×
এটি আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত তাফসীরের প্রথম অংশ। সরল ও সাবলীল বাংলায় অনুবাদসহ বিভিন্ন আয়াতের মৌলিক শিক্ষণীয় বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সংক্ষিপ্ত এ তাফসীরে। অনুবাদের ক্ষেত্রে আল-বায়ান ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত আল-কুরআনের সরল অর্থানুবাদ-এর আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে সূরা আল-বাকারা-এর ৮৩নং আয়াত থেকে ১৪১নং আয়াত পর্যন্ত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

    আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত তাফসীর: ৩য় পর্ব

    [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৮৩-১৪১]

    التفسير الموجز للقرآن الكريم: الجزء الثالث

    سورة البقرة: الآيات (141-83)

    < بنغالي- Bengal - বাঙালি>

    কতিপয় উলামা

    مجموعة من العلماء

    —™

    সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    مراجعة: د/ محمد منظور إلهي

    আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত তাফসীর: ৩য় পর্ব

    সূরা আল-বাকারা

    ৮৩ আয়াত থেকে ১৪১ আয়াত পর্যন্ত অর্থসহ সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা

    اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

    بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

    আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই অভিশপ্ত শয়তান থেকে; পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে শুরু করছি

    ﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ لَا تَعۡبُدُونَ إِلَّا ٱللَّهَ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَانٗا وَذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَقُولُواْ لِلنَّاسِ حُسۡنٗا وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ ثُمَّ تَوَلَّيۡتُمۡ إِلَّا قَلِيلٗا مِّنكُمۡ وَأَنتُم مُّعۡرِضُونَ ٨٣ ﴾ [البقرة: ٨٣]

    ৮৩. আর স্মরণ কর, যখন আমরা বনী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করবে না, সদাচার করবে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিসকীনদের সাথে। আর মানুষকে উত্তম কথা বল,১০৮ সালাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক ছাড়া১০৯ তোমরা ফিরে গেলে। আর তোমরা (স্বীকার করে অতঃপর তা থেকে) বিমুখ হও।

    ১০৮. এখানে রয়েছে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে ইবাদাতের সকল অনুভূতি, তা বাস্তবায়ন করার তাগিদ, মাতা-পিতার প্রতি সদাচার, আত্মীয়-পরিজন, ইয়াতীম, অসহায়দের সাথে উত্তম ব্যবহার এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সাথে সদাচার, নম্র ব্যবহার ও ভালো কথা বলার তাগিদ; তবে সদাচারের অজুহাতে কারও ক্ষেত্রেই দীনের ব্যাপারে ছাড় দেওয়া যাবে না। এমনকী কেউ ফিরআউন তুল্য হলেও বিনম্র ভাষায় দীনের আদর্শ প্রচারে সর্বাত্মক সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োগ করতে হবে তাকে বুঝাতে সকল পথ ও পদ্ধতি।

    ১০৯. এরা তাওরাতের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন এবং আল্লাহ তাদেরকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রেখেছিলেন।

    ﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ لَا تَسۡفِكُونَ دِمَآءَكُمۡ وَلَا تُخۡرِجُونَ أَنفُسَكُم مِّن دِيَٰرِكُمۡ ثُمَّ أَقۡرَرۡتُمۡ وَأَنتُمۡ تَشۡهَدُونَ ٨٤﴾ [البقرة: ٨٤]

    ৮৪. আর যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা নিজদের রক্ত প্রবাহিত করবে না এবং নিজদেরকে তোমাদের গৃহসমূহ থেকে বের করবে না। অতঃপর তোমরা স্বীকার করে নিলে। আর তোমরা তার সাক্ষ্য প্রদান করছিলে।

    ১০০. মানব হত্যা আসমানী ধর্মে নিষিদ্ধ। বনী ইসরাঈলদের কাছ থেকেও আল্লাহ তা‘আলা মানব হত্যা না করার অঙ্গিকার নিয়েছিলেন। কেবল যুদ্ধের ময়দানে যতটুকু না হলেই নয় এবং শরী‘আতের বিধান মোতাবেক কিসাস ও হুদূদ বাস্তবায়নের জন্যই, সীমিত ক্ষেত্রে, রক্তপাতের বৈধতা রয়েছে।

    ﴿ثُمَّ أَنتُمۡ هَٰٓؤُلَآءِ تَقۡتُلُونَ أَنفُسَكُمۡ وَتُخۡرِجُونَ فَرِيقٗا مِّنكُم مِّن دِيَٰرِهِمۡ تَظَٰهَرُونَ عَلَيۡهِم بِٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِ وَإِن يَأۡتُوكُمۡ أُسَٰرَىٰ تُفَٰدُوهُمۡ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيۡكُمۡ إِخۡرَاجُهُمۡۚ أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٨٥﴾ [البقرة: ٨٥]

