×
ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো: আল্লাহর জন্য মানুষকে ভালোবাসা। এ প্রবন্ধটিতে আল্লাহর জন্য ভালোবাসার বিভিন্ন নিদর্শন ও আলামত কুরআন-হাদীসের আলোকে তুলে ধরা হয়েছে।

    আল্লাহর জন্য ভালোবাসার নিদর্শন

    علامات الحب في الله

    < بنغالي- Bengal - বাঙালি>

    জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের

    ذاكر الله أبو الخير

    —™

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    আল্লাহর জন্য ভালোবাসার নিদর্শনসমূহ

    আল্লাহ তা‘আলার জন্য বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা ইসলাম ও ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা যে কত বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তা সত্বেও এর গুরুত্ব আমাদের অনেকের কাছেই অস্পষ্ট। তাই বিষয়টি জানা থাকা প্রতিটি মুসলিমের জন্য খুবই জরুরি। আমরা আমাদের এ নিবন্ধে বিষয়টিকে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করব। আল্লাহই তাওফীকদাতা।

    আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব ও শত্রুতার গুরুত্ব:

    ইসলামী আকীদার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাওহীদে বিশ্বাসীদেরকে মুমিনদের ভালোবাসা এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব ও মিত্রতা অটুট রাখা। আর যারা তাওহীদে বিশ্বাস করে না, অমুসলিম কাফির- যারা তাওহীদে বিশ্বাসীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে এবং তাদের বিরোধিতা করে, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা এবং সম্পর্ক চিহ্ন করা। আর এটিই হলো ‘মিল্লাতে ইবরাহীম’ যার অনুসরণ করার জন্য আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং ইসলামের মর্ম বাণী যে ইসলামই হলো আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿قَدۡ كَانَتۡ لَكُمۡ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ فِيٓ إِبۡرَٰهِيمَ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ إِذۡ قَالُواْ لِقَوۡمِهِمۡ إِنَّا بُرَءَٰٓؤُاْ مِنكُمۡ وَمِمَّا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ كَفَرۡنَا بِكُمۡ وَبَدَا بَيۡنَنَا وَبَيۡنَكُمُ ٱلۡعَدَٰوَةُ وَٱلۡبَغۡضَآءُ أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤۡمِنُواْ بِٱللَّهِ وَحۡدَهُۥٓ إِلَّا قَوۡلَ إِبۡرَٰهِيمَ لِأَبِيهِ لَأَسۡتَغۡفِرَنَّ لَكَ وَمَآ أَمۡلِكُ لَكَ مِنَ ٱللَّهِ مِن شَيۡءٖۖ رَّبَّنَا عَلَيۡكَ تَوَكَّلۡنَا وَإِلَيۡكَ أَنَبۡنَا وَإِلَيۡكَ ٱلۡمَصِيرُ ٤﴾ [الممتحنة : ٤]

    “ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। তারা যখন স্বীয় সম্প্রদায়কে বলছিল, ‘তোমাদের সাথে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যা কিছুর উপাসনা কর তা হতে আমরা সম্পর্কমুক্ত। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি এবং উদ্রেক হলো আমাদের- তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন। তবে স্বীয় পিতার প্রতি ইবরাহীমের উক্তিটি ব্যতিক্রম: ‘আমি অবশ্যই তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব আর তোমার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি কোনো অধিকার রাখি না।’ হে আমাদের রব, আমরা আপনার ওপরই ভরসা করি, আপনারই অভিমুখী হই আর প্রত্যাবর্তন তো আপনারই কাছে।” [সূরা আল-মুমতাহিনাহ, আয়াত: ৪]

    আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

    ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُواْ ٱلۡيَهُودَ وَٱلنَّصَٰرَىٰٓ أَوۡلِيَآءَۘ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمۡ فَإِنَّهُۥ مِنۡهُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٥١﴾ [المائ‍دة: ٥١]

    “হে মুমিনগণ, ইয়াহূদী ও নাসারাদেরকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত দেন না।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৫১]

    যদি তারা তোমাদের নিকট আত্মীয়ও হয়ে থাকে তবুও তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারবে না। তোমাদের বন্ধুত্ব ও শত্রুতা হবে ঈমান ও ইসলামের ভিত্তিতে। আত্মীয়, বংশ, গোত্র বা বর্ণের ভিত্তিতে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنْ اسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الْإِيمَانِ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الظَّالِمُونَ﴾ [التوبة: ٢٣]

    “হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফুরীকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ২৩]

    আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

    ﴿لَّا تَجِدُ قَوۡمٗا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ يُوَآدُّونَ مَنۡ حَآدَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَوۡ كَانُوٓاْ ءَابَآءَهُمۡ أَوۡ أَبۡنَآءَهُمۡ أَوۡ إِخۡوَٰنَهُمۡ أَوۡ عَشِيرَتَهُمۡۚ ٢٢﴾ [المجادلة: ٢٢]

    “তুমি পাবে না এমন জাতিকে যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে, বন্ধুত্ব করতে তার সাথে যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়।” [সূরা আল-মুজাদালাহ, আয়াত: ২২]

    মুমিনদের প্রকৃত বন্ধু কারা হবেন?

    আল্লাহ তা‘আলা যেমনিভাবে ইসলামের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে নিষিদ্ধ করেছেন, এমনিভাবে মুমিনদেরকে মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব করা এবং তাদের উঠ-বস করাকে বাধ্যতামূলক করেছেন। আর মুমিনরাই হবেন মুমিনদের প্রকৃত বন্ধু। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَهُمۡ رَٰكِعُونَ ٥٥ ﴾ [المائ‍دة: ٥٥]

    “তোমাদের বন্ধু কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে বিনীত হয়ে।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৫৫]

    সুতরাং মুমিনরাই একে অপরের বন্ধু এবং সহযোগী। যদিও তাদের বংশ, গোত্র জন্মস্থান বিভিন্ন হয়ে থাকে। যদিও তাদের একজন পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে এবং অপর জন পূর্ব প্রান্তে। সীমারেখা ও অবস্থানের দুরত্ব ঈমানী ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের সামনে বাধার প্রাচীর হতে পারে না।

    মহব্বত ও শত্রতার শ্রেণিবিন্যাস:

    মহব্বত করা ও শত্রুতা রাখার ক্ষেত্রে মানুষ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত:

    এক- যাদেরকে নীরেট মহব্বত করতে হবে। তাদের প্রতি কোনো প্রকার বিদ্বেষ পোষণ করা চলবে না। তারা হলেন নবী, রাসূল, সিদ্দীক এবং শহীদগণ। এদের অগ্রভাগে রয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাকে অবশ্যই দুনিয়ার সবকিছু থেকে অধিক মহব্বত করতে হবে। তারপর রয়েছেন উম্মুহাতুল মুমিনীন, রাসূলের পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণ। সাহাবীগণের প্রথম সারিতে রয়েছেন খোলাফায়ে রাশেদীন, তারপর সু-সংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবী, তারপর বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ, তারপর বাই‘আতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণ এবং তারপর অন্যান্য সাহাবীগণ। তারপর রয়েছেন তাবে‘ঈগণ, উম্মাতের সালফে সালেহীনগণ এবং মুজতাহিদ ইমামগণ। বিশেষ করে চার ইমাম।

    দুই- যাদেরকে নীরেট ঘৃণার চোখে দেখতে হবে। সর্বাবস্থায় তাদের বিরোধিতা করতে হবে। কোনো প্রকার বন্ধুত্ব তাদের সাথে চলবে না। তারা হলেন অমুসলিম, কাফির, মুশরিক, নাস্তিক ও মুরতাদ।

    তিন- যাদের আংশিক ভালোবাসতে হবে এবং আংশিক ঘৃণা করতে হবে। তারা হলেন অপরাধী মুমিনগণ। মহব্বত ও শত্রুতা উভয়টিই তাদের ব্যাপারে একত্র হবে। তাদের মধ্যে ঈমান রয়েছে এ জন্য তাদের ভালোবাসতে হবে। আর তাদের গুণাহ ও অপরাধের কারণে তাদের ঘৃণা করতে হবে।

    কুরআন ও হাদীসের পর্যালোচনায় আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের একাধিক নিদর্শন পাওয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলার দেওয়া তাওফীক অনুযায়ী আমরা আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের নিদর্শনসমূহ কী তা নিম্নে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ!

