মুসলিম নারীর অবশ্য পালনীয় কতিপয় আমল
أعرض المحتوى باللغة العربية
একজন মুসলিম নারী যখন দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা পেতে চান তখন তার কিভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এ প্রবন্ধে।
মুসলিম নারীর অবশ্য পালনীয় কতিপয় আমল
الأعمال التي يجب على المرأة المسلمة الاعتناء بها
< بنغالي >
কামাল উদ্দিন মোল্লা
كمال الدين ملا
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
মুসলিম নারীর অবশ্যই পালনীয় কতিপয় আমল
হে মুমিনা! উত্তম চরিত্র হলো আপনার জীবনের ভিত্তিস্বরূপ। এর ওপরই নির্ভর করছে আপনার সুখ ও সমৃদ্ধি। যদি আল্লাহ রাব্বুল 'আলামীন আপনাকে উত্তম চরিত্রে ভূষিত করেন, তাহলে সব ধরনের কল্যাণ পেয়ে যাবেন। আর যদি তা থেকে বঞ্চিত হোন, তাহলে যেন সব ধরনের কল্যাণ হতে বঞ্চিত হয়ে গেলেন। কোনো এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করেছিলেন, উত্তম আমল কী? তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন:
«البر حسن الخلق».
“উত্তম চরিত্রই হচ্ছে উত্তম কাজ।" (সহীহ মুসলিম)
আবার যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোন গুণের কারণে মানুষ বেশি বেশি জান্নাতে প্রবেশ করবে? উত্তরে তিনি বললেন:
«تَقْوَى اللهِ تَعَالَى، وَحُسْنُ الْخُلُقِ».
“আল্লাহ তাআলার তাকওয়া এবং উত্তম চরিত্র।" (সুনান তিরমিযী)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন:
«إنَّ مِنْ أحَبِّكُمْ إلَيَّ وَأقْرَبُكُمْ مِنِّيْ مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أحْسَنُكُمْ أخْلَاقًا».
“তোমাদের মধ্যে যারা চারিত্রিক গুণে উত্তম, তারাই আমার কাছে প্রিয়তর এবং কিয়ামত দিবসে তারাই সবচেয়ে আমার নিকটবর্তী হবে।" (সহীহ বুখারী)।
«إنَّ الْعَبْدَ لَيَيْلُغُ بِحُسُنِ خًلًقِهِ عَظِيْمً دَرَجَاتِ الأخِرَةِ وَشَرْفُ الْمَنَازِلِ، وَإنهُ لَضَعِيْفُ الْعِبَادَةِ» . رواه الطبراني
“নিশ্চয় কোনো কোনো বান্দা তার উত্তম চরিত্রের কারণে আখিরাতে উচু মাকাম লাভ করবে, যদিও সে ইবাদতে দুর্বল।" (তাবরানী, উত্তম সনদে বর্ণিত)
আর উত্তম চরিত্র গঠন করতে হলে মুজাহাদা বা প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কষ্ট ও মেহনত করে নিজের মধ্যে ঐ সকল চারিত্রিক গুণাবলীর সমাবেশ ঘটাতে এবং সবসময় সেভাবে চলার চেষ্টা করবেন। ইন-শাআল্লাহ এই উত্তম চরিত্রের কারণেই আপনি জয়যুক্ত হবেন। মনে রাখবেন সম্মান রয়েছে উত্তম চরিত্রের মধ্যেই। এখানে কয়টি উত্তম চরিত্রের দিক আলোচনা করা হলো।
১. সবর বা ধৈর্য: তা হচ্ছে সর্বদা নিজকে আনুগত্যের মধ্যে আবদ্ধ রাখা। কোনো রকম অলসতা ও ক্লান্তি ব্যতীতই ভালো কাজগুলো করতে থাকুন এবং নিজেকে গুনাহের কাজ হতে বিরত রাখুন। আর সব ধরণের চারিত্রিক ত্রুটি যেমন মিথ্যা বলা, আমানতের খিয়ানত, প্রতারণা, অহংকার, কৃপণতা প্রভৃতি থেকে নিজেকে বিরত রাখা। আল্লাহর শরী'আতের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রদর্শন, আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট তাকদীরের ওপর সন্তুষ্ট না থাকা, ইত্যাদি হতে নিজকে বিরত রাখুন।