    ৮৫. অতঃপর তোমরাই তো তারা, যারা নিজদেরকে হত্যা করছ এবং তোমাদের মধ্য থেকে একটি দলকে তাদের গৃহ থেকে বের করে দিচ্ছ; পাপ ও সমীলঙ্ঘনের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে সহায়তা করছ। আর তারা যদি বন্দী হয়ে তোমাদের নিকট আসে, তোমরা মুক্তিপণ দিয়ে তাদেরকে মুক্ত কর। অথচ তাদেরকে বের করা তোমাদের জন্য হারাম ছিল।১১০ তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে? দুনিয়ার জীবনে। আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে।১১১ আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।

    ১১০. এ ব্যাপারটি বুঝতে একটু ধৈর্য্যের সাথে তৎকালীন প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নেওয়া দরকার। মদীনার আওস ও খাযরাজ নামে দু’টি গোত্র পরস্পর শত্রু ছিল, তাই তাদের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকত। মদীনার উপকণ্ঠে বাস করত বনী কুরায়যা ও বনী নাযীর নামের দু’টি ইয়াহূদী গোত্র। বনী কুরায়যা ছিল আওস গোত্রের মিত্র; অপরদিকে খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল বনী নাযীর।

    বনী কুরায়যার লোকদেরকে হত্যা ও বহিষ্কার করার পেছনে খাযরাজ গোত্রের মিত্র বনী নাযীরের সক্রিয় ভূমিকা থাকত। অনুরূপভাবে বনী নাযীরকে হত্যা ও বহিষ্কারে ইন্ধন যোগাতো আওস গোত্রের মিত্র বনী কুরায়যা। তবে একটি ব্যাপারে উভয় ইয়াহূদী গোত্র ছিল এক ও অভিন্ন। তাহল, ইয়াহূদী গোত্রদ্বয়ের কেউ যদি অন্য গোত্রের কারো হাতে বন্দী হতো, তাহলে নিজ মিত্রদের অর্থে তাকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিত। কেউ এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তারা বলত, বন্দী মুক্তকরণ আমাদের ওপর ওয়াজিব। আবার আরব গোত্রদ্বয়ের পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তারা বলত, মিত্রদের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকা লজ্জার ব্যাপার!

    তাই এ-আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদের এ-দ্বিমুখী আচরণের নিন্দা করেছেন এবং খুলে দিয়েছেন তাদের ঘৃণ্য কূট-কৌশলের মুখোশ।

    ১১১. এ-হল সর্বকালের সর্বযুগের মানবগোষ্ঠির জন্যে আসমানী বিধান। অর্থাৎ যারা কিতাবের সুবিধাজনক অংশগুলোকে বিশ্বাস করে ও মানে, আর নিজেদের তথাকথিত দুনিয়াবী স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোকে ছল-চাতুরীর মাধ্যমে অথবা স্পষ্টভাবে অবিশ্বাস ও অমান্যে করে, তাদের পরিণতি হলো কঠিনতম আযাব যাতে তারা নিক্ষিপ্ত হবে।

    ﴿أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱشۡتَرَوُاْ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا بِٱلۡأٓخِرَةِۖ فَلَا يُخَفَّفُ عَنۡهُمُ ٱلۡعَذَابُ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ٨٦﴾ [البقرة: ٨٦]

    ৮৬. তারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে খরিদ করেছে।১১২ সুতরাং তাদের থেকে আযাব হালকা করা হবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।

    ১১২. অথচ যা হওয়া উচিৎ, তা মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন এভাবে: নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জান-মাল জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। দেখুন: সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ১১১।

    ﴿وَلَقَدۡ ءَاتَيۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَٰبَ وَقَفَّيۡنَا مِنۢ بَعۡدِهِۦ بِٱلرُّسُلِۖ وَءَاتَيۡنَا عِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ ٱلۡبَيِّنَٰتِ وَأَيَّدۡنَٰهُ بِرُوحِ ٱلۡقُدُسِۗ أَفَكُلَّمَا جَآءَكُمۡ رَسُولُۢ بِمَا لَا تَهۡوَىٰٓ أَنفُسُكُمُ ٱسۡتَكۡبَرۡتُمۡ فَفَرِيقٗا كَذَّبۡتُمۡ وَفَرِيقٗا تَقۡتُلُونَ ٨٧ ﴾ [البقرة: ٨٧]