    এক- সুখে দুঃখে সচ্চল ও অসচ্চল সর্বাবস্তায় মুমিনদের সাথে থাকা:

    আল্লাহর জন্য ভালোবাসা বা বন্ধুত্বের নিদর্শন হলো, সুখে দুঃখে সচ্চল অসচ্চল সর্ববস্তায় মুমিনদের সাথে থাকা, তাদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখা এবং তাদের সহযোগিতা করা। মুমিনদের খুশিতে খুশি হওয়া এবং তাদের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া, তাদের দুঃখে দুঃখিত হওয়া। একেই বলে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ﴾ [التوبة: ٧١]

    “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু”[সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৭১]

    তোমরা মুনাফিকদের মতো হবে না, যারা সুখে তোমাদের সাথে থাকে আর যখন তোমাদের ওপর কোনো বিপদ আসে তখন তারা পলায়ন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

    ﴿ٱلَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمۡ فَإِن كَانَ لَكُمۡ فَتۡحٞ مِّنَ ٱللَّهِ قَالُوٓاْ أَلَمۡ نَكُن مَّعَكُمۡ وَإِن كَانَ لِلۡكَٰفِرِينَ نَصِيبٞ قَالُوٓاْ أَلَمۡ نَسۡتَحۡوِذۡ عَلَيۡكُمۡ وَنَمۡنَعۡكُم مِّنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَۚ فَٱللَّهُ يَحۡكُمُ بَيۡنَكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۗ ١٤١﴾ [النساء : ١٤١]

    “যারা তোমাদের ব্যাপারে (অকল্যাণের) অপেক্ষায় থাকে, অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি তোমাদের বিজয় হয় তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না’? আর যদি কাফিরদের আংশিক বিজয় হয়, তবে তারা বলে, ‘আমরা কি তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করিনি এবং মুমিনদের কবল থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করি নি’? সুতরাং আল্লাহ কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার করবেন। আর আল্লাহ কখনো মুমিনদের বিপক্ষে কাফিরদের জন্য পথ রাখবেন না।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪১]

    এ ধরনের চরিত্র অবলম্বন থেকে বিরত থাকতে হবে। সুখে দুঃখে সর্বাবস্থায় মুমিনদের সাথে থাকতে হবে, মুমিনদেরকেই সাথী নির্বাচন করতে হবে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «لَا تُصَاحِبْ إِلَّا مُؤْمِنًا، وَلَا يَأْكُلْ طَعَامَكَ إِلَّا تَقِيٌّ»

    “তুমি মুমিন ছাড়া কাউকে সাথী বানাবে না আর তোমার খাবার যেন মুত্তাকী ছাড়া কেউ না খায়”[1]

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,

    «مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ، وَتَرَاحُمِهِمْ، وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى»

    “মুমিনদের দৃষ্টান্ত পরস্পর মহব্বত করা, দয়া করা এবং নম্রতা পদর্শন করার দিক দিয়ে একটি দেহের মতো। যখন দেহের একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয়, তার পুরো দেহই ব্যথা অনুভব করে এবং নির্ঘুম হয়”[2]

    দুই- আল্লাহর জন্য ভালোবাসার আরেকটি নিদর্শন মুমিনদের সম্মান করা:

    মুমিনদের সম্মান করা তাদের মানহানি হয় এ ধরনের গর্হিত কর্ম থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا يَسۡخَرۡ قَوۡمٞ مِّن قَوۡمٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُونُواْ خَيۡرٗا مِّنۡهُمۡ وَلَا نِسَآءٞ مِّن نِّسَآءٍ عَسَىٰٓ أَن يَكُنَّ خَيۡرٗا مِّنۡهُنَّۖ وَلَا تَلۡمِزُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَلَا تَنَابَزُواْ بِٱلۡأَلۡقَٰبِۖ بِئۡسَ ٱلِٱسۡمُ ٱلۡفُسُوقُ بَعۡدَ ٱلۡإِيمَٰنِۚ وَمَن لَّمۡ يَتُبۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ١١﴾ [الحجرات: ١١]

    “হে ঈমানদারগণ, কোনো সম্প্রদায় যেন অপর কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোন নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতইনা নিকৃষ্ট! আর যারা তাওবা করে না, তারাই তো যালিম।” [সূরা আল-হুজরাত, আয়াত: ১১]

    তিন- আল্লাহর জন্য ভালোবাসার আরেকটি নিদর্শন মু’মিদের জান-মাল দিয়ে সাহায্য ও সহযোগিতা করা:

    মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য ও সহযোগিতায় নিজের পকেট থেকে ব্যয় করা। এতে একজন মুমিনের সাথে মহব্বত বাড়ে, মহা সাওয়াবের অধিকারী হয়, মুসলিম বন্ধন সু-দৃঢ় ও মজবুত হয় এবং পারস্পরিক সম্পর্ক স্থায়ী হয়। ফলে শত্রুরা মুসলিমদের দেখে ভয় পায় এবং আতংকিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿وَإِنِ ٱسۡتَنصَرُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ فَعَلَيۡكُمُ ٱلنَّصۡرُ إِلَّا عَلَىٰ قَوۡمِۢ بَيۡنَكُمۡ وَبَيۡنَهُم مِّيثَٰقٞۗ ٧٢﴾ [الانفال: ٧٢]

    “আর যদি তারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের নিকট কোন সহযোগিতা চায়, তাহলে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। তবে এমন কওমের বিরুদ্ধে নয়, যাদের সাথে তোমাদের একে অপরের চুক্তি রয়েছে।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৭২]

    হাদীসে এসেছে,

    «بَيْنَمَا نَحْنُ فِي سَفَرٍ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ جَاءَ رَجُلٌ عَلَى رَاحِلَةٍ لَهُ، قَالَ: فَجَعَلَ يَصْرِفُ بَصَرَهُ يَمِينًا وَشِمَالًا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ كَانَ مَعَهُ فَضْلُ ظَهْرٍ، فَلْيَعُدْ بِهِ عَلَى مَنْ لَا ظَهْرَ لَهُ، وَمَنْ كَانَ لَهُ فَضْلٌ مِنْ زَادٍ، فَلْيَعُدْ بِهِ عَلَى مَنْ لَا زَادَ لَهُ» ، قَالَ: فَذَكَرَ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ مَا ذَكَرَ حَتَّى رَأَيْنَا أَنَّهُ لَا حَقَّ لِأَحَدٍ مِنَّا فِي فَضْلٍ»

    “একবার আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একটি সফরে ছিলেন। একলোক তার বাহণের উপর চড়ে উপস্থিত হলো এবং ডানে বামে চোখ ঘোরাচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “যার নিকট সাওয়ারীর অতিরিক্ত জায়গা থাকে সে যেন এমন একজনকে তুলে নেয় যার কোনো সাওয়ারী নাই। আর যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত আসবাব পত্র থাকে সে যেন যার কোনো আসবাব পত্র নেই তাকে শরীক করে নেয়”। আবু সাঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক প্রকারের প্রয়োজনীয় জিনিসের নাম উল্লেখ করলেন, তাতে আমরা দেখতে পেলাম, আমাদের কারোরই অতিরিক্ত কোনো বস্তুর মধ্যে কোনো অধিকার রইল না।[3]

    তবে বর্তমানে মুসলিমদের অবস্থার দিক তাকালে আমরা এর সম্পূর্ণ বিপরীত ও উল্টো দেখতে পাই। তারা তাদের স্বার্থের বাহিরে কোন কাজ করতে রাজি নয়। কেউ কারো সহযোগিতা করে না। একজন মানুষ মারা গেলেও তার সাহায্যে এগিয়ে আসে না।

    চার- আল্লাহর জন্য ভালোবাসার আরেকটি নিদর্শন হলো, মুমিনদের একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসা:

    মুমিনদের;ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব খুবই জরুরি। একজন মুমিন অপর মুমিনের জন্য সহায়ক। তারা একে অপরকে শক্তির জোগান দেবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضاً وَشَبَّكَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ»

    “মুমিনগণ পরস্পর একটি প্রাসাদের মতো। প্রাসাদের একটি অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার আঙ্গুলগুলো একটির মধ্যে অপরটিকে প্রবেশ করিয়ে দেখালেন।” সুতরাং একজন মুমিন অপর মুমিনের জন্য শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করবে। একজন অপর জনের সাহায্য করবে।

    পাঁচ- আল্লাহর জন্য ভালোবাসার আরেকটি নিদর্শন সে নিজের জন্য যা ভালোবাসবে অন্যের জন্যও তাই ভালোবাসবে:

    নিজের জন্য যা ভালোবাসে তা অন্যের জন্যও ভালোবাসতে হবে। অন্যথায় পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়া যাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ».

