সত্যিকার ধার্মিক মুসলিমরূপে গড়ে উঠছে খুবই কম। পারিবারিক শিক্ষার ছোঁয়ায় অনেকে হয়ত ইসলামী কিছু আকীদা ও নিয়ম-কানুন রপ্ত করেছেন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষাক্রমের সর্বস্তরে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো আজ আর শেখার উপায় নেই।

    মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা যদিও সবাই ইসলামী হয়েই গড়ে উঠার কথা, কিন্তু দেখা যায় এখানকার সিলেবাসে এমন কিছু রয়েছে যা সঠিক আকীদার জ্ঞানের দিকে পরিচালিত করে না। আবার প্রয়োজনীয় এমন অনেক কিছুর ঘাটতি রয়েছে যা সিলেবাসভূক্ত হলে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যেত। পাশাপাশি সাধারণ বিষয়গুলো এখানে ব্যাপকভাবে উন্নত করা প্রয়োজন।

    তৃতীয়ত : শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকারী এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানগত পার্থক্য

    নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাক্রম প্রণয়নকারী, বাস্তবায়নকারী ও শিক্ষক ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং। একটি হাদীসে তিনি বলেছেন,

    ولكن بعثني معلما

    ‘‘আমাকে আল্লাহ শুধু শিক্ষক হিসাবেই প্রেরণ করেছেন।’’ [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৭৬৩ ]

    তিনি এমনই শিক্ষক ছিলেন যিনি আল্লাহর রাসূল, যাঁর কাছে অহীর মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ আসত অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে সরাসরি গাইড করতেন। চারিত্রিক সততায় তিনি ছিলেন চলন্ত কুরআন। তাঁকে দেখেই শেখা যেত অনেক কিছু, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে তাঁর শিক্ষার্থীদের শেখাতেন প্রয়োজনীয় আকীদা, আমল এবং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র উন্নয়নের পদ্ধতি। সর্বোপরি এ শিক্ষাক্রমের শিক্ষক হিসাবে তিনি ছিলেন জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।

    অন্যদিকে আমাদের যারা শিক্ষকবৃন্দ তারা সাধারণ মানুষ, যাদের রয়েছে অনেক জ্ঞানের ঘাটতি ও গুণের অভাব। তদুপরি বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের অনেকেরই আজ আর বিবেকের তাড়না নেই, হৃদয়ের প্রশস্ততা নেই, শিক্ষকতার দায়িত্ব যথার্থভাবে পালনের উন্নতবোধ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তাঁরই সহচরবৃন্দ সাহাবাগণ, যারা এ উম্মতের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ, উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ও ব্যবহারিক জীবনে মানবতার কল্যাণে তা বাসত্মবায়ন করার জন্য ছিলেন সদা উন্মুখ। সেজন্য আল্লাহ তাদের প্রশংসায় বলেছেন,

    ﴿رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ﴾

    ‘‘আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।’’ (সূরা আত-তাওবাহঃ ১০০)

    আর আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের যারা ছাত্র তাদের কতজন আদর্শ শিক্ষার্থীর গুণে গুণান্বিত তা রীতিমত গবেষণা করেই বের করতে হবে। জ্ঞান অন্বেষণ, চারিত্রিক মাধুর্য ও নৈতিকতা অর্জণ এবং ধর্মীয় আকীদা ও মূল্যবোধ লালন করা আজ তাদের অধিকাংশের শিক্ষা জীবনের মূল লক্ষ্য নয়, বরং পরীক্ষায় ভালভাবে উত্তীর্ণ হওয়া, সার্টিফিকেট লাভ করা ও ভাল চাকুরী করা তাদের প্রধানতম উদ্দেশ্য।

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষাক্রম ও আমাদের বর্তমান শিক্ষাক্রমের মধ্যে উপরোক্ত তিনটি ক্ষেত্রের পার্থক্যগুলো অনুধাবন করলে সহজেই বুঝা যাবে যে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় সত্যিকার ‘ইনসাফ কামিল’ তৈরিতে তেমন সফলকাম হতে পারেনি।