    ৮৭. আর আমরা নিশ্চয় মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে একের পর এক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং মারইয়াম পুত্র ঈসাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ।১১৩ আর তাকে শক্তিশালী করেছি পবিত্র আত্মার১১৪ মাধ্যমে। তবে কি তোমাদের নিকট যখনই কোনো রাসূল এমন কিছু নিয়ে এসেছে, যা তোমাদের মনঃপূত নয়, তখন তোমরা অহঙ্কার করেছ, অতঃপর (নবীদের) একদলকে তোমরা মিথ্যাবাদী বলেছ আর একদলকে হত্যা করেছ।

    ১১৩. ‘সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী’র দ্বারা সেই উজ্জ্বল আলামত ও চিহ্নগুলোকে বুঝানো হয়েছে, যা দেখে প্রতিটি সত্যপ্রিয় ও সত্যানুসন্ধিৎসু মানুষ ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর নবী হিসেবে চিনতে পারে।

    ১১৪. ‘পবিত্র রূহ’ বলতে এখানে জিবরীল আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে।

    ﴿وَقَالُواْ قُلُوبُنَا غُلۡفُۢ ۚ بَل لَّعَنَهُمُ ٱللَّهُ بِكُفۡرِهِمۡ فَقَلِيلٗا مَّا يُؤۡمِنُونَ ٨٨ ﴾ [البقرة: ٨٨]

    ৮৮. আর তারা বলল, আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত; ১১৫ বরং তাদের কুফুরীর কারণে আল্লাহ তাদেরকে লা‘নত করেছেন। অতঃপর তারা খুব কমই ঈমান আনে।১১৬

    ১১৫. ইয়াহূদীরা বুঝাতে চায় যে, তাদের অন্তরগুলো দৃঢ় আচ্ছাদন দিয়ে সুরক্ষিত; তা পরিবর্তনের জন্যে কোনো যুক্তি বা প্রমাণ -এমন কি আল্লাহর আয়াতসমূহের বক্তব্যের আলোকে চেষ্টা করলেও তাতে কোনো প্রভাব পড়ে না। এটি তাদের নিরেট একগুঁয়েমি, অজ্ঞতা, মুর্খতা ও বিদ্বেষপ্রসুত একধরণের হঠকারী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। বস্তুতঃ তারা তাদের কিতাবে উল্লিখিত পরবর্তী নবী আগমনের পূর্বাভাষ অনুযায়ী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সুস্পষ্টভাবে চিনতে পেরেও সচেতনভাবে তাঁকে অস্বীকার করেছে।

    এছাড়া বর্তমান বিকৃত তাওরাত ও বাইবেলের কয়েকটি উদ্ধৃতি হুবহু এখানে তুলে দেওয়া হলো যেখানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন বিষয়ে ভবিষ্যৎবাণী রয়েছে:

    প্রকৃত ও নকল নবী

    ১৮আমি ওদের জন্য ওদের ভাইদের মধ্য থেকে তোমার মতো এক নবীর উদ্ভব ঘটাব ও তার মুখে আমার বাণী রেখে দেব; আমি তাকে যা কিছু আজ্ঞা করব, তা সে তাদের বলবে।১৯ আর আমার নামে সে আমার যে সকল বাণী বলবে, সেই বাণীতে কেউ যদি কান না দেয়, তবে তার কাছে আমি জবাবদিহি চাইব।

    তাওরাত: দ্বিতীয় বিবরণ, অধ্যায় ১৮, শ্লোক ১৮-১৯

    ××× ××× ××× ××× ××× ×××

    বিদায় উপদেশ

    সহায়ক পবিত্র আত্মার আগমন, শিষ্যদের আনন্দ

    ৫এখন কিন্তু আমি তাঁরই কাছে যাচ্ছি যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, অথচ তোমাদের কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করছে না, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? ৬কিন্তু এ সমস্ত তোমাদের বলেছি বিধায়ই তোমাদের মন দুঃখে ভরে গেছে। ৭তা সত্ত্বেও আমি তোমাদের সত্যকথা বলছি: আমার চলে যাওয়াটা তোমাদের পক্ষে ভালো। কারণ, আমি চলে না গেলে সেই সহায়ক তোমাদের কাছে আসবেন না; বরং যদি যাই, তাহলে আমি তাঁকে তোমাদের কাছে পাঠাব ৮আর তিনি এসে জগৎকে পাপের বিষয়ে দোষী বলে সাব্যস্ত করবেন, (এবং ব্যক্ত করবেন)