    “নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা অন্যের জন্য পছন্দ না করা পর্যন্ত তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না।”[4]

    ছয়—আল্লাহর জন্য ভালোবাসার আরেকটি নিদর্শন কাউকে হেয় করবে না খাটো করবে না:

    একজন মুসলিম ভাইকে কখনো খাটো করবে না, হেয় করবে না, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে না এবং তার ওপর বড়াই ও অহংকার করবে না। কারণ, এতে একের প্রতি অপরের ঘৃণা তৈরি হয় এবং ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ» قَالَ رَجُلٌ: إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً، قَالَ: «إِنَّ اللهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ، الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ، وَغَمْطُ النَّاسِ»

    “যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না”। জিজ্ঞাসা করা হলো, এক লোক তার কাপড়, পরিধেয় ও জুতা সুন্দর হোক তা পছন্দ করে এও কি অহংকার? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহ তা‘আলা নিজে সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। অহংকার হলো, সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা[5]।”

    দাড়ি মুণ্ডন, কাপড় টাখনুর নীচে পরা, অমুসলিম ও মহিলাদের সাদৃশ্য অবলম্বন কোনো সৌন্দর্য নয়, যাকে আল্লাহ তা‘আলা মহব্বত করেন। কারণ, এ গুলো আল্লাহর বিধানের লঙ্ঘন; এতে আল্লাহ তা‘আলা অসন্তুষ্ট হয়। খুশি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «لعن الله المتشبهات من النساء بالرجال، والمتشبهين من الرجال بالنساء»

    “যে সব নারী পুরুষদের বেশ-ভুষা অবলম্বন করে এবং যে সব পুরুষ নারীদের বেশ-ভুষা অবলম্বন তাদের আল্লাহ তা‘আলা অভিশাপ করেছেন।[6]

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,

    «ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ» قَالَ: فَقَرَأَهَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثَلَاثَ مِرَارًا، قَالَ أَبُو ذَرٍّ: خَابُوا وَخَسِرُوا، مَنْ هُمْ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: «الْمُسْبِلُ، وَالْمَنَّانُ، وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ»

    “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তিন শ্রেণির লোকের সাথে কথা বলবে না, তাদের দিক তাকাবে না, তাদের পবিত্র করবে না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। এক. টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরা ব্যক্তি। দুই. যে ব্যক্তি কোনো কিছু দান করে খোঁটা দেয়। তিন. যে ব্যক্তি তার পণ্যকে মিথ্যা কসম করে বিক্রি করে”[7] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ»

    “যে ব্যক্তি কোনো কাওমের সাদৃশ্য অবলম্বন করে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত”[8]

    এতে টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরা, নারী ও পুরুষ একে অপরের বেশ-ভূষা অবলম্বন করা ও অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বন করার পরিণতি ও শাস্তি কি তা স্পষ্ট হয়। তাই এসব গুনাহ থেকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

    সাত- মুসলিমদের ভালোবাসার আরেকটি আলামত হলো তাদের সম্মান বজায় রাখা, অসম্মান না করা:

    তুমি তোমার মুসলিম ভাইকে অসম্মান, অপমান অপদস্থ করবে না। মুসলিম ভাইয়ের সম্মানহানি হয় এমন কোনো কিছু করতে যাবে না, বরং সবসময় তার প্রশংসা করবে, তার কল্যাণকামী হবে, তুমি তোমার হাত ও মুখ দ্বারা তার সাহায্য করবে। তার কোনো ক্ষতি করবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «مَا مِنَ امْرِئٍ يَخْذُلُ امْرَأً مُسْلِمًا فِي مَوْضِعٍ تُنْتَهَكُ فِيهِ حُرْمَتُهُ وَيُنْتَقَصُ فِيهِ مِنْ عِرْضِهِ، إِلَّا خَذَلَهُ اللَّهُ فِي مَوْطِنٍ يُحِبُّ فِيهِ نُصْرَتَهُ، وَمَا مِنَ امْرِئٍ يَنْصُرُ مُسْلِمًا فِي مَوْضِعٍ يُنْتَقَصُ فِيهِ مِنْ عِرْضِهِ وَيُنْتَهَكُ فِيهِ مِنْ حُرْمَتِهِ، إِلَّا نَصَرَهُ اللَّهُ فِي مَوْطِنٍ يُحِبُّ نُصْرَتَهُ»

    “কোনো মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাই যদি এমন স্থানে অপমান করে যেখানে তার সম্মানহানি হয়, তার ইয্যতের ওপর আঘাত আসে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন জায়গায় বে-ইয্যত করবে, যেখানে সে আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার মুখাপেক্ষী। আর কোনো মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাইকে যদি এমন স্থানে সাহায্য করে যেখানে তার সম্মানহানি হয়, তার ইজ্জতের ওপর আঘাত আসে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন জায়গায় সাহায্য করবে, যেখানে সে আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার মুখাপেক্ষী”[9]

    এদের সাথে তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যারা কল্যাণ ও কল্যাণকামীদের মহব্বতের দাবিদার অথচ তারা বাতিলপন্থীদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখে না এবং যখন কোনো মজলিসে মুসলিমদের দুর্নাম করা হয়, তাদের বিরুদ্ধাচরণ বা তাদের প্রতি বিদ্রূপ করতে শোনে তখন প্রতিবাদ করে না। তাদের প্রতি কঠিন হুমকি প্রত্যক্ষ করছি। তুমিও এ বিষয়ে সতর্ক হও। কারণ, এটি অবশ্যই যুলুম, অপমান ও মানুষকে খাটো করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «المسلم اخو المسلم لايظلمه ولايخذله ولا يحقره... ».

    “একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার মুসলিম ভাইয়ের জুলুম করতে পারে না, তাকে অপমান করতে পারে না এবং তাকে হেয় করতে পারে না”[10]

    সাত- মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি আলামত হলো তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা:

    মুসলিম ভাইয়ের জন্য ক্ষমা চাওয়া, যদি কোন অন্যায় করার পর অন্যায় স্বীকার ও তওবা করে ফিরে আসে তাকে ক্ষমা ও মাপ করে দেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿وَٱسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۢبِكَ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِۗ ١٩﴾ [محمد : ١٩]

    “আর তুমি তোমার গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের জন্য।” [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৯]

    আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [الحشر: ١٠]

    “হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১০]

    আট- মুসলিমের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি আলামত মুসলিম ভাইকে ভালো উপদেশ দেওয়া:

    তুমি তাকে ভালো নসিহত করবে এবং ভালো উপদেশ দেবে, কুরআন ও সূন্নাহের আলোকে কল্যাণের পথ দেখাবে। অনেক কল্যাণের অনুসন্ধানকারী রয়েছে, তারা তাদের পথ প্রদর্শক খুঁজে পায় না। তাদের খুঁজে বের করে সঠিক পথের ওপর তুলে নিয়ে আসবে। জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    «بَايَعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، فَلَقَّنَنِي: «فِيمَا اسْتَطَعْتُ وَالنُّصْحِ لِكُلِّ مُسْلِمٍ»

    “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে শোনা ও মানার উপর বাইয়াত গ্রহণ করি। তিনি আমাদের বলে দেন- যতটুকু সম্ভব, আর প্রত্যেক মুসলিমের জন্য হিতাকাঙ্খী হওয়ার ওপর (বাইয়াত গ্রহণ করি)[11]।”

    ইমাম মুসলিম সাহাবী আবু রুকাইয়া তামীম আদ-দারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «الدِّينُ النَّصِيحَةُ» قُلْنَا: لِمَنْ؟ قَالَ: «لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُولِهِ وَلِأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ»

    “দীন হলো, নসীহত। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম কার জন্য? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য, আল্লাহর কিতাবের জন্য, তার রাসূলের জন্য, মুসলিম শাসকদের জন্য এবং সর্ব সাধারণের জন্য[12]।” কারণ, মুসলিমদের মধ্যে কল্যাণকামীতা ও হিতাকাঙ্খিতা না থাকা আল্লাহর নারাজি ও অভিশাপ লাভের কারণ হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿لُعِنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۢ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُۥدَ وَعِيسَى ٱبۡنِ مَرۡيَمَۚ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَواْ وَّكَانُواْ يَعۡتَدُونَ ٧٨ كَانُواْ لَا يَتَنَاهَوۡنَ عَن مُّنكَرٖ فَعَلُوهُۚ لَبِئۡسَ مَا كَانُواْ يَفۡعَلُونَ ٧٩﴾ [المائ‍دة: ٧٨، ٧٩]

    “বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফুরী করেছে তাদেরকে দাঊদ ও মারইয়াম পুত্র ঈসার মুখে লা‘নত করা হয়েছে। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্য হয়েছে এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত। তারা পরস্পরকে মন্দ থেকে নিষেধ করত না, যা তারা করত। তারা যা করত, তা কতই না মন্দ”!। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৭৮-৭৯]

