স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কঠিন ঝগড়া, এমন নারীর সাথে যেনা সংঘটিত হওয়ার পর নারী যদি তালাকপ্রাপ্তা হয়, যেনাকারী কি তাকে বিয়ে করতে পারবে?
ক্যাটাগরিসমূহ
উৎস
Full Description
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কঠিন ঝগড়া, এমন নারীর সাথে যেনা সংঘটিত হওয়ার পর নারী যদি তালাকপ্রাপ্তা হয়, যেনাকারী কি তাকে বিয়ে করতে পারবে?
زنى بامرأة متزوجة بينها وبين زوجها خلاف، فهل له أن يتزوجها إذا طلقها زوجها؟
< بنغالي- Bengal - বাঙালি>
ইসলাম কিউ এ
موقع الإسلام سؤال وجواب
অনুবাদক: সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
ترجمة: ثناء الله نذير أحمد
مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কঠিন ঝগড়া, এমন নারীর সাথে যেনা সংঘটিত হওয়ার পর নারী যদি তালাকপ্রাপ্তা হয়, যেনাকারী কি তাকে বিয়ে করতে পারবে?
প্রশ্ন: জনৈক স্ত্রীর স্বামী মাতাল, সে তাকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়, তার ধারণা স্বামী থেকে দূরত্বে অবস্থান করলে তালাকপ্রাপ্তা হয়ে যাবে, অতএব সে দেশ ছেড়ে উত্তর আমেরিকা চলে যায়। কারণ, কেউ তাকে বলেছে স্বামী থেকে এক বছর পলায়ন করে থাকলে সে তালাকপ্রাপ্তা হয়ে যাবে। অতঃপর এক মুসলিম পুরুষের সাথে তার দেখা হয়, সে বলে এভাবে তালাক হয় না। তারা উভয় একে অপরের সাথে পরিচিত হয়, আস্তে আস্তে ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে, শেষ পর্যন্ত তাদের মাঝে যেনা সংঘটিত হয়। পরে নারী স্বামী থেকে তালাকনামা পায় ও ইদ্দত শেষ করে। যেনার পর থেকে তারা পরস্পর দেখা-সাক্ষাত বন্ধ রাখে, নিজেদের কৃত অপরাধের জন্য কঠিনভাবে লজ্জিত হয় ও আল্লাহর নিকট খালিস তাওবা করে। বর্তমান তারা বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এ বিয়ে সঠিক কি না জানতে চাই?
আমি শুনেছি কতক মালিকি আলেমের দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি কোনো নারীর সংসার নষ্ট করে, তার পক্ষে ঐ নারীকে বিয়ে করা বৈধ নয়, তবে অধিকাংশ আলেম তার অনুমতি দেন এবং এটাকে তারা শুদ্ধ বিবাহ মানেন।
কিন্তু, প্রশ্নের ব্যক্তি নিশ্চিত নয়, সে সংসার বিনষ্টকারীর ভিতর কি না?
কারণ, তার সাথে সাক্ষাত হওয়ার আগ থেকে নারী তালাকের উপায় খুঁজতে ছিল। উল্লেখ্য, পুরুষ হানাফী মাযহাবের অনুসারী, আর নারী অনুসরণ করে শাফেঈ মাযহাব। যদি মাযহাবের ভিন্নতা থেকে তারা উপকৃত হয় তাই বললাম। যাই হোক অধিকাংশ আলেম এরূপ বিয়ে বৈধতার পক্ষে মত দেন, তবে আমি সঠিক মাসআলা জানতে চাই।
উত্তর: আল-হামদুলিল্লাহ।
প্রথমত: স্ত্রী যদি তার স্বামীকে ছেড়ে অথবা স্বামী তার স্ত্রীকে ছেড়ে এক বছর বা দুই বছর বা তার চেয়ে কম-বেশি সময় দূরত্বে অবস্থান করে তখনও বিবাহ আপন হালতে বহাল থাকে, যতক্ষণ না স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেয়। যদি এরূপ না ঘটে: স্বামী স্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে তালাক উচ্চারণ করেছে অথবা তাকে উদ্দেশ্য করে তালাক লিখেছে, তাহলে নারী স্বামীর অধীন থাকবে, যদিও দূরত্বে অবস্থান করার মেয়াদ দীর্ঘ হয়।
শাইখ ইবনে বায রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নারীকে কখন তালাকপ্রাপ্তা গণ্য করা হবে, তিনি বলেন: “স্বামী যদি স্ত্রীকে বিবেক ও সুস্থ মেজাজে তালাক দেয় এবং তার ভিতর তালাক প্রদান করার প্রতিবন্ধক কোনো কারণ না থাকে। যেমন, পাগলামি, মাতলামি বা এ জাতীয় কোনো সমস্যা। আর স্ত্রীও ঋতু থেকে পবিত্র থাকে, যে পবিত্রতায় স্বামীর সাথে তার সহবাস হয়নি, বা স্ত্রী গর্ভবতী বা সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়, তবে নারী তালাকপ্রাপ্তা গণ্য হবে"। [দেখুন: ফাতওয়াত তালাক: (১/৩৫)]