আল্লাহ তা'আলা বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱصۡبِرُواْ وَصَابِرُواْ وَرَابِطُواْ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٢٠٠ ﴾ [ال عمران: ٢٠٠]
“হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য ধর ও ধৈর্যে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা সফল হও।" [সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ২০০]
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٥٣ ﴾ [البقرة: ١٥٣]
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।" [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৩]
২. উত্তম ব্যবহার: যে সমস্ত আজেবাজে কথা শুনেন কিংবা কাজ দেখেন তা থেকে আত্মরক্ষা করুন এবং নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখুন। খারাপ কথার দ্বারা খারাপ কাজের প্রতিবাদ করবেন না; বরং খারাপ কাজকে সংশোধন করবেন ভালো দ্বারা, উত্তম কথার মাধ্যমে। যদি বাড়ির লোকেরা আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং আপনাকে অপছন্দ করে তাহলে তাদের প্রতি আপনি দয়া ও মমতা দেখান এবং নম্রভাবে তাদের উত্তর দিন। যদি তারা আজেবাজে গালি-গালাজ করে তাহলে তাদের উত্তর দিন সুন্দর কথার দ্বারা। আর নিজের কথা-বর্তাকে মার্জিত করতে সচেষ্ট হউন। এ রকম ব্যবহারের দ্বারাই আপনি তাদের অন্তর জয় করতে পারবেন। ফলে, অতি সহজেই তাদের ভালোবাসার পাত্রী হয়ে যাবেন। তাদের নৈকট্য হাসিল করতে পারবেন এবং তারাও আপনার সাথে উত্তম ব্যবহার করবে।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেন:
﴿خُذِ ٱلۡعَفۡوَ وَأۡمُرۡ بِٱلۡعُرۡفِ وَأَعۡرِضۡ عَنِ ٱلۡجَٰهِلِينَ ١٩٩ ﴾ [الاعراف: ١٩٩]
“তুমি ক্ষমা প্রদর্শন কর এবং ভালো কাজের আদেশ দাও। আর মূর্খদের থেকে বিমুখ থাক।" [সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১৯৯]
﴿ٱدۡفَعۡ بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ فَإِذَا ٱلَّذِي بَيۡنَكَ وَبَيۡنَهُۥ عَدَٰوَةٞ كَأَنَّهُۥ وَلِيٌّ حَمِيمٞ ٣٤ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ٱلَّذِينَ صَبَرُواْ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٖ ٣٥﴾ [فصلت: ٣٤، ٣٥]
“আর ভালো-মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে প্রতিহত কর তা দ্বারা যা উৎকৃষ্টতর, ফলে তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা রয়েছে সে যেন হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এটি তারাই প্রাপ্ত হবে, যারা ধৈর্যধারণ করবে আর এর অধিকারী কেবল তারাই হয় যারা মহাভাগ্যবান।" [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩৪-৩৫]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তা'আলা বলেন:
﴿فَٱصۡفَحۡ عَنۡهُمۡ وَقُلۡ سَلَٰمٞۚ فَسَوۡفَ يَعۡلَمُونَ ٨٩ ﴾ [الزخرف: ٨٩]
“অতএব, তুমি তাদেরকে এড়িয়ে চল এবং বল, সালাম। তবে তারা শীঘ্রই জানতে পারবে। [সূরা আয-যুখরু, আয়াত: ৮৯]