    বর্তমানে প্রবৃত্তির পূজারীরা, তাদের প্রবৃত্তির চাহিদার পরিপন্থী কোনো কথা শোনতে রাজি নয়, তারা তাই শোনে যা তাদের প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী হয়, বরং অন্যায়কারীদের যারা বাঁধা দেয়, তাদের তারা বিরোধিতা করে, যদিও তারা আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মারাত্মক বড় কোনো গুনাহ যেমন শির্ককে বাধা দিয়ে থাকে। কারণ, তাদের নিকট তাও নাকি বিশৃঙ্খলা ও ফিতনাকে উসকে দেওয়া! আর হিকমত হলো, ফিতনাকে দাবিয়ে রাখা! একজন মুশরিক প্রকাশ্যে শির্ক করে বেড়াবে আমরা তাকে বাধা না দিয়ে শুধু মিম্বারের খুৎবা দিয়েই চুপ থাকব! এটি কি কোনো নসীহত, কল্যাণকামিতা বা হিতাকাঙ্খীতা হলো যার ওপর সাহাবীগণ রাসূলের হাতে বাইয়াত করেছিলেন?! ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন।

    নয়- মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি আলামত আল্লাহর বিধান আদায়ে সহযোগিতা করা:

    আল্লাহর বিধানের অধীনে থেকে একজন মুসলিম ভাইয়ের সাথে ভালো ব্যবহার করা এবং তার অবস্থান অনুযায়ী তার যথাযথ সম্মান করা। এ বিষয়ে আবু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,

    «أَنَّ رَجُلًا، قَالَ: وَاللَّهِ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي لَأَتَأَخَّرُ عَنْ صَلاَةِ الغَدَاةِ مِنْ أَجْلِ فُلاَنٍ مِمَّا يُطِيلُ بِنَا، فَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي مَوْعِظَةٍ أَشَدَّ غَضَبًا مِنْهُ يَوْمَئِذٍ، ثُمَّ قَالَ: «إِنَّ مِنْكُمْ مُنَفِّرِينَ، فَأَيُّكُمْ مَا صَلَّى بِالنَّاسِ فَلْيَتَجَوَّزْ، فَإِنَّ فِيهِمُ الضَّعِيفَ وَالكَبِيرَ وَذَا الحَاجَةِ»

    “এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! অমুক সালাত দীর্ঘায়িত করে এ কারণে আমি ফজরের সালাতে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকি। বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোনো ওয়াজে সেদিনের মতো এত বেশি রাগান্বিত হতে দেখি নি। তারপর তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কতক লোক আছে যারা মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। তোমাদের যে কেউ সালাতে ইমামতি করে সে যেন, সালাতকে সংক্ষেপ করে। কারণ, মুসল্লীদের মধ্যে রয়েছে দুর্বল, বুড়ো এবং কর্ম ব্যস্ত কর্মিক”[13]

    এ হাদীসটিকে অনেক সমাজকর্মী যারা সমাজকে খুশি করতে ব্যস্ত থাকে তা খুব আনন্দ এবং গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। ফলে তারা তাদের সালাতে কুরআনের শেষের সূরাগুলো যেমন, কাফিরূন, আলাম নাশরাহ ইত্যাদি সূরাগুলোই পড়েন। তাদেরকে জুমু‘আর দিনের ফজরের সালাতে সূরা সাজদাহ ও দাহার এবং জুমু‘আর সালাতে সূরা আল-আ‘লা ও সূরা আল-গাশিয়া ছাড়া আর কোনো সুন্নাত কিরাতের ওপর আমল করতে দেখা যায় না। আর অন্যান্য সালাতগুলো তারা তাদের মর্জি অনুযায়ী যে কোনো কিরাত দিয়ে পড়ে। ফলে তাদের দেখা যায় তারা একবার সূন্নাত মানে আর বহুবার ছাড়েন।

    উল্লিখিত হাদীসটিতে চিন্তা করে দেখুন, উম্মতের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া কী পরিমাণ ছিল। তিনি তাদের কষ্টকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন নি। ইমাম মুসলিম আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,

    «أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقْرَأُ فِي صَلَاةِ الظُّهْرِ فِي الرَّكْعَتَيْنِ الْأُولَيَيْنِ فِي كُلِّ رَكْعَةٍ قَدْرَ ثَلَاثِينَ آيَةً، وَفِي الْأُخْرَيَيْنِ قَدْرَ خَمْسَ عَشْرَةَ آيَةً أَوْ قَالَ نِصْفَ ذَلِكَ وَفِي الْعَصْرِ فِي الرَّكْعَتَيْنِ الْأُولَيَيْنِ فِي كُلِّ رَكْعَةٍ قَدْرَ قِرَاءَةِ خَمْسَ عَشْرَةَ آيَةً وَفِي الْأُخْرَيَيْنِ قَدْرَ نِصْفِ ذَلِكَ»

    “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোহরের সালাতের প্রথম দুই রাকাতে ত্রিশ আয়াত এবং দ্বিতীয় দুই রাকাতে পনের আয়াত পড়তেন অথবা বলল, প্রথম রাকাতের অর্ধেক পড়তেন। আর আসরের সালাতের প্রথম দুই রাকাতে পনের আয়াত এবং দ্বিতীয় দুই রাকাতে প্রথম রাকাতের অর্ধেক পরিমাণ পড়তেন”[14]

    ইমাম মুসলিম জাবের ইবন সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,

    «كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ فِي الظُّهْرِ بِاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَى، وَفِي الْعَصْرِ نَحْوَ ذَلِكَ. وَفِي الصُّبْحِ أَطْوَلَ مِنْ ذَلِكَ»

    “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোহরের সালাতে ‘সুরাতুল লাইল’ পড়তেন এবং আসরেও অনুরূপ পড়তেন। আর ফজরের সালাতে এর চেয়ে লম্বা কিরাত পড়তেন”[15]

    আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    «لَقَدْ كَانَتْ صَلَاةُ الظُّهْرِ تُقَامُ فَيَذْهَبُ الذَّاهِبُ إِلَى الْبَقِيعِ فَيَقْضِي حَاجَتَهُ. ثُمَّ يَتَوَضَّأُ. ثُمَّ يَأْتِي وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الرَّكْعَةِ الْأُولَى مِمَّا يُطَوِّلُهَا»

    “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত এত দীর্ঘ ছিল যে, জোহরের সালাতের একামত দেওয়া হত, তখন একজন ব্যক্তি বাকীতে গিয়ে হাজত পুরো করত, তারপর অযু করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সালাতের প্রথম রাকাতে উপস্থিত হত”[16]

    এ ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত জোহরের সালাতের ক্ষেত্রে। তোমরা এটিরই অনুকরণ কর। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।

    ফজরের সালাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সূন্নাত:

    ইমাম মুসলিম আবু বারযা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদীস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

    «أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يقرأ في صلاة الغداة من الستين إلى المائة»

    “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাতে ষাট থেকে একশ আয়াত তিলাওয়াত করতেন”[17]

    ইমাম মুসলিম জাবের ইবন সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

    «إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقْرَأُ فِي الْفَجْرِ بِ ق وَالْقُرْآنِ الْمَجِيدِ وَكَانَ صَلَاتُهُ بَعْدُ تَخْفِيفًا»

    “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাতে সূরা ক্বাফ ওয়াল কুরআনীল মাজিদ পড়তেন। আর পরবর্তী সালাত ছিল সংক্ষিপ্ত”[18]

    ইমাম মুসলিম আমর ইবন হুরাইস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন,

    «أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ فِي الْفَجْرِ وَاللَّيْلِ إِذَا عَسْعَسَ»

    “তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ফজরের সালাতে সূরাতুত তাকওয়ীর পড়তে শুনেছেন”[19]

    মাগরিবের সালাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত:

    ইমাম মুসলিম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

    «إِنَّ أُمَّ الْفَضْلِ بِنْتَ الْحَارِثِ، سَمِعَتْهُ وَهُوَ يَقْرَأُ وَالْمُرْسَلَاتِ عُرْفًا فَقَالَتْ: يَا بُنَيَّ لَقَدْ ذَكَّرْتَنِي بِقِرَاءَتِكَ هَذِهِ السُّورَةَ. إِنَّهَا لَآخِرُ مَا سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ بِهَا فِي الْمَغْرِبِ

    “উম্মুল ফযল বিনতে হারেস তাকে সূরা মুরসালাত পড়তে শুনে বলেছেন, হে ছেলে তুমি এ সূরাটি তিলাওয়াত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে। আমি সর্বশেষ এ সূরাটি মাগরিবের সালাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পড়তে শুনেছি”[20]