দ্বিতীয়ত: যেনা একটি বড় পাপ, এই পাপের মাত্রা আরও কঠিন হয় ও বেড়ে যায় যদি নারী বিবাহিতা হয়। তাই অবিবাহিত ব্যক্তির যেনার শাস্তি একশত বেত্রাঘাত, আর বিবাহিত ব্যক্তির যেনার শাস্তি প্রস্তারাঘাত, যতক্ষণ না সে মারা যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেন:
﴿وَلَا تَقۡرَبُواْ ٱلزِّنَىٰٓۖ إِنَّهُۥ كَانَ فَٰحِشَةٗ وَسَآءَ سَبِيلٗا ٣٢﴾ [الاسراء: ٣٢]
“তোমরা ব্যভিচারের কাছে যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ"। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৩২]
শাইখ আবদুর রহমান আস-সা'দী রহ. বলেন: “যেনার কাছে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা খোদ যেনা থেকে নিষেধ করার চেয়ে কঠিনতর। কারণ, যেনার কাছে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা যেনার সকল ভূমিকা ও তাতে উদ্বুদ্ধকারী সকল কর্ম-কাণ্ডের নিষেধাজ্ঞাকে শামিল করে। বস্তুত যে রাখাল সীমানা প্রাচীরের পাশে পশু চরায় তার পশু খুব সহজে প্রাচীরের ভেতর ঢুকে পড়বে সন্দেহ নেই। বিষয়টি যদি হয় প্রবৃত্তির তখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, প্রবৃত্তির প্রতি রয়েছে অন্তরের অনেক টান ও গভীর আকর্ষণ।
আল্লাহ তাআলা যেনা ও যেনার অনিষ্টকে ফাহিশাহ(فَاحِشَةً) বলেছেন: অর্থাৎ শরীয়ত, বিবেক ও সুস্থ স্বভাবের কাছে যেনা খুব কদর্য ও নোংরা কর্ম। কারণ, যেনা কয়েকটি হারামকে অন্তর্ভুক্ত করে, আল্লাহর হক, নারীর হক, নারীর পরিবার ও তার স্বামীর হক, এবং স্বামীর বিছানা নষ্ট করা ও স্বামীর বংশে মিশ্রণ ঘটানো ইত্যাদি অপরাধ।
আল্লাহ যেনার জন্য আরেকটি বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন: (وَسَاءَ سَبِيلاً) খুব খারাপ রাস্তা, অর্থাৎ যে যেনার রাস্তায় পা বাড়ালো তার রাস্তা খুবই খারাপ"। [তাইসিরুল কারিমির রহমান ফি তাফসিরিল কালামিল মান্নান: (১/৪৫৭)]
অতএব, যেনাকারী নারী-পুরুষ উভয়ের তাওবা করা, আল্লাহর দিকে ফিরে আসা ও যেনার দিকে আকৃষ্ট করে সকল কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা জরুরি। যে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে আল্লাহ তাকে গ্রহণ করেন।
তৃতীয়ত: নারীকে তার স্বামীর প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি করে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার কৌশল অবলম্বন করা কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। এতে ঘর নষ্ট হয় ও পরিবার ভেঙ্গে যায়, যদিও স্বামী-স্ত্রীর ভেতর ঝগড়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়। এরূপ করা অনেক আলেমের নিকট কবিরা গুনাহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَيْسَ مِنَّا مَنْ خَبَّبَ امرَأَةً عَلَى زَوجِهَا»
“যে কোনো নারীকে তার স্বামীর ব্যাপারে ক্ষেপিয়ে তোলে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়"। (আবু দাউদ, হাদীস নং ২১৭৫, শাইখ আলবানি সহীহ আবু দাউদে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।)
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে আবু দাউদ আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেন:
