×
প্রবন্ধে সাহাবাদের মর্যাদা, তাদের সম্পর্কে মুসলিম আকীদা, তাদের মাঝে সংঘটিত মতবিরোধের ব্যাপারে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

    সাহাবীগণের মর্যাদা

    فضل الصحابة

    <بنغالي>

    সালেহ ইবন ফাওযান আল-ফাওযান

    صالح بن فوزان الفوزان

    —™

    অনুবাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    ترجمة: د/ محمد منظور إلهي

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    সাহাবীগণের মর্যাদা

    'সাহাবী' দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? তাদের ব্যাপারে আমাদের কী আকীদা পোষণ করা উচিত?

    আরবীতে 'সাহাবাহ' صحابة শব্দটি 'সাহাবী' صحابي শব্দের বহুবচন। সাহাবী ঐ ব্যক্তিকে বলা হয় যিনি মুমিন থাকা অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং ঈমানের ওপর মারা গিয়েছেন

    তাদের ব্যাপারে আমাদের এ আক্বীদা পোষণ করা ওয়াজিব যে, তারা উম্মতের অগ্রবর্তী দল এবং তাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য লাভ, তাঁর সাথে জিহাদ করা, তাঁর থেকে শরী'আত গ্রহণ করে পরবর্তীদের জন্য তা প্রচার করার উদ্দেশ্যে চয়ন করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা স্বীয় গ্রন্থ আল কুরআনে তাদের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন,

    ﴿ وَٱلسَّٰبِقُونَ ٱلۡأَوَّلُونَ مِنَ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ وَٱلۡأَنصَارِ وَٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوهُم بِإِحۡسَٰنٖ رَّضِيَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ وَرَضُواْ عَنۡهُ وَأَعَدَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي تَحۡتَهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۚ ذَٰلِكَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ١٠٠ ﴾ [التوبة: ١٠٠]

    “মুহাজির ও আনসারদের প্রথম অগ্রবর্তী দল এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, এটাই মহা সাফল্য।" [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০০]

    আল্লাহ তা'আলা অন্যত্র বলেন,

    ﴿مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ تَرَىٰهُمۡ رُكَّعٗا سُجَّدٗا يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗاۖ سِيمَاهُمۡ فِي وُجُوهِهِم مِّنۡ أَثَرِ ٱلسُّجُودِۚ ذَٰلِكَ مَثَلُهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِۚ وَمَثَلُهُمۡ فِي ٱلۡإِنجِيلِ كَزَرۡعٍ أَخۡرَجَ شَطَۡٔهُۥ فََٔازَرَهُۥ فَٱسۡتَغۡلَظَ فَٱسۡتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِۦ يُعۡجِبُ ٱلزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ ٱلۡكُفَّارَۗ وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِنۡهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمَۢا ٢٩﴾ [الفتح: ٢٩]

    'মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্ট কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদার প্রভাবের চি‎হ্ন পরিস্ফুট থাকবে। তাওরাতে তাদের বর্ণনা এরূপ। আর ইঞ্জিলে তাদের বর্ণনা হল যেমন একটি চারাগাছ, যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অত:পর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, যা চাষীকে আনন্দে অভিভূত করে যাতে আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন।" [সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ২৯]

    অন্য আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন,

    ﴿لِلۡفُقَرَآءِ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ ٱلَّذِينَ أُخۡرِجُواْ مِن دِيَٰرِهِمۡ وَأَمۡوَٰلِهِمۡ يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗا وَيَنصُرُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ ٨ وَٱلَّذِينَ تَبَوَّءُو ٱلدَّارَ وَٱلۡإِيمَٰنَ مِن قَبۡلِهِمۡ يُحِبُّونَ مَنۡ هَاجَرَ إِلَيۡهِمۡ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمۡ حَاجَةٗ مِّمَّآ أُوتُواْ وَيُؤۡثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ وَلَوۡ كَانَ بِهِمۡ خَصَاصَةٞۚ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفۡسِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٩﴾ [الحشر: ٨، ٩]