    ইমাম মুসলিম মুহাম্মাদ ইবনে জুবায়ের ইবন মুত‘ঈম থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

    «سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقرأ بالطور في المغرب»

    “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাগরিবের সালাতে সূরা আত-তুর পড়তে শুনেছি”[21]

    এশার সালাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত:

    ইমাম মুসলিম বারা ইবন আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,

    «أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ فِي سَفَرٍ فَقَرَأَ فِي العِشَاءِ فِي إِحْدَى الرَّكْعَتَيْنِ: بِالتِّينِ وَالزَّيْتُونِ»

    “একটি সফরে তিনি রাসূলের সাথে ছিলেন। তখন তিনি এশার সালাতে সূরা আত-ত্বীন ওয়ায যাইতুন তিলাওয়াত করেন”[22]

    অপর একটি হাদীসে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেন,

    «أَتُرِيدُ أَنْ تَكُونَ فَتَّانًا يَا مُعَاذٌ؟ إِذَا صَلَّيْتَ بِالنَّاسِ، فَاقْرَأْ بِالشَّمْسِ وَضُحَاهَا، وَسَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى، وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَى، وَاقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ»

    “হে মু‘আয তুমি কি মানুষকে ফিতনায় ঠেলে দিতে চাও? যখন তুমি মানুষের সালাতের ইমামতি করবে, তখন তুমি সূরা আস-শামছ ও সূরা আদ-দুহা এবং সূরা আলাক এবং আল-লাইল পড়বে”[23]

    তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নির্দেশটি দেন যখন সে তার সম্প্রদায়ের লোকদের এশার সালাতের ইমামতি করেন।

    মোটকথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত তেমন ছিল যেমনটি ইমাম মুসলিম আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,

    «مَا صَلَّيْتُ خَلْفَ أَحَدٍ أَوْجَزَ صَلَاةً مِنْ صَلَاةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي تَمَامٍ، كَانَتْ صَلَاةُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُتَقَارِبَةً، وَكَانَتْ صَلَاةُ أَبِي بَكْرٍ مُتَقَارِبَةً، فَلَمَّا كَانَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ مَدَّ فِي صَلَاةِ الْفَجْرِ، وَكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، إِذَا قَالَ: «سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ» قَامَ، حَتَّى نَقُولَ قَدْ أَوْهَمَ، ثُمَّ يَسْجُدُ وَيَقْعُدُ بَيْنَ السَّجْدَتَيْنِ حَتَّى نَقُولَ قَدْ أَوْهَمَ»

    “আমি কারও পিছনে এত সংক্ষিপ্ত সালাত আদায় করি নি, যেমনটি পূর্ণতা সহকারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে সালাত আদায় করি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত ছিল কাছাকাছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন سمع الله لمن حمده বলতেন তখন এত পরিমাণ দাঁড়াতেন, আমরা বলতাম রাসূল মনে হয় সাজদাহ’র কথা ভুলে গেছেন। তারপর তিনি সাজদাহ করে সাজদাহ থেকে উঠে বসতেন। তখন তিনি এত সময় পরিমাণ বসতেন আমরা মনে করতাম তিনি পরবর্তী সাজদাহ’র কথা ভুলে গেছেন।”[24]

    সাবেত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করে বলেন,

    «فَكَانَ أَنَسٌ يَصْنَعُ شَيْئًا لَا أَرَاكُمْ تَصْنَعُونَهُ، كَانَ إِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ الرُّكُوعِ انْتَصَبَ قَائِمًا، حَتَّى يَقُولَ الْقَائِلُ قَدْ نَسِيَ، وَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ السَّجْدَةِ مَكَثَ، حَتَّى يَقُولَ الْقَائِلُ قَدْ نَسِيَ»

    আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সালাতে এমন কিছু করতেন যা আমি তোমাদের করতে দেখি না। সে যখন রুকু থেকে মাথা উঠাইতেন তখন তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াতেন। তখন কেউ কেউ মনে করত, তিনি ভুলে গেছেন। আর যখন সাজদাহ হতে দাঁড়াতেন এ পরিমাণ অবস্থান করতেন, কেউ কেউ বলত, তিনি ভুলে গেছেন।”[25]

    বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করুন। বর্তমানের আমাদের ওলামা মাশায়েখদের অবস্থার দিক লক্ষ করুন। তাদের সালাতের ওপর জাবের ইবন সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কথাই প্রযোজ্য। যেমন, সহীহ মুসলিমে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    «كَانَ يُخَفِّفُ الصَّلَاةَ وَلَا يُصَلِّي صَلَاةَ هَؤُلَاءِ».

    “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত সংক্ষিপ্ত করতেন; কিন্তু এসব লোকদের মতো সালাত আদায় করত না”[26]

    এতো জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর যুগের কথা। আর বর্তমানে আমাদের মাশাইখদের সালাতকে যদি তারা দেখত তাহলে কি মন্তব্য করত। তুমি ঘর থেকে সালাতের একামত শুনে ৫০ মিটারের দূরত্বে সুন্নাতের পরিপন্থী কাজ খুব দৌড়ে মসজিদে এসেও তোমার দুই রাকাত বা তিন রাকাত সালাত ছুটে যায়। সালাতে উপস্থিত হওয়ার সুন্নাত হলো, তুমি দৌড়ে আসবে না ধীরে-সুস্থে গাম্ভীর্যের সাথে সালাতে উপস্থিত হবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «إِذَا أُقِيمَتِ الصَّلَاةُ فَلَا تَأْتُوهَا تَسْعَوْنَ، وَأْتُوهَا تَمْشُونَ وَعَلَيْكُمُ السَّكِينَةُ»

    “যখন সালাতের ইকামত দেওয়া হবে, তখন তুমি দৌড়ে মসজিদে আসবে না, ধীর-সুস্থে ও গাম্ভির্যের সাথে সালাতে উপস্থিত হবে”[27]

    বড় মুসীবত হলো, বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিম এ ধরনের সালাত আদায় করেই সন্তুষ্ট, বরং অধিকাংশকে দেখা যায় তারা মসজিদের দরজার সামনে দাঁড়াতে পছন্দ করে, যাতে তারা সালাম ফিরানোর সাথে সাথে মসজিদ থেকে বের হতে পারে। আর তারা আল্লাহ তা‘আলার বাণী- ﴿ فَإِذَا قُضِيَتِ ٱلصَّلَوٰةُ فَٱنتَشِرُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَٱبۡتَغُواْ مِن فَضۡلِ ٱللَّهِ ١٠ [الجمعة: ١٠] “যখন তোমরা সালাত আদায় কর যমীনে ছড়িয়ে পড়। আর আল্লাহর ফযল রিযিকের অনুসন্ধান কর”[সূরা আল-জুমু‘আ, আয়াত নং ১০]-কে নিজেদের পক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করে।

    মুসলিম ভাইদের জন্য আমার উপদেশ যাতে তারা যেন হকের উপর অটুট থাকে এবং সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে।

    ইমাম মুসলিম জাবের ইবন সামুরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সা‘আদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেন,

    «قَدْ شَكَوْكَ فِي كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى فِي الصَّلَاةِ. قَالَ: «أَمَّا أَنَا فَأَمُدُّ فِي الْأُولَيَيْنِ وَأَحْذِفُ فِي الْأُخْرَيَيْنِ. وَمَا آلُو مَا اقْتَدَيْتُ بِهِ مِنْ صَلَاةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ» فَقَالَ: ذَاكَ الظَّنُّ بِكَ، أَوْ ذَاكَ ظَنِّي بِكَ»

    “তারা তোমার সব বিষয়ে অভিযোগ করেছে। এমনকি তোমার সালাত বিষয়েও তারা অভিযোগ করেছে। তিনি বললেন, আমি সালাতের প্রথম দুই রাকাতে কিরাত লম্বা করি এবং পরের দুই রাকাতে সংক্ষিপ্ত করি। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাতের অনুসরণ করতে কোনো প্রকার কার্পণ্য করি না। তখন তিনি বললেন, তোমার প্রতি আমার ধারণাও তাই ছিল অথবা বললেন, আমার ধারণা তোমার প্রতি এমনই”[28]