«مَنْ خَبَّبَ زَوْجَةَ امْرِئٍ أَوْ مَمْلُوكَهُ فَلَيْسَ مِنَّا»
“যে কোনো ব্যক্তির স্ত্রী অথবা অধীনকে প্রলুব্ধ করে নিল সে আমাদের দলভুক্ত নয়"। (আবু দাউদ, হাদীস নং ৫১৭০, আলবানি সহীহ আবু দাউদে হাদীসটি সহীহ বলেছেন।)
শাইখ আযিম আবাদি রহ. বলেন: (مَن خبَّب) : بتشديد الباء الأولى অর্থাৎ ধোঁকা দিল ও বিনষ্ট করল। (امرأة على زوجها) অর্থাৎ নারীর কাছে স্বামীর বদনাম করা অথবা নারীর কাছে অপর পুরুষের সৌন্দর্য বর্ণনা করা"। [আউনুল মাবুদ: (৬/১৫৯)]
তিনি আরও বলেন:(مَنْ خَبَّب زوجة امرئ) অর্থাৎ নারীকে বিয়ে করার জন্য অথবা অপরের নিকট বিয়ে দেওয়ার জন্য অথবা অন্য কোন কারণে নারীকে ধোঁকা দিল অথবা তাকে বিনষ্ট করল অথবা তার নিকট তালাককে সুন্দর করে তুলল"। [আউনুল মাবুদ: (১৪/৫২)]
শাইখ মুনাভি রহ. বলেন: আমাদের উস্তাদ শা'রাভি বলেছেন: নারীকে তার স্বামীর ওপর বিনষ্ট করার একটি পদ্ধতি হচ্ছে, স্বামীর ওপর অসন্তুষ্টি থেকে নারী যখন মীমাংসা বা সালিশির জন্য কারও নিকট যায়, তখন তার মেহমানদারিতে দরাজ হস্ত হয়ে যাওয়া, তার ভালো খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা, তাকে বেশি সম্মান দেওয়া ও তার জন্য অনেক খরচ করা, যদিও এ আদর-আপ্যায়ন স্বামীর খাতিরেই করা হোক। এরূপ অবস্থায় নারীর মন অপরের দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং সে নিজের স্বামীকে তুচ্ছ ভাবতে পারে, অতএব অপরের স্ত্রীকে কেন্দ্র করে এসব কর্ম-কাণ্ড হাদিসে নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত বিচক্ষণ ব্যক্তি কঠোরতা হলেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়, যদিও কঠোরতা করা তার উদ্দেশ্য নয়। তিনি বলেন: স্বামীর কাছ থেকে রেগে আসা নারীর প্রতি আমি কঠোর হয়েছি এবং আমার পরিবারকে বলেছি তার সাথে একটু কঠোর আচরণ কর, সে যেন তার স্বামীর নিকট ফিরে যায় এবং স্বামী নামক নি'আমতের হক আদায় করে। তিনি বলেন: এরূপ আচরণ আমি কয়েকবার করেছি। [ফায়দুল কাদির শারহু জামিউস সাগির: (৬/১৫৯)]
চতুর্থত: যে কোনোও নারীকে তার স্বামীর বিপক্ষে ক্ষেপিয়ে স্বামীর সংসার বিনষ্ট করে বিচ্ছেদ ঘটায় এবং তারপর সে ঐ নারীকে বিয়ে করে, তার এই বিয়ে শুদ্ধ নয়, তাদের উভয়ের মাঝে বিচ্ছেদ করা জরুরি। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ এটাই গ্রহণ করেছেন। মালিকি মাযহাবও এরূপ।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে বলছি: যদি এই ব্যক্তি নারীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে থাকে, যার প্রেক্ষিতে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তালাক সংঘটিত হয়, তাহলে তাদের বিয়ে বৈধ নয়, বিশেষ করে তার সাথে যখন যেনাও করেছে। আর ব্যভিচারী পুরুষ ব্যভিচারী নারীকে বিয়ে করতে পারবে কিনা আহলে-ইলমগণ এ ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। যাই হোক এখানে দু'টি খারাপ বিষয় একসাথ হয়েছে: স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীকে প্ররোচনা দেওয়া ও তার সাথে যেনা করা।
আর যদি ব্যক্তি অপরের স্ত্রীকে প্ররোচিত না করে, যেমন এই প্রশ্ন থেকে স্পষ্ট, বরং তার সাথে সাক্ষাত অতঃপর পরিচয় হয়েছে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ও তার ঘর ত্যাগ করার পর। তাহলে তাদের বিয়ে ঠিক আছে, যদি প্রথম স্বামী থেকে যথাযথভাবে বিচ্ছিন্ন হয়, তবে উভয়কে তাদের কৃত কর্মের জন্য আল্লাহর নিকট তাওবা করা জরুরি। আল্লাহ ভালো জানেন।