×
এ নিবন্ধে বুদ্ধি বিকাশকালেই শিশুকে তাওহীদ ও এর পরিপন্থী বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দেবার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

    আপনার সন্তানকে তাওহীদের শিক্ষা দিন

    [ বাংলা – Bengali – بنغالي ]

    আলী হাসান তৈয়ব

    সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    2011-1432

    ﴿ علموا أولادكم التوحيد ﴾

    « باللغة البنغالية »

    علي حسن طيب

    مراجعة: د. أبو بكر محمد زكريا

    2011 - 1432

    আপনার সন্তানকে তাওহীদের শিক্ষা দিন

    একজন মুসলিম হিসেবে আমরা সন্তানকে বুদ্ধি বিকাশের প্রথম প্রহরেই দীন সম্পর্কে ধারণা দিতে ইচ্ছুক থাকি। সন্তান কথা বলা শুরু করতেই আমরা অনেকে আল্লাহ, আব্বু-আম্মু শিক্ষা দেই। কালেমায়ে শাহাদাহ শেখাই। তারপর ক্রমেই তাকে সালাত, সিয়াম ইত্যাদি ইবাদতের সঙ্গে পরিচিত করাই। কিন্তু যে কাজটি আমরা করি না তা হলো সন্তানকে শুধু কালেমা শেখানোই নয়; তাকে তাওহীদ শিক্ষা দেয়া, ঈমানের মোটামুটি বিস্তারিত শিক্ষা দেয়া এবং তাওহীদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দিকগুলো সম্পর্কে ধারণা দেয়া।

    তাইতো দেখা যায় আমাদের সন্তানরা বড় হয়েও অবচেতন মনে তাওহীদের শিক্ষা পরিপন্থী কাজ করে বসে। শিরকের গন্ধ মিশ্রিত কথা বলে বসে। শিশুকালের এই ঘাটতি আর সারা জীবন পূরণ হয় না। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় পরবর্তীতে তাকে স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি এটাকে অপমান হিসেবে দেখেন। এমনকি অনেকে বলেই বসেন, হ্যা, বাপ-দাদার আমল থেকে কি তবে ভুলই করে আসছি!

    অথচ সাহাবীদের অবস্থা দেখুন। তাঁরা বুদ্ধির উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গেই শিশুকে তাওহীদ শেখাতেন। ঈমানের শিক্ষাকে তাঁরা এলেম ও আমলের শিক্ষার ওপর অগ্রাধিকার দিতেন। কারণ, এলেম ও আমলেরও আগে ঈমান। জুনদুব বিন আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ وَنَحْنُ فِتْيَانٌ حَزَاوِرَةٌ ، فَتَعَلَّمْنَا الإِيمَانَ قَبْلَ أَنْ نَتَعَلَّمَ الْقُرْآنَ ، ثُمَّ تَعَلَّمْنَا الْقُرْآنَ , فَازْدَدْنَا بِهِ إِيمَانًا»

    ‘আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে থাকতাম। তখন আমরা টগবগে যুবা ছিলাম। সে সময় আমরা ঈমান শিখি আমাদের কুরআন শেখার আগে। এরপর আমরা কুরআন শিখি। এতে করে আমাদের ঈমান বেড়ে যায় বহুগুণে।’ (সহীহ ইবন মাজা : ৬১।)

    এ জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে কুরআন শেখানোর আগে ঈমান শিক্ষা দেন। আর ঈমান হলো- হাদীসে যেমন এসেছে : আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ».