    ××× ××× ××× ××× ××× ×××

    ধর্মময়তা ও বিচার কী।

    ১২তোমাদের কাছে আমার আরও অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু তোমরা এখন তা সহ্য করতে পার না। ১৩তবে তিনি যখন আসবেন, সেই সত্যময় আত্মা, তিনিই পূর্ণ সত্যের মধ্যে তোমাদের চালনা করবেন। কারণ, তিনি নিজে থেকে কিছুই বলবেন না; কিন্তু যে সমস্ত কথা শোনেন, তিনি তা-ই বলবেন; যা যা ঘটবার, তাও তিনি তোমাদের বলে দেবেন। ১৪তিনি আমাকে গৌরবান্বিত করবেন, কারণ যা আমার, তা-ই তুলে নিয়ে তিনি তা তোমাদের বলে দেবেন।

    বাইবেল: যোহন-রচিত সুসমাচার, অধ্যায় ১৬, শ্লোক ৫-৮ এবং ১২-১৪

    ১১৬. অর্থাৎ ইয়াহূদীরা তাদের গর্ব-অহংকারের কারণে মনে করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য এমনই যে, তা কোনো জ্ঞানী লোকের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে না; অথচ প্রকৃত ব্যাপার এর সম্পূর্ণ বিপরীত। নিঃসন্দেহে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থাপনা পুরোপুরি অহী-ভিত্তিক, অত্যন্ত সারগর্ভ ও হৃদয়গ্রাহী। কিন্তু তাদের কুফুরী ও হঠকারিতার ফলে মহান আল্লাহ তাদের অন্তরের উপর অভিশম্পাত বর্ষণ করেছেন, আর তাই কোনো যুক্তিপূর্ণ ও জ্ঞানময় কথা মনে-প্রাণে গ্রহণ করার কোনো যোগ্যতাই তাদের আর অবশিষ্ট নেই।

    ﴿وَلَمَّا جَآءَهُمۡ كِتَٰبٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٞ لِّمَا مَعَهُمۡ وَكَانُواْ مِن قَبۡلُ يَسۡتَفۡتِحُونَ عَلَى ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَلَمَّا جَآءَهُم مَّا عَرَفُواْ كَفَرُواْ بِهِۦۚ فَلَعۡنَةُ ٱللَّهِ عَلَى ٱلۡكَٰفِرِينَ ٨٩ ﴾ [البقرة: ٨٩]

    ৮৯. আর যখন তাদের কাছে, তাদের সাথে যা আছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার সত্যায়নকারী১১৭ কিতাব আসলো, আর তারা (এর মাধ্যমে) পূর্বে কাফিরদের ওপর বিজয় কমনা করত।১১৮ সুতরাং যখন তাদের নিকট আসল যা তারা চিনত১১৯ তখন তারা তা অস্বীকার করল। অতএব, কাফিরদের ওপর আল্লাহর লা‘নত।

    ১১৭. কুরআন মাজীদকে তাওরাতের ‘মুসাদ্দিক’ বা সত্যায়নকারী এজন্য বলা হয়েছে যে, তাওরাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব এবং কুরআন নাযিল সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, কুরআনের মাধ্যমে সেগুলোর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। তাই তাওরাতকে যারা মানে, তারা কিছুতেই কুরআন অমান্যকারী হতে পারে না। কেননা কুরআন মাজীদকে অস্বীকার করা প্রকারান্তরে তাওরাতকে অমান্য করার নামান্তর। এ ছাড়া তাওরাতের অবিকৃত অংশগুলো আল্লাহর অহী হওয়ার বিষয়টিও কুরআন সত্যায়ন করেছে। তবে আল কুরআনের পর কেবল আল-কুরআন অনুযায়ী আমল হবে।

    ১১৮. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে ইয়াহূদীরা অস্থিরতার সাথে তাঁর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল। কারণ তাদের নবীগণ সর্বশেষ নবীর আগমন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং তারা এ মর্মে আল্লাহর কাছে দো‘আও করতেন যে, শেষ নবীর আগমন যেন তাড়াতাড়ি হয়, তাহলে কাফিরদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব হবে এবং পুণরায় তাদের উত্থানের যুগ শুরু হবে।

    মদীনাবাসীগণ এ-কথার সাক্ষী যে, তাদের প্রতিবেশী ইয়াহূদীরা প্রায়শই বলে বেড়াত যে, ‘তোমাদের যার যার মন চায় আমাদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে যাও, আখেরী নবী যখন আসবেন, তখন আমরা সেসব অত্যাচারীদের দেখে ছাড়ব’। মদীনার অধিবাসীগণ এসব কথা শুনতেন এবং তাই যখন তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মন্ধে অবগত হলেন, তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতেন, দেখো! ইয়াহূদীরা যেন আমাদের আগে এ নবীর দীন গ্রহণ করে বাজিতে জিতে না যায়! চলো, আমরাই প্রথমে এ নবীর উপর ঈমান আনি; কিন্তু তাদের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, যে ইয়াহূদীরা এতদিন নবীর আগমনের প্রতীক্ষায় দিন গুণত, তারাই সে নবীর আবির্ভাব হবার পর তাঁর সবচে’ বড় শত্রুতে পরিণত হলো!