    “এ সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরগণের জন্য যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি থেকে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। তারাই সত্যবাদী। আর এ সম্পদ তাদের জন্যও, যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে এ নগরীতে বসবাস করেছে এবং ঈমান এনেছে। তারা মুহাজিরদেরকে ভালোবাসে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেওয়া হয়েছে, তার জন্য তারা অন্তুরে ঈর্ষা পোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদেরকে নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয়। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।" [সূরা আল-হাশর, আয়াত : 8, 9]

    এ আয়াতসমূহে আল্লাহ তা'আলা মুহাজির এবং আনসারদের প্রশংসা করেছেন যারা সবার আগে কল্যাণের প্রতি অগ্রসর হয়েছে। আর এ কথাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাদের জন্য জান্নাতসমূহ প্রস্তুত করে রেখেছেন। তাদের সম্পর্কে আরো বলেছেন যে, তারা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর, বেশি বেশি রুকু ও সাজদাহরত, সৎ হৃদয় সম্পন্ন। তাদের চেহারায় ঈমান ও আনুগত্যের চি‎‎হ্ন রয়েছে, তা দ্বারা তাদেরকে চেনা যায়। আল্লাহ স্বীয় নবীর সাহচর্য লাভের জন্য তাদেরকে এখতিয়ার করেছেন। যাতে তাদের দ্বারা স্বীয় শত্রু কাফিরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। অধিকন্তু মুহাজিরদের বর্ণনায় তিনি বলেছেন, তারা শুধু আল্লাহর জন্য তাঁর দীনের সাহায্যার্থে এবং তাঁর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিজেদের মাতৃভূমি ও সহায়- সম্পদ ত্যাগ করেছেন, এ কাজে তারা ছিলেন সত্যাশ্রয়ী।

    আনসারদের বৈশিষ্ট্য তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তারা হিজরতের আবাসস্থল এবং নুসরত তথা সহযোগিতা ও সত্যিকার ঈমানের আবাস ভূমির বাসিন্দা। তাদের সম্পর্কে এও বলেছেন যে, তারা তাদের মুহাজির ভাইদেরকে ভাল-বাসে, নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়, তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করে এবং তারা কৃপণতা থেকেও মুক্ত। এভাবেই তারা সফলতা অর্জন করেছে।

    এগুলো হলো সাহাবীগণের কিছু গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য যা তাদের সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এ ছাড়াও তাদের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য মর্যাদা ছিল, যদ্বারা তারা একে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। আর এ শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণীত হয়েছে ইসলাম, জিহাদ ও হিজরতের প্রতি তাদের অগ্রে অংশ গ্রহণের অনুপাতে।

    সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সর্বোত্তম চার খলীফা: আবু বকর, উমার, উসমান এবং আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুম। এরপর স্থান হলো জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবীর অবশিষ্ট সাহাবীগণ। তারা হলেন তালহা, যুবাইর, আব্দুর রহমান ইবন আওফ, আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ, সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস, সাঈদ ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু 'আনহুম।

    আনসারদের ওপর মুহাজিরদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে। বদরের যুদ্ধ ও বাই'আতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী সাহাবীগণের এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। মক্কা বিজয়ের পূর্বে যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং জিহাদ করেছেন, তাকে মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে।

    ১. সাহাবীগণের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ ও ফিতনা সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের মত:

    ফিতনার কারণ: ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইয়াহূদীরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারা এক নিকৃষ্ট প্রতারককে এ কাজের জন্য নির্ধারণ করে, যে মিছেমিছি নিজেকে মুসলিম বলে জাহির করতো। সে ছিল আব্দুল্লাহ ইবন সাবা নামক ইয়ামানের এক ইয়াহূদী। অতঃপর এ ইয়াহূদী খোলাফায়ে রাশেদীনের তৃতীয় খলীফা উসমান ইবন আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু 'আনহু-এর বিরুদ্ধে তার হিংসা ও ঈর্ষার বিষ সম্প্রসারিত করতে শুরু করে এবং তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে থাকে। ফলে কিছু অদূরদর্শী দুর্বল ঈমানের অধিকারী লোক - যারা ফিতনা-ফাসাদ পছন্দ করে তার ধোঁকায় পতিত হয়ে তার পাশে জমায়েত হলো, এ ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতে শেষ পর্যন্ত খলীফায়ে রাশেদ উসমান রাদিয়াল্লাহু 'আনহু নিতান্ত মযলুম হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। তার শাহাদাতের পর মুসলিমদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল। উক্ত ইয়াহূদী এবং তার অনুসারীদের প্ররোচনায় এ ফিতনা প্রবল আকার ধারণ করল এবং সাহাবীগণ নিজ নিজ ইজতেহাদ মোতাবেক যুদ্ধে লিপ্ত হলেন।