    সা‘আদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মানুষ দূরে সরার কারণটির প্রতি লক্ষ্য করুন। কারণটি ছিল, তিনি তাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাতের মতই সালাত আদায় করতেন। মানুষের চাহিদার প্রতি তেমন কোনো গুরুত্ব দিতেন না। ফলে তারা আমীরুল মুমিনীন খলিফাতুল মুসলিমীন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট অভিযোগ করেন। তবে দেখার বিষয় হলো, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট যখন এ অভিযোগ করল যে সা‘আদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাতের মতোই সালাত আদায় করেন তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর অবস্থান কী ছিল? তিনি কি সা‘আদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে এ কথা বলেছেন যে, তুমি যা করছ ঠিকই করছ নাকি অন্য কিছু? না তিনি বললেন,

    «إن الناس اختلفوا اليوم عن أولئك وضعف إيمانهم، وأصبحوا لا يطيقون صلاة الرسول، والناس كثرت أشغالهم وكبرت مؤسساتهم وقل عملهم وبعدوا عن الدين، فتألفهم ولاتنفرهم»

    “বর্তমানের মানুষের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ঈমান দুর্বল হয়ে গেছে। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত সালাত আদায় করতে অক্ষম। মানুষের ব্যস্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে, বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব বেড়ে গেছে, আমলে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, মানুষ দীন থেকে দূরে সরে গেছে। সুতরাং তুমি তাদেরকে একত্র করবে, তাদের তুমি দূরে সরাবে না।” এ ছিল ফিতনা থেকে বাঁচা এবং কল্যাণকে ধরে রাখার জন্য উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হিকমত অবলম্বন। সুতরাং তোমাকে অবশ্যই হিকমত অবলম্বন করতে হবে। দেখুন না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ওপর ক্ষেপে গেলেন এবং বললেন,

    «أفتان أنت يامعاذ؟ فلا تكن فتانا واتق الله في عباد الله"؟!»

    “হে মু‘আয তুমি কি ফিতনা সৃষ্টিকারী? তুমি ফিতনা সৃষ্টিকারী হবে না। আল্লাহর বান্দাদের বিষয়ে তুমি আল্লাহকে ভয় কর”[29]

    উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর অবস্থান কি এমন কোনো অবস্থান ছিল যা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে?। না তা কক্ষনো হতে পারে না। একজন খলিফাতুল মুসলিমীন আল্লাহ ও তার রাসূলের নারাজিতে মানুষের সন্তুষ্টি তালাশ করবে তা কখনোই হতে পারে না, বরং তিনি সা‘আদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে এ বলে স্বীকৃতি দিলেন যে (ذاك الظن بك) “এই ছিল তোমার প্রতি আমার ধারণা”। অর্থাৎ, আমি তোমাকে তাদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছি যাতে তুমি তাদের মধ্যে আল্লাহর দেওয়া শরী‘আতকে বাস্তবায়ন কর। তাতে কেউ খুশি হোক বা অখুশি হোক তা তোমার দেখার বিষয় নয়। আমার যদি তোমার প্রতি আস্থা না থাকতো তবে আমি তোমাকে তাদের গভর্নর বানাতাম না। তাদের ওপর তোমাকে দায়িত্বশীল করতাম না। ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করুন এবং বাস্তব জীবনে এ ধরনের হিকমতকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করুন। আর তোমার আদর্শ যেন হয় আল্লাহ তা‘আলার বাণীর মতো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿وَبَشِّرِ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٥٥ ٱلَّذِينَ إِذَآ أَصَٰبَتۡهُم مُّصِيبَةٞ قَالُوٓاْ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ١٥٦﴾ [البقرة: ١٥٥، ١٥٦]

    “আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী”[সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৬]

    দশ- মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি আলামত হলো, পরস্পর সু-সম্পর্ক বজায় রাখা:

    শর‘ঈ কোনো কারণ ছাড়া তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। তাকে হিংসা করবে না, তার সাথে দুশমনি করবে না। অপর ভাইয়ের বিক্রি বা ক্রয়ের প্রস্তাবের ওপর তুমি প্রস্তাব দেবে না। অপর ভাই যে জিনিষটি ক্রয় করতে চায় তার দাম বাড়িয়ে দেবে না। এ ধরনের কর্ম অবশ্যই অন্যায় ও গর্হিত কর্ম। এতে আল্লাহ তা‘আলা কখনোই রাজি হন না। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «لَا تَحَاسَدُوا، وَلَا تَنَاجَشُوا، وَلَا تَبَاغَضُوا، وَلَا تَدَابَرُوا، وَلَا يَبِعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ، وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يَخْذُلُهُ، وَلَا يَحْقِرُهُ التَّقْوَى هَاهُنَا» وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ «بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ، كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ، دَمُهُ، وَمَالُهُ، وَعِرْضُهُ»

    “তোমরা একে অপরকে হিংসা করো না, কারো বিপক্ষে দালালি করো না, কারো সাথে শত্রুতা করো না, কারো সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো না। কারো বিক্রির ওপর বিক্রি করো না, তোমরা সকলে আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হিসেবে জীবন যাপন কর। এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি যুলুম করবে না, তাকে ছেড়ে দেবে না এবং অপমান করবে না। তাকওয়া মানুষের অন্তরে। বুকের দিকে ইশারা করে কথাটি তিনবার বলেন। একজন মানুষ নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে হেয় পতিপন্ন করে। প্রতিটি মুসলিমের ওপর অপর মুসলিম ভাইয়ের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরুকে হারাম করা হয়েছে[30]।”

    এ ধরনের হেয় প্রতিপন্ন করা প্রকাশ পায় সাধারণত তাদের থেকে, যাদেরকে বড় বড় অফিস পরিচালনা করে, বড় বড় পোষ্টে চাকুরী করে এবং একাধিক ডিগ্রি যা তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেছেন। এসবের কারণে তাদের থেকে যারা ছোট, বড় ধরণের কোনো উপাধি লাভ করতে পারে নি এবং বড় কোনো অফিসারও হতে পারে নি তাদেরকে সত্য কবুল করাকে অপমান মনে করে। ফলে তাদের হতে হয় সত্য বিমুখ।

    এগারো- মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি আলামত, মুসলিম ভাইয়ের প্রতি যুলুম করা থেকে বিরত থাকা:

    মুসলিম ভাইয়ের প্রতি কোনো যুলুম করবে না, বরং তাকে সাহায্য করবে, তার প্রয়োজনে তার পাশে থাকবে, তার কোন বিপদ হলে তা দূর করবে এবং তার কোনো দোষ থাকলে তা লুকিয়ে রাখবে যাতে তার ওপর সাওয়াব পাও। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «المُسْلِمُ أَخُو المُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً، فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ القِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ القِيَامَةِ»

    “এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করবে না, তাকে দুশমনের হাতে সোপর্দ করবে না। যে তার ভাইয়ের প্রয়োজনে নিয়োজিত থাকবে আল্লাহ তা‘আলা তার হাজত পূরণে লিপ্ত থাকবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ভাইয়ের মুসিবত দূর করবে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার মুসীবত দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি একজন মুসলিম ভাইয়ের দোষকে গোপন করবে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার দোষকে গোপন করবে”[31]

    মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি আলামত হলো, হাদীয়া বিনিময় করা:

    সাধ্য অনুযায়ী অপর মুসলিম ভাইকে হাদিয়া ও উপহার দেওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «تهادوا تحابوا».

    “তোমরা একে অপরকে হাদিয়া দাও; তাতে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে মহব্বত বাড়বে”[32]

    বারো- মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি আলামত হলো আল্লাহর বিধানের বাস্তবায়নের প্রতি উদ্ভুদ্ধ করা:

    আল্লাহর বিধানের তা‘যীম করা এবং আল্লাহ তা‘আলা যেসব আমল পছন্দ করেন এবং সন্তুষ্ট হন, সেসব আমল বাস্তবায়ন করার প্রতি দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার ওপর উৎসাহ প্রদান করা। এটাই হল শরী‘আতকে সহজীকরণের মূল উৎস। আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী মুমিনদের জন্য আল্লাহর বিধান মানা সর্বদাই সহজ; কোনো কঠিন কিছুই নয়। বিষয়টি আরো বেশি স্পষ্ট করার জন্য একটি হাদীস নিয়ে আসব যে হাদীসটি ইমাম বুখারী রহ. বর্ণনা করেছেন।