    ১১৯. এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। এখানে একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ঘটনা উল্লেখ করা হলো। আর তা তুলে ধরেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিনী উম্মুল মুমিনীন সাফিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি নিজে ছিলেন মদীনার উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত ইয়াহূদী গোত্র বনী নাযীরের নেতৃস্থানীয় এক আলেম হুয়ায় ইবন আখতাব-এর মেয়ে এবং আরেকজন বড় মাপের ইয়াহূদী আলেমের ভ্রাতুষ্পুত্রী। তিনি তার ইসলাম গ্রহণের আগের এ ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় আগমনের পর আমার বাবা ও চাচা দু’জনই তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন। দীর্ঘক্ষণ তাঁর সাথে কথাবার্তা বলার পর তারা ঘরে ফিরে আসেন। এ সময় আমি নিজের কানে তাদেরকে এভাবে আলাপ করতে শুনি:

    চাচা: আমাদের কিতাবে যে নবীর খবর দেওয়া হয়েছে, ইনি কি সত্যিই সেই নবী?

    পিতা: আল্লাহর কসম, ইনিই সেই নবী!

    চাচা: এ ব্যাপারে তুমি কি একেবারে নিশ্চিত?

    পিতা: হ্যাঁ।

    চাচা: তাহলে এখন কি করতে চাও?

    পিতা: যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, এর বিরোধিতা করে যাব। একে সফলকাম হতে দেব না।

    (সূত্র: সীরাতে ইবন হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৫, আধুনিক সংস্করণ)

    ﴿بِئۡسَمَا ٱشۡتَرَوۡاْ بِهِۦٓ أَنفُسَهُمۡ أَن يَكۡفُرُواْ بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بَغۡيًا أَن يُنَزِّلَ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۖ فَبَآءُو بِغَضَبٍ عَلَىٰ غَضَبٖۚ وَلِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٞ مُّهِينٞ ٩٠ ﴾ [البقرة: ٩٠]

    ৯০. যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে১২০ তা কত জঘন্য (তা এই) যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা তারা অস্বীকার করেছে এই জিদের বশবর্তী হয়ে যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তার ওপর তাঁর অনুগ্রহ নাযিল করেছেন।১২১ সুতরাং তারা ক্রোধের ওপর ক্রোধের উপযুক্ত হয়ে গেল। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।১২২

    ১২০. অর্থাৎ নিজেদের কল্যাণ, শুভ পরিণাম ও পরকালীন মুক্তিকে জলাঞ্জলি দিয়েছে।

    ১২১. ইয়াহূদীদের আশা ছিল যে, শেষনবী তাদের অর্থাৎ ইসরাঈল বংশে জন্মগ্রহণ করবেন; কিন্তু যখন তিনি বনী ইসরাঈলের বাইরে ইসমাঈলী বংশধারায় প্রেরিত হলেন, যাদেরকে তারা নিজেদের মোকাবিলায় তুচ্ছ-জ্ঞান করত, তখন তারা তাঁকে শুধুমাত্র তাদের একগুঁয়েমি ও হঠকারি মানসিকতার কারণে অস্বীকার করতে উদ্যত হলো। তাদের মনোভাব এমনই যেন, আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করে নবী পাঠালেন না কেন! আল্লাহ যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস না করে নিজের অনুগ্রহে নিজ পছন্দ অনুযায়ী নবী পাঠালেন, তখন তারা বিগড়ে গিয়ে তাঁকে সুস্পষ্টভাবে চিনতে পেরেও সর্বাত্মক বিরোধিতা করতে শুরু করে।

    ১২২. ‘লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি’ কাফিরদের জন্যেই নির্দিষ্ট। যারা ঈমানদার, তবে গুনাহগার (দয়াময় আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন) আর যদি তিনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তা হবে তাদের পাপমুক্ত করার লক্ষ্যে, লাঞ্ছিত করার উদ্দেশ্যে নয়।

    ﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ ءَامِنُواْ بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ قَالُواْ نُؤۡمِنُ بِمَآ أُنزِلَ عَلَيۡنَا وَيَكۡفُرُونَ بِمَا وَرَآءَهُۥ وَهُوَ ٱلۡحَقُّ مُصَدِّقٗا لِّمَا مَعَهُمۡۗ قُلۡ فَلِمَ تَقۡتُلُونَ أَنۢبِيَآءَ ٱللَّهِ مِن قَبۡلُ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٩١ ﴾ [البقرة: ٩١]

    ৯১. আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তোমরা তার প্রতি ঈমান আন’। তারা বলে, ‘আমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে আমরা তা বিশ্বাস করি’। আর এর বাইরে যা আছে তারা তা অস্বীকার করে।১২৩ অথচ তা সত্য, তাদের সাথে যা আছে তার সত্যায়নকারী। বল, ‘তবে কেন তোমরা আল্লাহর নবীদেরকে পূর্বে হত্যা করতে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’?