    'আত-তাহাবিয়া' গ্রন্থের ব্যাখ্যাকারক বলেন: رفض 'রাফদ' এর ফিতনা সৃষ্টি করে এক মুনাফিক ও যিন্দিক তথা বে-দীন ব্যক্তি। তার ইচ্ছা ছিল দীন ইসলামকে মিটিয়ে দেওয়া এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে নিন্দা ও কুৎসা রটনা করা যেমন উলামায়ে কেরাম তা বর্ণনা করেছেন। কেননা আব্দুল্লাহ বইন সাবা যখন ইসলামের ছদ্মবেশ ধারণ করে, তখন সে মূলতঃ স্বীয় ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও নোংরামীর জাল বিস্তার করে ইসলামের বিপর্যয় ও ক্ষতি সাধন করতেই চেয়েছিল, খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে ইয়াহূদী ধর্ম যেমনটা করেছিল। তাই সে ইবাদাতগুজার হওয়ার ভান করল। সৎ কাজের নির্দেশ দান এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করার কাজ জাহির করতে লাগল এমনকি উসমান রাদিয়াল্লাহু 'আনহু সম্পর্কে ফিতনা ছড়িয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টায় সে লিপ্ত হল। এর পর যখন সে কুফায় এলো, তখন আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর পক্ষে বাড়াবাড়ি করা ও তাকে সাহায্য করার ভান করলো, যাতে সে তার উদ্দেশ্য সাধনে সিদ্ধি লাভ করতে পারে। আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর কাছে সে নির্দেশ পৌঁছোলে তিনি তাকে হত্যার হুকুম দিলেন। কিন্তু সে কার্কিস এর দিকে পালিয়ে গেল। ইতিহাসে তার সব ঘটনাই প্রসিদ্ধ।

    শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহ. বলেন: যখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু শাহাদাত বরণ করলেন, তখন মুসলিমদের হৃদয় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং সৎ লোকেরা অপদস্ত হল। যারা আগে ফিতনা সৃষ্টি করতে অক্ষম ছিল, তারা ফিতনা সৃষ্টি করে বেড়াতে লাগল এবং যারা কল্যাণ ও সততা প্রতিষ্ঠা করতে চাইত, তারা তা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়ে গেল। এমতাবস্থায় লোকেরা আমীরুল মুমিনীন আলী ইবন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর কাছে বাই'আত গ্রহণ করল। সে সময় তিনিই খেলাফতের সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন এবং জীবিত সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন; কিন্তু যেহেতু মানুষের অন্তকরণ হয়ে পড়েছিল বিভক্ত এবং ফিতনা-ফাসাদের আগুন ছিল প্রজ্বলিত, তাই এক কথার ওপর সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নি। মুসলিমদের জামা'আত ও সুসংগঠিত হতে পারে নি। ফলে খলীফা নিজে এবং উম্মাতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বর্গের কেউই ঈপ্সিত কল্যাণ সাধন করতে সমর্থ হন নি। বহু লোক বিচ্ছিন্নবাদিতা ও ফিতনা ফাসাদে লিপ্ত হল। এরপর যা হবার তাই হলো।

    আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহু এবং মু'আবিয়া রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর মধ্যকার যুদ্ধে সাহাবায়ে কেরামের পরস্পরের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ বিবাদ সম্পর্কে ওজর পেশ করতে গিয়ে ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন: আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর সাথে যুদ্ধের সময় মু'আবিয়া রাদিয়াল্লাহু 'আনহু খেলাফত দাবি করেন নি এবং খেলাফতের জন্য কেউ তার কাছে বাই'আতও করেন নি। নিজেকে খলীফা মনে করে কিংবা খেলাফতের হকদার ভেবে তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন নি। এ ব্যাপারে যে কেউ প্রশ্ন করলে তিনি সে কথারই স্বীকৃতি প্রদান করতেন। মু'আবিয়া রাদিয়াল্লাহু 'আনহু এবং তার সাথীগণ এ মনোভাব পোষণ করেননি যে, তারা আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহু ও তার সাথীদের সাথে যুদ্ধ শুরু করবেন এবং নিজেদেরকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরবেন বরং আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর সাথীগণ ভাবলেন, মু'আবিয়া রাদিয়াল্লাহু 'আনহু এবং তার ও তার সঙ্গীদের উচিত আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর আনুগত্য করা এবং তার কাছে বাই'আত করা। কেননা মুসলিমদের জন্য একজন খলীফাই শুধু হতে পারে। এদিক থেকে তারা আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর আনুগত্য থেকে দূরে অবস্থান করছে এবং এ দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকছে অথচ তারা শক্তিমত্তারও অধিকারী। তাই আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহু তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জরুরি মনে করলেন। যাতে তারা এ দায়িত্ব পালন করে এবং খলীফার আনুগত্য ও জামা'আতের ঐক্য বহাল থাকে। পক্ষান্তরে মু'আবিয়া রাদিয়াল্লাহু 'আনহু ও তার সাথীদের বক্তব্য ছিল: আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহু-এর আনুগত্য ও বাই'আত তাদের ওপর ওয়াজিব নয় এবং এজন্য যদি তাদের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তাহলে তারা হবেন মজলুম। এর কারণ বর্ণনায় তারা বলেন: কেননা সকল মুসলমানের ঐক্যমতে উসমান রাদিয়াল্লাহু 'আনহু মজলুম হয়ে শহীদ হয়েছেন এবং তার হত্যাকারীগণ আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর বাহিনীতে অবস্থান করছে। বাহিনীতে তাদেরই প্রাধান্য এবং শক্তি বিদ্যমান। আমরা সংযত থাকলে তারা আমাদের ওপর যুলুম করবে এবং চড়াও হবে অথচ আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর পক্ষে তাদেরকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। যেমনিভাবে উসমান রাদিয়াল্লাহু 'আনহুর ব্যাপারে তাদেরকে বাধা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। অতএব, আমাদের এমন খলীফার কাছে বাই'আত হওয়া উচিত, যিনি আমাদের প্রতি ইনসাফ করতে সক্ষম এবং আমাদের প্রতি ইনসাফ করার জন্য তিনি চেষ্টা সাধনা করবেন।

    সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ বিগ্রহের ফলে যে মতবিরোধ ও ফিতনা সৃষ্টি হয়েছে, সে সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আতের মতকে দু'কথায় সংক্ষিপ্তভাবে ব্যক্ত করা যায়।

    প্রথমত: সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ ও মতবিরোধের ব্যাপারে তারা চুপ থাকবে এবং এ ব্যাপারে তারা চুলচেরা বিশ্লেষণ থেকেও বিরত থাকবে। কেননা এ ধরনের ক্ষেত্রে চুপ থাকাটাই নিরাপত্তা লাভের পন্থা। আর তাদের জন্য এ ভাবে দো'আ করবে।

    ﴿رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [الحشر: ١٠]

    “হে আমাদের রব! আমাদেরকে এবং আমাদের আগে আমাদের যে সব ভাইয়েরা ঈমান এনেছে তাদেরকে ক্ষমা করুন। আর ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! আপনি দয়ালু, পরম করুণাময়।" [সূরা আল-হাশর, আয়াত নম্বর: ১০]

    ২. যেসব রিওয়ায়েতে সাহাবায়ে কেরামের নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে, বিভিন্ন পন্থায় নিম্নলিখিতরূপে সেগুলোর জবাব দেওয়া:

    ক. এসব রিওয়ায়েতের মধ্যে এমন কিছু মিথ্যা বর্ণনাও রয়েছে যা সাহাবায়ে কেরামের বদনাম করার উদ্দেশ্যে তাদের ও ইসলামের শত্রুগণ রচনা করেছে।