    ‘ঈমানের সত্তরের কিছু বেশি অথবা (বর্ণনাকারীর মতে তিনি বলেছেন) ষাটের কিছু বেশি শাখা রয়েছে। এসবের সর্বোচ্চটি হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা এবং সর্বনিম্নটি হলো পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা। আর লজ্জা ঈমানের একটি অংশ।’ (মুসলিম : ১৬২; মুসনাদ আহমদ : ৯৩৫০।)

    প্রিয় পাঠক, আপনি নিশ্চয় দেখে থাকবেন, ছোট্র শিশু যে এখনো ভালো করে কথা বলতেও শেখেনি। যখন সে আজানের বাক্য শুনতে পায়, এর সুরে সুর মিলিয়ে, মুয়াজ্জিনের কণ্ঠের অনুকরণে সেও তার আওয়াজ লম্বা করে। এমনকি উপস্থিত ব্যক্তিদের অলক্ষ্যে সে প্রায়শই প্রতিবার আজানের সময় সচকিত ও উৎকর্ণ হয়। তারপর সে নিজের থেকেই তাওহীদের কালেমা, তাওহীদের নবীর রেসালাতের সাক্ষ্যের কালেমা আবৃত্তি করতে থাকে।

    আমার পাশের বাসার ছয় বছর বয়েসী নার্সারিতে পড়া বাচ্চাটি রোজ আজান দেয়। মসজিদের আজান শুরু হওয়া মাত্র পশ্চিম দিকের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সেও শুরু করে আজান দেয়া। বিস্ময়কর এবং ঈমান জাগানিয়া ব্যাপার হলো, বাচ্চাটির আজান হয় প্রায় নির্ভুল এবং উচ্চারণ ও কণ্ঠস্বর বেশ আকর্ষণীয়। সুতরাং প্রতিটি অভিভাবকেরই উচিত, কুঁড়ি থেকে মুকুলিত হবার আগেই নিজের শিশু সন্তানের যত্ন নেয়া। সুন্দর উচ্চারণে শিশুকে কালেমায়ে তাওহীদ তথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শিক্ষা দেয়া। তারপর কালেমার মর্ম ও মাহাত্ম্য শিখিয়ে দেয়া।

    সম্মানিত অভিভাবকবৃন্দ, আপনি যদি (‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’) কালেমায়ে তাওহীদের মর্ম উপলব্ধি করতেন, এর মাহাত্ম্য ও মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হতেন, তবে নিশ্চয় তা নিজের ভেতর দৃঢভাবে ধারণ করতেন এবং নিজ সন্তানকে এ কালেমা বারবার উচ্চারণ ও আবৃত্তি করার নির্দেশ দিতেন। আহমদ বিন হাম্বল রহ. আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «إِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ نُوحًا صلى الله عليه وسلم لَمَّا حَضَرَتْهُ الْوَفَاةُ قَالَ لِابْنِهِ : إِنِّي قَاصٌّ عَلَيْكَ الْوَصِيَّةَ ، آمُرُكَ بِاثْنَتَيْنِ ، وَأَنْهَاكَ عَنِ اثْنَتَيْنِ : آمُرُكَ بِلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ ، فَإِنَّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعَ وَالأَرَضِينَ السَّبْعَ ، لَوْ وُضِعْنَ فِي كِفَّةٍ وَوُضِعَتْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ فِي كِفَّةٍ لَرَجَحَتْ بِهِنَّ ، وَلَوْ أَنَّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعَ وَالأَرَضِينَ السَّبْعَ كُنَّ حَلْقَةً مُبْهَمَةً لَقَصَمَتْهُنَّ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ».

    ‘নূহ আলাইহিস সালামের যখন মৃত্যু উপস্থিত হলো, তিনি তখন তার পুত্রের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি তোমাকে সংক্ষেপে অসিয়ত করছি। তোমাকে দুটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি এবং দুটি বিষয় থেকে নিষেধ করছি। তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর। কেননা সাত আকাশ আর সাত যমীনকে যদি এক পাল্লায় রাখা হয় আর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কে রাখা হয় আরেক পাল্লায় তবে সাত আসমান ও যমীনের চেয়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-র পাল্লাই ভারী হবে। যদি সাত আসমান আর সাত যমীন কোনো হেঁয়ালীপূর্ণ বৃত্ত ধারণ করে তবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তা ভেদ করে চলে যাবে। [আল-আদাবুল মুফরাদ : ৫৪৮; মুসনাদ আহমদ : ৬৫৮৩।]