৩. লজ্জা: নিজকে এই বিশেষগুণে ভূষিত করুন। কারণ, তা ঈমানের অঙ্গ। এর মধ্যে রয়েছে সকল প্রকার ভালো আমল ও উত্তম কথার সমাহার। তাই আল্লাহ রাব্বুল 'আলামীনকে সত্যিকারভাবেই লজ্জা করুন। তিনি যেন আপনাকে ঐ কাজ করতে না দেখেন, যা তিনি অপছন্দ করেন। আর ফিরিশতাদেরকেও লজ্জা করুন। আর একাকী অবস্থায় কিংবা বাথরুমে যতটা না হলে নয় তার থেকে বেশি কাপড় খুলবেন না। নিজের স্বামীকে এবং পরিবারের লোকদেরকে এবং সমস্ত মানুষদের থেকে লজ্জা করতে চেষ্টা করুন। আজেবাজে কথা বলবেন না। অশ্লীল কথা যেন মুখ দিয়ে বের না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখবেন। এমন কোনো কাজ করবেন না অথবা এমন কোনো কথা বলবেন না, যা আপনার সম্ভ্রমকে ধূলিসাৎ করে দেয়। কারণ লজ্জার সবটুকু উত্তম তা কেবল মঙ্গল বয়ে আনে। নিজের কথা-বর্তাকে সুন্দর করুন। দৃষ্টিকে হিফাযত করুন। কোনো অবস্থাতেই চুল খোলা রাখবেন না। ওড়না দিয়ে সর্বদা মাথা ঢেকে রাখুন।
﴿ وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ وَلۡيَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّۖ﴾ [النور: ٣١]
“আর মু'মিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে।" [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩১]
হে মুমিনা! জেনে রাখুন, আপনার অবশ্যই পালনীয় কতিপয় কাজ রয়েছে। যা পালনে আপনার জীবনকে সুসংগঠিত করবে এবং এগুলি আপনাকে পূর্ণতা দান করবে। এর উপরই ভিত্তি করে গড়ে উঠবে আপনার জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ। এর দ্বারাই আপনার মধ্যে আসবে ইখলাস, আপনি হবেন সত্যবাদিনী।
নিম্নে সেগুলোর বিবরণ দেওয়া হলো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট দো'আ করি, তিনি যেন আপনাদের সঠিক জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার তাওফীক দান করেন এবং আমল করার তাওফীক দেন। পালনীয় কাজগুলো খুবই সহজ যদি আল্লাহ তা'আলা আপনার জন্য তা সহজ করে দেন। তাই এ কাজগুলো পালন করার জন্য আল্লাহর তাওফীক কামনা করুন।
১. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সর্বদা সঠিক সময়ে আদায় করতে চেষ্টা করুন। রুকু, কিয়াম, সাজদাহ, বৈঠক সঠিকভাবে আদায় করবেন। প্রতিটি অঙ্গের মধ্যে খুশু আনতে চেষ্টা করবেন। সালাতে দাঁড়িয়ে চোখকে সিজদার স্থানে রাখবেন। সালাতের পর যে সমস্ত যিকির রয়েছে তা পাঠ করুন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, তিনবার اسْتَغْفِرُاللهً (আসতাগফিরুল্লাহ) পাঠ করা। তারপর বলুন:
«اَللَّهُمَّ أنْتَ السَّلَامُ وَمِنْكَ السَّلَامُ تَبَارَكْتَ يَاذَا الْجَلَالِ وَالْإكْرَامِ».
“হে আল্লাহ তুমি শান্তি দাতা, তোমার থেকেই শান্তি। হে মহাপরাক্রম ও সম্মানের অধিকারী! তুমি বরকতময়।"
তার পর তিনবার নিচের দো'আটি পাঠ করুন।
«اَللَّهُمَّ أعِنِّيْ عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ».
“হে আল্লাহ! তোমার যিকির, শোকর ও সুন্দর পদ্ধতিতে ইবাদতের ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করো।"
এরপর বলুন:
«لآ إلَهَ إلَّا اللهُ وَحْدَهُ لا شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَئيٍ قَدِيْرٌ».
“আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক্ব ইলাহ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। তাঁরই রাজত্ব আর প্রশংসা তাঁরই।"
এরপর পাঠ করুন:
«اَللَّهُمَّ لَا مَانِعَ لِماَ أعْطَيْتَ وَلَا مُعْطِيَ لَماَ مَنَعْتَ وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الُجَدِّ مِنْكَ الُجَدُّ».