    নিচে শিক্ষাক্রমের ব্যর্থতার কারণগুলো উল্লেখ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষাক্রমের সাফল্যের কারণগুলো উল্লেখ করছি। আশা করি এতে আমাদের অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।

    আমাদের শিক্ষাক্রমের ব্যর্থতার কারণঃ

    ১. উম্মাহর পরিচয়বাহী শিক্ষাক্রমের সঠিক লক্ষ্য স্থির করার অভাব।

    ২. শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির কাল থাবা সম্প্রাসরণ এবং কলুষিত রাজনীতি দ্বারা শিক্ষাকেও কলুষিত করার অপচেষ্টা। এর ফলে আমাদের শিক্ষা খাতে নিমণবর্ণিত বিপর্যয় ঘটে গেছেঃ

    ক. শিক্ষাক্রমকে রাজনৈতিক নেতাদের Ideology অনুযায়ী ঢেলে সাজানো হয়েছে, যা উম্মাহের আশা-আকাঙ্খা ও পরিচয়ের প্রতিফলন বহন করে না।

    খ. জাতিকে সত্যিকারভাবে জ্ঞানসমৃদ্ধ, স্বাধীন ও বিবেকবান সত্ত্বারূপে না গড়ে এক রকম অজ্ঞতার অন্ধকারে তাদেরকে ফেলে রাখা হয়েছে, যাতে তারা পরাধীন মানসিকতা ছেড়ে স্বাধীন জাতিরূপে জেগে উঠতে না পারে।

    গ. দ্বীন ও ইসলামের মাধ্যমে জাতির সকল মানুষের যে বিশাল উন্নতি ও কল্যাণ সাধিত হতে পারত, সে সম্পর্কে জাতিকে ভ্রামত্ম করে ইসলামের বিরুদ্ধে শিক্ষিতদের ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছে এবং দ্বীনকে অপাংক্তেয় করে তোলা হয়েছে।

    ৩. বিদেশী ঔপনিবেশিক দেশসমূহকে আমাদের শিক্ষাক্রমে হাত লাগানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে এবং তাদের মানসিক সেবাদাস তৈরি করার মতো শিক্ষাক্রম তৈরি করা হচ্ছে।

    ৪. নিছক বৈষয়িক কারণেই শুধু শিক্ষা অর্জন করা। ফলে শিক্ষা মানুষকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পশুতে পরিণত করছে।

    ৫. মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও আমাদের নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও আকীদাগত বিভেদ-বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায়।

    ৬. নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা।

    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাক্রমের সাফল্যের কারণ:

    ১. এ শিক্ষাক্রমের সুস্পষ্ট লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল, যা ছিল মহান, শ্রেষ্ঠ ও কল্যাণকামী।

    ২. শিক্ষা ছিল সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, তা হচ্ছে দ্বীন ও দুনিয়া উভয় জগতে সমগ্র মানবতার কল্যাণ সাধন।

    ৩. শিক্ষকের নিষ্ঠা, ইখলাস ও জ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি তার বিনয় এবং শিক্ষাদানকে মহান আল্লাহর ইবাদাত হিসেবে গ্রহণ করা।

    ৪. উম্মতের বৈশিষ্ট্য ও পরিচয়ের সাথে শিখন বিষয়সমূহ ও Contents-এর সমন্বয় ও সঙ্গতি সাধন।

    ৫. শিক্ষাক্রমের সাথে জড়িত সকলের সাংস্কৃতিক ও আকীদাগত অভিন্নতা।

    ৬. জ্ঞানসমৃদ্ধ স্বাধীন বিবেকবান সত্তা ও জাতিরূপে গড়ে তোলার নিরমত্মর চেষ্টা ও সাধনা।

    পরিশেষে বলবো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শ্রেষ্ঠ, সুন্দর ও চিরআধুনিক সফল শিক্ষাক্রম থেকে আমাদের শেখার ও নেয়ার অনেক কিছুই আছে। যদি আমরা তার শিক্ষাক্রমকে সামনে রেখে আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে পারি তাহলেই আমাদের স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশ ঘটবে।

    ক্যাটাগরিসমূহ