    উদ্দেশ্য হলো, সন্তান যখন আধো আধো ভাষায় অস্ফূটকণ্ঠে কথা বলতে শুরু করে, প্রথম যখন তার বাকপ্রতিভার অভিষেক ঘটে, তখন ঈমানের শাখাগুলোর মধ্যে প্রথম ও সর্বোচ্চটি তথা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর মাধ্যমেই তা করার চেষ্টা করা উচিত।

    একটি বিদেশি পত্রিকায় আমি একটি কার্টুন দেখেছিলাম। এর ক্যাপশনটি ছিল এমন : নিজ সন্তানের প্রথম বাক্যোচ্চারণ শুনে তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে গায়ক স্বামী তার স্ত্রীকে বলছেন, দেখ, আমাদের বাবুটি গড না বলে প্রথমেই বলছে ‘রাত’!! একজন কণ্ঠশিল্পীর শিশুর কাছে অবশ্য এমনটি অতি বেশি আশ্চর্যের কিছু নয়। কিন্তু বিপত্তি হলো আজকালের মুসলিম পরিচয়ধারী ভাইদের থেকেও এমন ঘটনা ঘটছে। যারা ইসলামের অনুসরণকে ধর্মান্ধতা (?) ভাবলেও নিজেরাই আবার পশ্চিমাদের অনুকরণ করেন অন্ধভাবে। ইদানীং এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। কেবল একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যাক :

    এক ভদ্রলোক তার নিষ্পাপ শিশুকে নিয়ে পথ চলছেন। বয়স তার অনুর্ধ্ব চার বছর। পথে দেখা হলে তার এক বন্ধু বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি? বাচ্চাটি একজন পপ গায়কের নামে তার পরিচয় দিল। বন্ধুটি বললেন, বাহ্! তুমি কি ওই শিল্পীর মতো গান গাইতে পারো? শিশুর বাবা গর্বিত কণ্ঠে বললেন, হ্যা, অবশ্যই। এমনকি তিনি সন্তানকে গান শুনিয়ে দিতেও নির্দেশ দিলেন। বাবার নির্দেশ পেয়ে শিশুটি গাইতে শুরু করলো। অথচ শিশুটি এখনো অনেক শব্দ উচ্চারণ করতে শেখেনি! ট কে সে বলছিল ত আর কঠিন শব্দগুলো উচ্চারণ করছিল তার কল্পনা মতো।

    আশা করি শিক্ষণীয় বিষয়টি বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। হ্যা, বলছিলাম নিজের শিশুটিকে শুরু থেকেই আল্লাহর নাফরমানীতে অভ্যস্ত না করে তাঁর প্রশংসা ও বড়ত্ব সূচক সুন্দর বাক্য উচ্চারণে অভ্যস্ত করা উচিত। আমাদের ভেবে দেখা দরকার নিজ সন্তানকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি। কোথায় আমরা আর কোথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী? কোথায় তাঁদের সন্তান আর কোথায় আমাদের সন্তান?

    ﴿فَمَن يُرِدِ ٱللَّهُ أَن يَهۡدِيَهُۥ يَشۡرَحۡ صَدۡرَهُۥ لِلۡإِسۡلَٰمِۖ وَمَن يُرِدۡ أَن يُضِلَّهُۥ يَجۡعَلۡ صَدۡرَهُۥ ضَيِّقًا حَرَجٗا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي ٱلسَّمَآءِۚ كَذَٰلِكَ يَجۡعَلُ ٱللَّهُ ٱلرِّجۡسَ عَلَى ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ﴾ [البقرة:125]

    ‘সুতরাং যাকে আল্লাহ হিদায়াত করতে চান, ইসলামের জন্য তার বুক উন্মুক্ত করে দেন। আর যাকে ভ্রষ্ট করতে চান, তার বুক সঙ্কীর্ণ-সঙ্কুচিত করে দেন, যেন সে আসমানে আরোহণ করছে। এমনিভাবে আল্লাহ অকল্যাণ দেন তাদের উপর, যারা ঈমান আনে না’।

    হে আল্লাহ, আমাদের বক্ষগুলোকে আপনার হিদায়াতের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। আমাদের সন্তাদের আপনার সন্তুষ্টিমাফিক গড়ে তোলার তাওফীক দেন। আমীন।