“হে আল্লাহ! তুমি যা দিতে চাও, তা কেউ ঠেকাতে পারবে না। আর কেউ কোনো জিনিস দিতে পারে না যদি তুমি না চাও। প্রতিপত্তির অধিকারীর প্রতিপত্তিও তোমার (পাকড়াও) থেকে বাঁচতে কিছুই করতে পারে না।"
তারপর পাঠ করুন:
«لآإلَهَ إلَّا الله وَلَا نَعْبُدُ إلَّا إيَّاه لَهُ النِّعْمَةُ وَلَهُ الْفَضْلُ وَلَهُ الثَّنَاء الُحَسَنُ الُجَمِيْلُ وُهُوَعَلَى كُلِّ شَيْئٍ قَدِيْرٌ».
“আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো হক্ব মা'বুদ নেই, আমরা একমাত্র তারই ইবাদত করি। সমস্ত নি'আমতের ও প্রতিদানের মালিক তিনিই। তারই জন্য উত্তম ও সুন্দর প্রশংসাসমূহ এবং তিনি সমস্ত বস্তুর ওপর ক্ষমতাবান।"
তারপর ৩৩ বার সুবহান্নাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করুন।
সর্বশেষ পাঠ করুন:
«لآإلَهَ إلَّا الله وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيئٍ قَدِيْرٌ».
“আল্লাহ এক, তাঁর কোনো শরীক নাই। রাজত্ব একমাত্র তাঁরই এবং সকল প্রশংসা। তিনি সমস্ত বস্তুর ওপর ক্ষমতাবান।"
সর্বদা সুন্নাতে মুআক্কাদাহসমূহ আদায় করুন। ফজরের পূর্বে ২ রাকাত, জোহরের পূর্বে ৪ রাকাত এবং পরে ২ রাকাত, মাগরিবের পরে ২ রাকাত এবং এশার পর ২ রাকাত সুন্নত এবং বিতর।
২. যদি বিবাহিত হন, তাহলে স্বামীর অনুগত থাকবেন এবং অবিবাহিত হলে মাতা-পিতার অনুগত থাকবেন। এর মধ্যে রয়েছে: তাদের কথা শ্রবণ করা এবং তাদের হুকুম প্রতিপালন করা এবং তাদের সাথে সুন্দরভাবে এবং নীচু স্বরে আদবের সাথে কথা বলা, তাদের সাথে অনর্থক ঝগড়া-ফাসাদ কিংবা রাগারাগি না করা। যদি কোনো ভুল হয়, তাহলে তাদের নিকট ক্ষমা চাওয়া এবং ওযর পেশ করা। সর্বদা তাদের সাথে হাসি-খুশী দেখা সাক্ষাত ও কথা-বার্তা বলা।
৩. আপনি যদি সন্তানের মা হন, তাহলে সন্তানের উত্তমরূপে প্রতিপালন করবেন। এর মধ্যে রয়েছে তাদের উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করা, তাদের চরিত্র গঠন ও সংশোধন করা। তাদেরকে ধীরে ধীরে উত্তম কথা ও কাজে অভ্যস্ত করে তোলা। যেমন, প্রতিজ্ঞা পালন, সত্য কথা বলা, আজেবাজে কথা ও কাজ হতে বিরত থাকা। সাথে সাথে তাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সচেষ্ট থাকবেন এবং তাদের পোশাক পরিচ্ছদ পরিস্কার রাখবেন।
৪. আপনার ওপর দায়িত্ব হচ্ছে, বাড়িকে সুন্দরভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা। জিনিসপত্রসমূহ সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা, খাদ্য দ্রব্য ইত্যাদি তৈরী করা। ছেড়া পোশাক রিপু করা, বসার জায়গাসমূহ ধৌত ও পাক-পবিত্র রাখা। আর অন্যান্য কাজগুলি করবেন ধীরস্থিরভাবে, কোনো রকম চেচামেচি কিংবা তাড়াহুড়ো করবেন না, যাতে অন্যের শান্তিতে কোনো বিঘ্ন অথবা কারো কোনো দুঃখ-কষ্টের কারণ না হয়ে দাড়ান।
৫. মাতা-পিতার হক্ক আদায় করা এবং আত্মীয় স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার করা। এগুলো খুব গুরুত্ববহ ওয়াজিব। কারণ, এদের সন্বন্ধে আল্লাহ রাব্বুল 'আলামীন তার পবিত্র কিতাবে হুকুম করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসেও বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তা'আলা বলেন:
﴿وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗا﴾ [الانعام: ١٥١]
“এবং তোমরা মাতা পিতার সাথে সদ্ব্যবহার কর।" [সূরা আল-আন'আম, আয়াত: ১৫১]
﴿أَنِ ٱشۡكُرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيۡكَ إِلَيَّ ٱلۡمَصِيرُ ﴾ [لقمان: ١٤]