    খ. এগুলোতে এমন বর্ণনাও আছে যাতে কিছু পরিবর্ধন করা হয়েছে, কিছু বাদ দেওয়া হয়েছে এবং এর সঠিক রূপটি বিগড়ে দিয়ে তাতে মিথ্যার অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে। ফলে তা বিকৃত বলে পরিগণিত, যার দিকে ফিরে তাকানোও ঠিক নয়।

    গ. এ রিওয়ায়েতগুলোর ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম মা'জুর ছিলেন বলে মনে করতে হবে। কেননা তারা সকলেই ইজতিহাদ করেছিলেন এবং এতে হয় তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন কিংবা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর বিষয়টিও ছিল ইজতেহাদের ক্ষেত্র যাতে ইজতেহাদকারী সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে পাবেন দু'টি সওয়াব এবং ভুল করলে একটি সাওয়াব ও ভুলটি ক্ষমা করে দেওয়া হবে। কেননা হাদীসে এসেছে,

    «إِذَا حَكَمَ الحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ»

    “হুকুম দানকারী কোনো ব্যক্তি যদি ইজতেহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করেন, তবে তিনি দু'টি সওয়াব পাবেন এবং ইজতিহাদ করে ভুল সিদ্ধান্ত দিলে একটি সওয়াব পাবেন।"[1]

    ঘ. তারা ছিলেন আমাদের মতই মানুষ। একক ভাবে তারাও ভুল করতে পারেন। তাই একক ব্যক্তি হিসাবে তারা কেউই গোনাহ-খাতা থেকে মাসুম ছিলেন না; কিন্তু তাদের থেকে যে ভুল-ত্রুটিই প্রকাশিত হয়েছে সে জন্য তাদের বহু কাফফারা তথা নেক আমল রয়েছে, যদ্বারা সে ভুল-ত্রুটি মাফ হয়ে যায়। যেমন,

    ১. সে ভুল থেকে তারা তাওবা করেছেন। আর দলীল দ্বারা প্রমাণিত যে, তাওবা সকল গুনাহ-খাতা মিটিয়ে দেয়।

    ২. তাদের অনেক ফযীলত ও নেক আমল রয়েছে, যদ্বারা তাদের কোনো গুনাহ-খাতা প্রকাশ পেলে তা মাফ হয়ে যায়। যেমন, আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,

    ﴿إِنَّ ٱلۡحَسَنَٰتِ يُذۡهِبۡنَ ٱلسَّئَِّاتِۚ﴾ [هود: ١١٤]

    “পুণ্য কাজ অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়।" [সূরা হূদ, আয়াত: ১১৪]

    ৩. অন্যদের নেক আমলের চেয়ে তাদের নেক আমলসমূহ বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। ফযীলত ও মর্যাদায় কেউ তাদের সম পর্যায়ে উপনীত হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য হতে প্রমাণিত যে, তারাই ছিলেন সর্বোত্তম প্রজন্ম, তাদের এক মুদ বা এক অঞ্জলী পরিমাণ সদকা অন্যদের অহুদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণ সদকা করার চেয়ে উত্তম। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন এবং তাদেরকে ও সন্তুষ্ট রাখুন।

    শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহ. বলেন: সকল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা'আত ও আয়িম্মায়ে কেরাম মনে করেন যে, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউই মাসুম নয়; না রাসূলের আত্মীয় সম্পর্কের কেউ, না সাহাবীগণের অগ্রবর্তী দলের কেউ এবং না এতদ্ব্যতীত অন্য কেউ। বরং তাদের মতে সাহাবীগণের থেকে গুনাহ প্রকাশ পেতে পারে। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা তাওবা দ্বারা তাদের গুনাহ মাফ করে দেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। তাদের নেক আমলের বিনিময়ে তাদের গুনাহ মিটিয়ে দেন ইত্যাদি আরো বহু পন্থায় তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন,