    ১২৩. এখানে ইয়াহূদীদের উদ্ধৃত বক্তব্যে রয়েছে কুফর ও তাদের অন্তরের হিংসা-বিদ্বেষের প্রমাণ। যেসব আসমানী কিতাব তাদের প্রতি নাযিল হয় নি, সেগুলোকে অস্বীকার করে তারা কুফুরী করেছে। যেমন, আমাদের ঈমানের একটি অন্যতম শর্ত হলো, পূর্ববর্তী সব আসমানী কিতাবসমূহের ওপর বিশ্বাস (দেখুন: সূরা আল-বাকারা, আয়াত ৪)

    এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাদের সামনে নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন:

    ক. অন্যান্য গ্রন্থের সত্যতার অকাট্য যুক্তি থাকা সত্ত্বেও সেগুলো অস্বীকার করার কোনো কারণ থাকতে পারে না।

    খ. কুরআন মাজীদও অন্যান্য আসমানী কিতাবের অন্তর্ভুক্ত একটি কিতাব। এটা তাওরাতের সত্যায়নকারীও বটে। তাই কুরআন মাজীদকে অস্বীকার করা তাওরাতকে অস্বীকার করার নামান্তর।

    গ. সব আসমানী কিতাব মতেই মহান নবী-রাসূলদেরকে হত্যা করা কুফুরী। ইয়াহূদীরা নবীদেরকে হত্যা করেছে, অথচ তাঁরা, বিশেষ করে, তাওরাতের শিক্ষাই প্রচার করতেন। তাই আসলে তাদের তাওরাতের উপর ঈমান আনার দাবীটাই অসার।

    ﴿وَلَقَدۡ جَآءَكُم مُّوسَىٰ بِٱلۡبَيِّنَٰتِ ثُمَّ ٱتَّخَذۡتُمُ ٱلۡعِجۡلَ مِنۢ بَعۡدِهِۦ وَأَنتُمۡ ظَٰلِمُونَ ٩٢ ﴾ [البقرة: ٩٢]

    ৯২. আর অবশ্যই মূসা তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে১২৪! অতঃপর তোমরা তার পরে বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করলে। আর তোমরা তো যালিম।

    ১২৪. মূসা আলাইহিস সালামকে মহান আল্লাহ তা‘আলা ৯টি সুস্পষ্ট নিদর্শন দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘আমি মূসাকে নয়টি প্রকাশ্য নিদর্শন দান করেছি’ (দেখুন: সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ১০১)। এগুলোর বর্ণনা রয়েছে সূরা আল-আ‘রাফ ও সূরা আয-যুখরুফ-এ।

    ﴿وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ وَرَفَعۡنَا فَوۡقَكُمُ ٱلطُّورَ خُذُواْ مَآ ءَاتَيۡنَٰكُم بِقُوَّةٖ وَٱسۡمَعُواْۖ قَالُواْ سَمِعۡنَا وَعَصَيۡنَا وَأُشۡرِبُواْ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡعِجۡلَ بِكُفۡرِهِمۡۚ قُلۡ بِئۡسَمَا يَأۡمُرُكُم بِهِۦٓ إِيمَٰنُكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٩٣ ﴾ [البقرة: ٩٣]

    ৯৩. আর স্মরণ কর, যখন আমরা তোমাদের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমাদের উপর তূরকে উঠিয়েছিলাম, (বলেছিলাম) ‘আমরা তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা শক্তভাবে ধর এবং শোন’। তারা বলেছিল, ‘আমরা শুনলাম এবং অমান্য করলাম১২৬! আর তাদের কুফুরীর কারণে তাদের অন্তরে পান করানো হয়েছিল গো বাছুরের প্রতি আকর্ষণ। বল, ‘তোমাদের ঈমান যার নির্দেশ দেয় কত মন্দ তা! যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’।

    ১২৬. অথচ মুমিনের বক্তব্য হওয়া উচিৎ: আমরা শুনলাম এবং মেনে নিলাম। ‘আমরা শুনলাম এবং অমান্য করলাম’ এ-ধরনের কথা আল্লাহর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী কাফেররাই কেবল বলতে পারে।