“সুতরাং তুমি আমার প্রতি এবং তোমার মাতা পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।" [সুরা লুকমান, আয়াত: ১৪]
﴿وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ ٱلَّذِي تَسَآءَلُونَ بِهِۦ وَٱلۡأَرۡحَامَۚ﴾ [النساء: ١]
“এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আরও তাকওয়া অবলম্বন কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে।" [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১]
সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
«الشِّرْكُ باللهِ وَعُقُوْقُ الْوَالدَيْنِ».
“আল্লাহর সাথে শির্ক করা এবং মাতা পিতার অবাধ্য হওয়া।" (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন:
«لا يَدْخُلُ الْجنَّةَ قَاطِعُ رَحْمٍ».
“আত্মীয়তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।"
মাতা পিতার সাথে ভালো ব্যবহারের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ভালো কাজে তাদের কথা মান্য করা, তাদেরকে কোনো কষ্ট না দেওয়া, তাদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করা।
আত্মীয়তার সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে, তাদের খোঁজ খবর নেওয়া, তাদের বাড়িতে যাওয়া, তাদের সাহায্য করা, তাদের আনন্দ উৎসবে যোগদান করা আর দুঃখ-কষ্টে সমবেদনা জানান, কথা ও কাজে তাদের কোনো রকম কষ্ট না দেওয়া।
৬. আপনি নিজের লজ্জা সম্ভ্রমের হিফাযত করবেন, কণ্ঠস্বরকে সংযত করবেন, চোখের দৃষ্টি হিফাযত করবেন। বিশেষ প্রয়োজন দেখা না দিলে ঘর হতে বের হবেন না। দরজা, বারান্দা কিংবা জানালার সম্মুখে দাড়াবেন না। ব্যালকনি কিংবা ছাদে ঘুরাফিরা না করা। আপনার যে সকল গায়ের মাহরাম আত্মীয় রয়েছে, তাদেরকে আপনার সাথে দেখা-সাক্ষাতের কিংবা পর্দা লংঘনের জন্য অনুমতি দেবেন না। তাদের সাথে একাকী অবস্থান করবেন না। তাদের সাথে হাতে হাত মিলাবেন না। কারণ, তারা গায়েরে মাহরাম আত্মীয় স্বজন। আর আপনার বাড়িতে যদি কোনো মেহমান থাকে, সে যেন আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে না পায়।
মহিলাদের মধ্যে যারা দাইউস লজ্জাহীনা তাদের কণ্ঠস্বরই মেহমানরা শুনতে পায়, যদিও সে তার নিজের কক্ষে কথা বলে। অর্থাৎ লজ্জাহীন নারীরাই জোরে কথা বলে। কারণ, মহিলাদের মধ্যে সর্বোত্তম গুণ হচ্ছে, “তারা পুরুষদের দেখবে না আর পুরুষরাও তাদের দেখতে পাবে না।"
৭. প্রতিবেশিনী মেয়েদের খোজ খবর নেওয়া এবং তাদের প্রতি দরদ ও সহানুভূতি দেখানো। তাদেরকে কোনো রকম কষ্ট না দেওয়া। যদি তাদের প্রয়োজন হয়, তাহলে তাদের সাহায্য সহায়তা করা। তাদেরকে হাদিয়া দেওয়া, যদিও তা হাড্ডিযুক্ত এক টুকরা গোশত হয়।
কারণ, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো মহিলা যেন তার প্রতিবেশিনীকে কুদৃষ্টিতে না দেখে আর প্রয়োজনে এক টুকরা হাড্ডিযুক্ত গোশত দিয়ে হলেও তাকে যেন সাহায্য করে। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
প্রতিবেশীদের প্রতি কতিপয় আধিকার আল্লাহ ওয়াজিব করে দিয়েছেন।
﴿وَٱلۡجَارِ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡجَارِ ٱلۡجُنُبِ﴾ [النساء: ٣٦]
“এবং তোমরা সদ্ব্যবহার কর নিকট আত্মীয় প্রতিবেশী, এবং অনাত্মীয় প্রতিবেশীর সাথে।" [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৬]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে বলেছেন:
«مَازَالَ جِبْريِلُ يُوْصِيْنِيْ بِالْجَارِ حَتى ظَنَنْتُ أنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ».