    ﴿وَٱلَّذِي جَآءَ بِٱلصِّدۡقِ وَصَدَّقَ بِهِۦٓ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُتَّقُونَ ٣٣ لَهُم مَّا يَشَآءُونَ عِندَ رَبِّهِمۡۚ ذَٰلِكَ جَزَآءُ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٣٤ لِيُكَفِّرَ ٱللَّهُ عَنۡهُمۡ أَسۡوَأَ ٱلَّذِي عَمِلُواْ وَيَجۡزِيَهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ ٱلَّذِي كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٣٥﴾ [الزمر: ٣٣، ٣٥]

    “যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই মুত্তাকী। তাদের জন্য তাদের পালন কর্তার কাছে তাই রয়েছে, যা তারা চাইবে। এটা সৎকর্মশীলদের পুরস্কার, যাতে এরা যে সব মন্দ কাজ করেছিল আল্লাহ তা মার্জনা করে দেন এবং তাদের উত্তম কর্মের পুরস্কার তাদেরকে দান করেন।" [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩৩-৩৫]

    অন্যত্র আল্লাহ বলেন:

    ﴿حَتَّىٰٓ إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُۥ وَبَلَغَ أَرۡبَعِينَ سَنَةٗ قَالَ رَبِّ أَوۡزِعۡنِيٓ أَنۡ أَشۡكُرَ نِعۡمَتَكَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتَ عَلَيَّ وَعَلَىٰ وَٰلِدَيَّ وَأَنۡ أَعۡمَلَ صَٰلِحٗا تَرۡضَىٰهُ وَأَصۡلِحۡ لِي فِي ذُرِّيَّتِيٓۖ إِنِّي تُبۡتُ إِلَيۡكَ وَإِنِّي مِنَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٥ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ نَتَقَبَّلُ عَنۡهُمۡ أَحۡسَنَ مَا عَمِلُواْ وَنَتَجَاوَزُ عَن سَئَِّاتِهِمۡ فِيٓ أَصۡحَٰبِ ٱلۡجَنَّةِۖ ١٦ ﴾ [الاحقاف: ١٥، ١٦]

    “অবশেষে যখন সে শক্তি সামর্থ্যের বয়সে পৌঁছে এবং চল্লিশ বৎসরে উপনীত হয়, তখন বলে, হে আমার রব! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার নি'আমতের শোকর করতে পারি, যা তুমি দান করেছ আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকাজ করতে পারি। আমার জন্য আমার সন্তানদেরকে সৎকর্মপরায়ণ কর। আমি তোমার কাছে তাওবা করলাম এবং আমি অবশ্যই তোমার নির্দেশ মান্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত। আমি এমন লোকদেরই সুকৃতিগুলো কবুল করি এবং মন্দ কর্মগুলো ক্ষমা করে দেই। তারা জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত।" [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ১৫-১৬]

    ফিতনার সময় সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যে মতবিরোধ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছিল, ইসলামের শত্রুগণ তাকে সাহাবীগণের ওপর অপবাদ আরোপ করার এবং তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করার উপায় বানিয়ে নিয়েছে, এমনকি তারা নিজেদের কর্মের মাধ্যমে ইসলামের সুবর্ণ ইতিহাস ও সর্বোত্তম যুগের সালফে সালেহীন সম্পর্কে অনবহিত কিছুসংখ্যক মুসলিম যুবকদের মধ্যে সন্দেহের বীজ বপন করেছে, যাতে করে তারা ইসলামের প্রতি আঘাত হানতে পারে, ও মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তি আনয়ন করতে পারে এবং এ উম্মতের পূর্ববর্তীদের প্রতি পরবর্তীদের মনে একরাশ ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে পারে, যেন তারা সালফে সালেহীনের অনুকরণ না করে এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আমল করাও ছেড়ে দেয়। অথচ আল্লাহ বলেন:

    ﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠﴾ [الحشر: ١٠]

    “আর যারা তাদের পরে আগমন করেছে, তারা বলে: হে আমাদের রব! আমাদেরকে এবং আমাদের আগে আমাদের যে সব ভাইয়েরা ঈমান এনেছে তাদেরকে ক্ষমা করুন। আর ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! আপনি দয়ালু, পরম করুণাময়।" [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১০]

    সমাপ্ত

    [1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৩৫২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭১৬