    ﴿قُلۡ إِن كَانَتۡ لَكُمُ ٱلدَّارُ ٱلۡأٓخِرَةُ عِندَ ٱللَّهِ خَالِصَةٗ مِّن دُونِ ٱلنَّاسِ فَتَمَنَّوُاْ ٱلۡمَوۡتَ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٩٤ ﴾ [البقرة: ٩٤]

    ৯৪. বল, ‘যদি আল্লাহর নিকট আখিরাতের আবাস তোমাদের জন্যই নির্দিষ্ট থাকে অন্যান্য মানুষ ছাড়া। তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর১২৭, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’।

    ১২৭. ইয়াহূদীদের দুনিয়া-প্রীতির প্রতি এটি সূক্ষ্ম বিদ্রুপ বিশেষ। আখিরাতের জীবন সম্পর্কে যারা সচেতন এবং তারা কখনো পার্থিব লোভ-লালসায় নিমজ্জিত জীবন যাপন করতে পারে না; কিন্তু ইয়াহূদীদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল এবং এখনো আছে।

    ﴿وَلَن يَتَمَنَّوۡهُ أَبَدَۢا بِمَا قَدَّمَتۡ أَيۡدِيهِمۡۚ وَٱللَّهُ عَلِيمُۢ بِٱلظَّٰلِمِينَ ٩٥ ﴾ [البقرة: ٩٥]

    ৯৫. আর তারা কখনো তা কামনা করবে না, তাদের হাত যা পাঠিয়েছে তার কারণে। আর আল্লাহ যালিমদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত।

    ﴿وَلَتَجِدَنَّهُمۡ أَحۡرَصَ ٱلنَّاسِ عَلَىٰ حَيَوٰةٖ وَمِنَ ٱلَّذِينَ أَشۡرَكُواْۚ يَوَدُّ أَحَدُهُمۡ لَوۡ يُعَمَّرُ أَلۡفَ سَنَةٖ وَمَا هُوَ بِمُزَحۡزِحِهِۦ مِنَ ٱلۡعَذَابِ أَن يُعَمَّرَۗ وَٱللَّهُ بَصِيرُۢ بِمَا يَعۡمَلُونَ ٩٦ ﴾ [البقرة: ٩٦]

    ৯৬. আর তুমি তাদেরকে পাবে জীবনের প্রতি সর্বাধিক লোভী মানুষরূপে।১২৮ এমনকি তাদের থেকেও যারা শির্ক করেছে। তাদের যে কেউই কামনা করে, যদি হাজার বছর তাকে জীবন দেওয়া হত! অথচ দীর্ঘজীবী হলেই তা তাকে আযাব থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারবে না। আর তারা যা করে আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।

    ১২৮. আল-কুরআনের মূল শব্দে এখানে على حياة বলা হয়েছে। এর মানে, কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকা; তা যে কোনো ধরনের জীবন হোক না কেন, সম্মানের ও মর্যাদার বা হীনতার, দীনতার, লাঞ্ছনা-অবমাননার হোক না কেন, তার প্রতিই তাদের লোভ।

    ﴿قُلۡ مَن كَانَ عَدُوّٗا لِّـجِبۡرِيلَ فَإِنَّهُۥ نَزَّلَهُۥ عَلَىٰ قَلۡبِكَ بِإِذۡنِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ وَهُدٗى وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُؤۡمِنِينَ ٩٧ ﴾ [البقرة: ٩٧]

    ৯৭. বল, ‘যে জিবরীলের শত্রু হবে১২৯ (সে অনুশোচনায় মরুক) কেননা নিশ্চয় জিবরীল তা আল্লাহর অনুমতিতে তোমার অন্তরে নাযিল করেছে১৩০, তার সামনে থাকা কিতাবের সমর্থক১৩১, হিদায়াত ও মুমিনদের জন্য সুসংবাদরূপে’।১৩২

    ১২৯. ইয়াহূদীরা কেবল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর ওপর যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকেই গালমন্দ করত না, বরং তারা আল্লাহর প্রিয় মহান ফিরিশতা জিবরাঈল আলাইহিসসালামকেও শত্রু বলে গালি দিত।

    ১৩০. এ জন্যেই তাদের গালমন্দ জিবরাঈল আলাইহিস সালামের ওপর নয়, আল্লাহর মহান সত্তার ওপর আরোপিত হয়।

    ১৩১. জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এ কুরআন মাজীদ বহন করে এনেছেন বলেই তারা তাকে গালমন্দ করে। অথচ কুরআন সরাসরি তাওরাতের সত্যতা সমর্থন করছে। ফলে তাদের এ বিষোদগার তাওরাতের বিরুদ্ধেও উচ্চারিত হচ্ছে।