“আমাকে জিব্রীল আলাইহিস সালাম প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে এতো বেশি উপদেশ দিতেন যে, মনে হতো তিনি যেন তাদেরকেই ওয়ারিশ বানাবেন।" (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
হে মুমিনা! আলোচিত বিষয়টি আপনার জন্য মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। কাজেই এগুলো পালনে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করুন এবং পালন করার জন্য সচেষ্ট হউন।
হে মুমিনা! জেনে রাখুন, আপনি ও আপনার ন্যায় মুমিনা নারীদের শরী'আতসম্মত পালনীয় কিছু আদব-কায়দা রয়েছে। আপনার ওপর দায়িত্ব হলো সেগুলো মান্য করা। সারা জীবনব্যাপী তার ওপর নিজেকে চালাতে চেষ্টা করা। এ আদব-কায়দাগুলোর মধ্যে কয়েকটি আপনাদেরকে স্বরণ করিয়ে দিচ্ছি। যা পালন আপনার জন্য উত্তম অলঙ্কারসদৃশ হবে।
১. আপনি যেকোনো কাজ করবেন তার শুরুতেই বিসমিল্লাহ বলবেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু'মিনদের জন্য জগতের সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ। যখন তিনি কোনো কাজ করতেন সর্বাবস্থাতেই আল্লাহর নাম পাঠ করতেন। কাজেই আল্লাহ তা'আলার নাম স্মরণ করুন খাবার সময়, পান করার সময়, পোশাক পরিধান করার সময়, পবিত্রতা হাসিলের সময়, অযু করার সময় অর্থাৎ সর্বাবস্থাতেই বিসমিল্লাহ্ বলুন।
২. সর্বদা আপনার পোশাক-পরিচ্ছদকে পরিস্কার রাখুন। আপনার শরীর, বাসস্থান, বিছানা, সমস্ত কিছুই পরিস্কার রাখতে চেষ্টা করুন। কারণ, পবিত্রতা ঈমানের অংশ। (সহীহ মুসলিম)
আবর্জনা ও দুর্গন্ধযুক্ত জিনিস পবিত্রতার প্রতিকূল। আপনার বাচ্চাদের পোশাক পরিচ্ছদ, তাদের শরীর, মুখ-মণ্ডল, দাঁত ইত্যাদি পাক-পরিস্কার রাখতে চেষ্টা করুন। কারণ, আপনার ওপরই রয়েছে তাদের দেখাশুনার দায়িত্ব। আর তারা ভালোভাবে গড়ে উঠবে আপনার মাধ্যমেই। তাদের জীবন হবে কল্যাণময় দু জাহানে।
৩. জামা কিংবা কামিজকে এতটা লম্বা রাখুন যেন উহা আপনার পায়ের পাতাদ্বয়কে ঢেকে রাখে এবং মাথাকে এমনভাবে কাপড় দিয়ে আবৃত করুন যেন বাহির থেকে চুল দেখা না যায়। আপনার নিজের বাড়িতে পরিবারের লোকজনের মধ্যে মাতা-পিতা, ভাই বোন ও সন্তানদের সম্মুখে এভাবেই চলাফেরা করবেন। মনে রাখবেন আপনার দেহ হতে যেন সুগন্ধি বের না হয়। আর অতিরিক্ত সাজগোছ করে বের হবেন না।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«أيُّمَا إمْرَأةٍ أَصَابَتْ بُخُوْراً فَلَا تَشْهَدَ مَعَنَا الْعِشَاءَ الأخِرَةَ».