    «لما بعث رسول الله صلى الله عليه وسلم أبا موسى الأشعري ومعاذا إلى اليمن أوصاهما بقوله: «يَسِّرَا وَلاَ تُعَسِّرَا، وَبَشِّرَا وَلاَ تُنَفِّرَا» ، فَانْطَلَقَ كُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا إِلَى عَمَلِهِ، وَكَانَ كُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا إِذَا سَارَ فِي أَرْضِهِ كَانَ قَرِيبًا مِنْ صَاحِبِهِ أَحْدَثَ بِهِ عَهْدًا، فَسَلَّمَ عَلَيْهِ، فَسَارَ مُعَاذٌ فِي أَرْضِهِ قَرِيبًا مِنْ صَاحِبِهِ أَبِي مُوسَى، فَجَاءَ يَسِيرُ عَلَى بَغْلَتِهِ حَتَّى انْتَهَى إِلَيْهِ، وَإِذَا هُوَ جَالِسٌ، وَقَدِ اجْتَمَعَ إِلَيْهِ النَّاسُ وَإِذَا رَجُلٌ عِنْدَهُ قَدْ جُمِعَتْ يَدَاهُ إِلَى عُنُقِهِ، فَقَالَ لَهُ مُعَاذٌ: يَا عَبْدَ اللَّهِ بْنَ قَيْسٍ أَيُّمَ هَذَا؟ قَالَ: هَذَا رَجُلٌ كَفَرَ بَعْدَ إِسْلاَمِهِ، قَالَ: لاَ أَنْزِلُ حَتَّى يُقْتَلَ، قَالَ: إِنَّمَا جِيءَ بِهِ لِذَلِكَ فَانْزِلْ، قَالَ: مَا أَنْزِلُ حَتَّى يُقْتَلَ، فَأَمَرَ بِهِ فَقُتِلَ، ثُمَّ نَزَلَ فَقَالَ: يَا عَبْدَ اللَّهِ، كَيْفَ تَقْرَأُ القُرْآنَ؟ قَالَ: أَتَفَوَّقُهُ تَفَوُّقًا، قَالَ: فَكَيْفَ تَقْرَأُ أَنْتَ يَا مُعَاذُ؟ قَالَ: أَنَامُ أَوَّلَ اللَّيْلِ، فَأَقُومُ وَقَدْ قَضَيْتُ جُزْئِي مِنَ النَّوْمِ، فَأَقْرَأُ مَا كَتَبَ اللَّهُ لِي، فَأَحْتَسِبُ نَوْمَتِي كَمَا أَحْتَسِبُ قَوْمَتِي»

    “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আবু মুসা আল-আশ‘আরী ও মু‘আয বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে ইয়ামনের দিকে প্রেরণ করেন, তখন তিনি তাদের উভয়কে এ বলে নসীহত করেন যে, “তোমরা সহজ কর কঠিন করো না সু-সংবাদ দাও দূরে সরাবে না”। তারা উভয়ে যখন স্বীয় যমীনে (কর্ম স্থলে) চলাফেরা করত তখন তারা একে অপরের কাছাকাছি থাকত। একে অপরের সাথে দেখা সাক্ষাত করত এবং যখন পৃথক হত তখন তারা আবার পুনরায় দেখা করার জন্য নতুনভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হত তারপর সালাম দিয়ে বিদায় নিত। একদিন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার সাথী আবু মুসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর এলাকায় একটি গাধার উপর ভ্রমণ করে এসে পৌছল। লোকেরা তার নিকট পৌছলে সে দেখতে পেল, এক লোক হাত পা বাঁধা। মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু লোকটিকে দেখে বলল, হে আব্দুল্লাহ ইবন কাইস! এটি কী? লোকটির কি হয়েছে? তিনি বললেন, লোকটি ইসলাম গ্রহণ করার পর মুরতাদ হয়ে গেছে। মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলল, যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে হত্যা করা না হবে, আমি নিচে নামবো না। তিনি বললেন, লোকটিকে হত্যা করার জন্যই আনা হয়েছে। তুমি নামতে পার। তিনি আবারো বললেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে হত্যা করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি নামবো না। তারপর নির্দেশ দেয়া হলো তাকে হত্যা করার জন্য এবং হত্যা করা হল। তারপর তিনি নীচে নেমে বললেন, হে আব্দুল্লাহ! তুমি কীভাবে কুরআন তিলাওয়াত কর? তিনি বললেন, রাত দিন কিছু সময় পর পর কুরআন পড়তে থাকি। তারপর তিনি বললেন, হে মু‘আয তুমি কীভাবে কুরআন পড়? বললেন, আমি প্রথম রাতে ঘুমাই, রাতের কিছু অংশ ঘুমের মধ্যে কাটাই, তারপর ঘুম থেকে উঠে আল্লাহ তা‘আলার তাওফীক অনুযায়ী কুরআন পড়ি। আমি আমার ঘুমের সময়ও সাওয়াবের আশা করি, যেমনিভাবে জাগ্রত থেকে তিলাওয়াত করাতে সাওয়াবের আশা করি।[33]

    লক্ষ্য করুন একজন সাহাবী আরেক জন সাহাবীকে কতটুকু মহব্বত করতেন এবং একে অপরের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে কতটুকু যত্নবান ছিলেন। তারপর দেখুন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আল্লাহর হুকুম দ্রুত বাস্তবায়নের প্রতি কত দৃঢ় ও কঠোর ছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর বিধান কার্যকর হয় নি ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তার আরোহণ থেকে নিচে নামেন নি। তারপর দেখুন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার সাথীকে কুরআন তিলাওয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। এতে প্রমাণিত হয় যে তাদের মধ্যে কুরআনের গুরুত্ব, আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করার গুরুত্ব ও মহব্বত কত বেশি ছিল। যে ব্যক্তি যে জিনিসকে বেশি গুরুত্ব দেয় ও মহব্বত করে সে তার আলোচনাও বেশি করে।

    তারা যদি বর্তমানে আমাদের দুনিয়া প্রীতির অবস্থা দেখত তাহলে তাদের ধারণ আমাদের প্রতি কি হত! আজ আমরা যদি আমাদের কোনো ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত করি, তখন প্রথমেই আমরা দুনিয়াদারির বিষয়ে খোজ নেই। বিশেষ করে টাকা পয়সা ধন-দৌলত ইত্যাদি বিষয়ে আগে জানতে চাই। তোমার বেতন কত? তোমার প্রমোশন হয়েছে কি? তোমার বাড়ি কয়টি? তোমার বাড়ী-গাড়ীর খবর কি? বেতন বৃদ্ধি, বিলাসী জীবন, সু-সজ্জিত বাড়ি-গাড়ী ইত্যাদি বিষয়েই আমরা জিজ্ঞাসা করি। আর মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যে প্রশ্ন করেছেন আজ পর্যন্ত আমি কাউকে দেখিনি, এ ধরনের প্রশ্ন নিয়ে অগ্রসর হতে যে প্রশ্নটি নিয়ে মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু অগ্রসর হয়েছেন।

    বর্তমানে মানুষের মূল্যায়ন হয় টাকার দ্বারা। কারণ, মানুষ টাকার মূল্য বুঝে ঈমান ও আমলের মূল্য বুঝে না। কে আছে এমন যে টাকা-পয়সাকে পায়ের নিচে রেখে পা দিয়ে পিষবে? কিন্তু আল্লাহর দেওয়া মহা মূল্যবান কিতাব তাকে তারা তাদের পিছনে ফেলে দিয়েছে। তারা তাদের বক্রতাকে যে জিনিসটি ঠিক করবে তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না। তাদের প্রবৃত্তি ও খারাপ আত্মার মাঝে যা প্রতিবন্ধকতা ও পার্টিশন তৈরি করবে, জুলুম অত্যাচারের মুখোশ খুলে দেবে এবং তাদের ভুল ত্রুটি ধরে দেবে তা তারা গ্রহণ করতে চায় না। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন,﴿إِنَّ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ يَهۡدِي لِلَّتِي هِيَ أَقۡوَمُ ٩[الاسراء: ٩] “নিশ্চয় এ কুরআন এমন একটি পথ দেখায় যা সবচেয়ে সরল।” এ আয়াতের তাফসীরে ‘আদওয়ায়ুল বায়ানে’ আল্লামা সানকীতি রহ. দীর্ঘ আলোচনা করেন। তিনি তাতে বলেন, “এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে হিদায়াতের সর্বোত্তম পথ, সঠিক পথ ও মধ্যম পথ সবই সংক্ষিপ্তকারে বর্ণনা করে দিয়েছেন”

    তেরো- মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি আলামত ক্ষোভ ও রাগকে প্রশমিত করতে চেষ্টা করা:

    মহব্বত ও ভালোবাসা অটুট রাখার উদ্দেশ্যে এক ভাই অপর ভাইয়ের রাগ, ক্ষোভ ও ক্রোধকে থামিয়ে দেবে এবং উত্তম কথা বলবে, যাতে রাগ থেমে যায় এবং মহব্বত নষ্ট না হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিতিতে সাহাবীদের মাঝে সংঘটিত একটি ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিকমতপূর্ণ- আচরণ থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। ঘটনাটি ঘটেছিল আওস ও খাযরাজ নামক দুটি প্রসিদ্ধ গোত্রের লোকদের মাঝে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবন উবাই ইবনে সুলুল কর্তৃক রচিত ইফকের (আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে অপবাদ দেওয়ার) ঘটনা বিষয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন এবং এ ঘটনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের কষ্টের কথা সাহাবীগণের নিকট তুলে ধরছিলেন তখন উল্লিখিত দুই গোত্র একটি অপরটির বিরুদ্ধে গর্জে উঠে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয় গোত্রের লোকদের চুপ করিয়ে দেন এবং তিনি নিজেও চুপ করেন। ইমাম বুখারী ও মুসলিম উভয় ইফকের ঘটনার দীর্ঘ হাদীসে এ ঘটনাটি বর্ণনা করেন। তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «يَا مَعْشَرَ الْمُسْلِمِينَ مَنْ يَعْذِرُنِي مِنْ رَجُلٍ قَدْ بَلَغَ أَذَاهُ فِي أَهْلِ بَيْتِي فَوَاللهِ مَا عَلِمْتُ عَلَى أَهْلِي إِلَّا خَيْرًا، وَلَقَدْ ذَكَرُوا رَجُلًا مَا عَلِمْتُ عَلَيْهِ إِلَّا خَيْرًا، وَمَا كَانَ يَدْخُلُ عَلَى أَهْلِي إِلَّا مَعِي» فَقَامَ سَعْدُ بْنُ مُعَاذٍ الْأَنْصَارِيُّ، فَقَالَ: أَنَا أَعْذِرُكَ مِنْهُ، يَا رَسُولَ اللهِ إِنْ كَانَ مِنَ الْأَوْسِ ضَرَبْنَا عُنُقَهُ وَإِنْ كَانَ مِنْ إِخْوَانِنَا الْخَزْرَجِ أَمَرْتَنَا فَفَعَلْنَا أَمْرَكَ، قَالَتْ: فَقَامَ سَعْدُ بْنُ عُبَادَةَ وَهُوَ سَيِّدُ الْخَزْرَجِ، وَكَانَ رَجُلًا صَالِحًا، وَلَكِنِ اجْتَهَلَتْهُ الْحَمِيَّةُ، فَقَالَ لِسَعْدِ بْنِ مُعَاذٍ: كَذَبْتَ لَعَمْرُ اللهِ لَا تَقْتُلُهُ، وَلَا تَقْدِرُ عَلَى قَتْلِهِ فَقَامَ أُسَيْدُ بْنُ حُضَيْرٍ - وَهُوَ ابْنُ عَمِّ سَعْدِ بْنِ مُعَاذٍ -، فَقَالَ لِسَعْدِ بْنِ عُبَادَةَ: كَذَبْتَ لَعَمْرُ اللهِ لَنَقْتُلَنَّهُ فَإِنَّكَ مُنَافِقٌ تُجَادِلُ عَنِ الْمُنَافِقِينَ فَثَارَ الْحَيَّانِ الْأَوْسُ وَالْخَزْرَجُ حَتَّى هَمُّوا أَنْ يَقْتَتِلُوا وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَائِمٌ عَلَى الْمِنْبَرِ، فَلَمْ يَزَلْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُخَفِّضُهُمْ حَتَّى سَكَتُوا وَسَكَتَ»

    “হে মুসলিম সম্প্রদায়! এ লোকটি থেকে কে আমাকে রেহাই দেবে যে আমাকে আমার পরিবারের বিষয়ে কষ্ট দিচ্ছে। আল্লাহর শপথ আমি আমার পরিবার সম্পর্কে ভালো ছাড়া আর কিছুই জানি না। তারপর সা‘আদ ইবন মু‘আয আল-আনছারী দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমি আপনাকে তার থেকে রেহাই দেব। যদি লোকটি আওস গোত্রের হয়, আমি তাকে হত্যা করব। আর যদি আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের হয়, তাহলে আপনি যা আদেশ করবেন তাই পালন করব। তারপর সা‘আদ উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যিনি খাযরাজ গোত্রের সরদার ছিলেন উঠে দাঁড়ালেন। ইতোপূর্বে তিনি একজন সৎ লোক ছিলেন। কিন্তু জাতীয়তা তথা জাহিলিয়্যাতের প্রভাবে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তিনি সা‘আদ ইবনে মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি তাকে হত্যা করবে না এবং হত্যা করতে পারবে না। তারপর উসাইদ ইবন হুদাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যিনি সা‘আদ ইবন মু‘আযের চাচাতো ভাই সা‘আদ ইবন উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি মিথ্যা বলছ, আল্লাহর শপথ আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করব। তুমি অবশ্যই একজন মুনাফিক! মুনাফিকদের পক্ষ নিয়ে ঝগড়া করছ। আওস ও খাযরাজ উভয় গোত্রের লোকেরা একে অপরের ওপর চড়াও হওয়ার উপক্রম হল। এমনকি এক গোত্রের লোক অপর গোত্রের লোকদের হত্যা করার ইচ্ছা করল, অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মিম্বরে দাঁড়ানো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের চুপ করাচ্ছিলেন। অবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রচেষ্টায় তারা উভয় গোত্র থামল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও চুপ হলেন।[34]

    দেখুন কীভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের থামানোর জন্য তৎপর ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তাদের থামাতে সক্ষম হলেন। এ বিষয়টি অনেক তালিবে ইলমের মধ্যেও অনুপস্থিত। অন্যদের কথাতো বাদ-ই দিলাম। যেমন তুমি এমন একটি মজলিসে অথবা কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত। যে কোনো কারণে সেখানে বিতর্ক শুরু হয়ে উচ্চ-বাচ্য আরম্ভ হয়ে গেল। তখন উভয় পক্ষকে চুপ করানো এবং তাদের থামানো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতটির ওপর আমল করতে পার। তা যেন তোমার থেকে ছুটে না যায়।

    সহীহ মুসলিম ও সহীহ বুখারীতে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «يَسِّرُوا وَلاَ تُعَسِّرُوا، وَبَشِّرُوا، وَلاَ تُنَفِّرُوا»

    “তোমরা সহজ কর, কঠিন করো না। তোমরা সু-সংবাদ দাও, ভীতি প্রদর্শন করো না”[35] বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীটির অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿وَقُل لِّعِبَادِي يَقُولُواْ ٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ ٱلشَّيۡطَٰنَ يَنزَغُ بَيۡنَهُمۡۚ إِنَّ ٱلشَّيۡطَٰنَ كَانَ لِلۡإِنسَٰنِ عَدُوّٗا مُّبِينٗا ٥٣﴾ [الاسراء: ٥٣]

    “আর আমার বান্দাদেরকে বল, তারা যেন এমন কথা বলে, যা অতি সুন্দর। নিশ্চয় শয়তান তাদের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের স্পষ্ট শত্রু”[সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৩]

    সমাপ্ত

    [1] আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৮৩২; তিরমিযি, হাদীস নং ২৩৯৫

    [2] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৮৬; মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৮৩৭২

    [3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭২৮; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৬৬৩

    [4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩

    [5] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯১

    [6] আবু দাউদ, হাদীস নং ৪০৯৭, আহমদ, হাদীস নং ২২৯১; তিরমিযি, হাদীস নং ২৭৮৪; ইবনু মাজাহ, হাদীস নং ১৯০৪

    [7] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৬; আহমদ, হাদীস নং ২১৩১৮

    [8] আবু দাউদ, হাদীস নং ৪০৩১

    [9] আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৮৮৪; আহমদ, হাদীস নং ১৬৩৬৮, তাবরানী ফিল আওসাত, হাদীসটি হাসান।

    [10] সহীহ মুসলিম

    [11] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭২০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৬

    [12] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৫

    [13] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭০২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৬৬

    [14] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৫২

    [15] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৫৯

    [16] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৫৪

    [17] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৬১

    [18] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৫৮

    [19] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৫৬

    [20] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৬২

    [21] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৬৩

    [22] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৬৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৬৪

    [23] বর্ণনায় সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৯৮৬। হাদিসটি সহীহ।

    [24] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৭৩

    [25] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৭২

    [26] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৫৮

    [27] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯০৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬০২

    [28] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৫৩

    [29] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭০৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৬৫

    [30] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৬৪

    [31] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৪৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৮০

    [32] বর্ণনায় ইবন আবী ইয়ালা হাদীসটি হাসান।

    [33] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৩৪১

    [34] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৬৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৭০

    [35] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭৩৪