“যে নারী সুগন্ধি ব্যবহার করেছে সে যেন এশার সালাতে অংশ গ্রহণ না করে।" (সহীহ মুসলিম)
৪. অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবেন না। কারণ, ঘর হতে বেশি বেশি বের হওয়া কখনো প্রশংসনীয় নয়; বরং ধিকৃত। এভাবে বের হওয়ার ফলে আস্তে আস্তে লজ্জা-শরম ও নম্রতা দূর হয়ে যায়। আর লজ্জা হলো ঈমানের অংশ। যখন লজ্জা চলে যাবে, তখন ধীরে ধীরে ঈমানও চলে যাবে।
৫. প্রয়োজনে ঘরের বাহিরে যাওয়া। যেমন আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে যাওয়া, উত্তম কাজ তথা ওয়াজ মাহফিল ইত্যাদিতে যোগদান করা, সালাতের জন্য মসজিদে গমন করা। তখন আপনি আপনার শরীরকে মাথা হতে পায়ের পাতা পর্যন্ত উত্তমরূপে ঢেকে বের হবেন। আপনার কোনো অলংকার যেন বাহির হতে দেখা না যায়। এমন কি বোরকার নিচের পোশাকও নয়। কারণ তা মুমিনা মহিলাদের পর্দার খেলাফ এবং শরী'আতের ও খেলাফ; আর শরীয়ত মেনে চলা হলো সমস্ত কল্যাণের মূল।
৬. দরজার সামনে এমনভাবে দাঁড়াবেন না যেন বাইরের লোক আপনাকে দেখতে পায়, এমনকি ছাদে কিংবা বারান্দায় দাড়াবেন না। কারণ, এর ফলে নানা রকম অসুবিধার সৃষ্টি হয়, শান্তির বিঘ্ন ঘটে এবং বিপদেরও সম্মুখীন হতে হয়। কাজেই আপনার রবকে খুশী করার জন্য আনন্দ চিত্তে ঘরে থাকতে অভ্যস্ত হউন। তিনি আপনাকে যা দিচ্ছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকুন।
আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে যে সমস্ত আদেশ উল্লেখ করেছেন তা পরিপূর্ণভাবে মেনে চলুন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ হলেন, মুমিনদের মা এবং জগতের সবচেয়ে উত্তম নারী। তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ রাব্বুল 'আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেন:
﴿وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ وَأَقِمۡنَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتِينَ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَطِعۡنَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ﴾ [الاحزاب: ٣٣]
“আর তোমরা নিজগৃহে অবস্থান করো, প্রাচীন জাহিলী যুগের মত নিজদেরকে প্রদর্শন করো না এবং তোমরা সালাত কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য থাক।" [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৩]
৭. যদি কোনা কারণে বাইরে যেতে হয় তা হলে রাস্তার একপাশ দিয়ে চলুন আর চলার পথে রাস্তা-ঘাটে বাজারে জনসম্মুখে খাবেন না। যাত্রা কালে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবেন না। কারণ, তা আপনার সম্ভ্রমকে নীচু করে। আপনার দীনের জন্যও ক্ষতিকর। পথে ঘাটে দেখবেন অনেক নারী খাবার খাচ্ছে, গল্প করছে, আড্ডা দিচ্ছে তাদের দেখে ধোকায় পড়বেন না। কারণ, তারা অমুসলিম নারীদেরকে তাদের আদর্শ বানিয়েছে। আপনি সর্বদা নিজের মুসলিম পরিচয়কে বুকে ধারণ করুন। এতে আপনি সকল ফিৎনা হতে রক্ষা পাবেন।
সমাপ্ত