    ১৩২. এখানে সূক্ষ্মভাবে একটি আক্ষেপের ব্যাপার তুলে ধরা হয়েছে যে, ইয়াহূদীদের সব অসন্তুষ্টি হচ্ছে হিদায়াত ও সত্য-সহজ পথের বিরুদ্ধে। নির্বোধের মতো তারা লড়ছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালতের বিরুদ্ধে। অথচ এই রিসালত মেনে নেওয়ার মধ্যেই নিহিত ছিল তাদের ইহ-পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণ।

    ﴿مَن كَانَ عَدُوّٗا لِّلَّهِ وَمَلَٰٓئِكَتِهِۦ وَرُسُلِهِۦ وَجِبۡرِيلَ وَمِيكَىٰلَ فَإِنَّ ٱللَّهَ عَدُوّٞ لِّلۡكَٰفِرِينَ ٩٨ ﴾ [البقرة: ٩٨]

    ৯৮. ‘যে শত্রু হবে আল্লাহর, তাঁর ফিরিশতাদের, তাঁর রাসূলগণের, জিবরীলের ও মীকাঈলের, তবে নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের শত্রু’।

    ﴿وَلَقَدۡ أَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ءَايَٰتِۢ بَيِّنَٰتٖۖ وَمَا يَكۡفُرُ بِهَآ إِلَّا ٱلۡفَٰسِقُونَ ٩٩ ﴾ [البقرة: ٩٩]

    ৯৯. আর আমরা অবশ্যই তোমার প্রতি সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নাযিল করেছি, ফাসিকরা ছাড়া১৩৩ অন্য কেউ তা অস্বীকার করে না।

    ১৩৩. আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও পথ-নির্দেশসমূহ অগ্রাহ্য ও অমান্যকারী।

    ﴿أَوَ كُلَّمَا عَٰهَدُواْ عَهۡدٗا نَّبَذَهُۥ فَرِيقٞ مِّنۡهُمۚ بَلۡ أَكۡثَرُهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ ١٠٠ ﴾ [البقرة: ١٠٠]

    ১০০. তবে কি যখনই তারা কোন ওয়াদা করেছে, তখনই তাদের মধ্য থেকে কোনো এক দল তা ছুড়ে মেরেছে? বরং তাদের অধিকাংশ ঈমান রাখে না।

    ﴿وَلَمَّا جَآءَهُمۡ رَسُولٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٞ لِّمَا مَعَهُمۡ نَبَذَ فَرِيقٞ مِّنَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ كِتَٰبَ ٱللَّهِ وَرَآءَ ظُهُورِهِمۡ كَأَنَّهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ ١٠١﴾ [البقرة: ١٠١]

    ১০১. আর যখন তাদের নিকট আল্লাহর কাছ থেকে একজন রাসূল আসল, তাদের সাথে যা আছে তা সমর্থন করে, তখন আহলে কিতাবের১৩৪ একটি দল আল্লাহর কিতাবকে তাদের পেছনে ফেলে দিল, (এভাবে যে) মনে হয় যেন তারা জানে না।

    ১৩৪. পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহ তথা তাওরাত ও ইঞ্জিলের অনুসারীবৃন্দ।

    ﴿وَٱتَّبَعُواْ مَا تَتۡلُواْ ٱلشَّيَٰطِينُ عَلَىٰ مُلۡكِ سُلَيۡمَٰنَۖ وَمَا كَفَرَ سُلَيۡمَٰنُ وَلَٰكِنَّ ٱلشَّيَٰطِينَ كَفَرُواْ يُعَلِّمُونَ ٱلنَّاسَ ٱلسِّحۡرَ وَمَآ أُنزِلَ عَلَى ٱلۡمَلَكَيۡنِ بِبَابِلَ هَٰرُوتَ وَمَٰرُوتَۚ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنۡ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَآ إِنَّمَا نَحۡنُ فِتۡنَةٞ فَلَا تَكۡفُرۡۖ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنۡهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِۦ بَيۡنَ ٱلۡمَرۡءِ وَزَوۡجِهِۦۚ وَمَا هُم بِضَآرِّينَ بِهِۦ مِنۡ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذۡنِ ٱللَّهِۚ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡۚ وَلَقَدۡ عَلِمُواْ لَمَنِ ٱشۡتَرَىٰهُ مَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنۡ خَلَٰقٖۚ وَلَبِئۡسَ مَا شَرَوۡاْ بِهِۦٓ أَنفُسَهُمۡۚ لَوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ١٠٢ ﴾ [البقرة: ١٠٢]

    ১০২. আর তারা১৩৫ অনুসরণ করেছে, যা শয়তানরা১৩৬ সুলাইমানের রাজত্বে পাঠ করত। আর সুলাইমান কুফুরী করে নি; বরং শয়তানরা কুফুরী করেছে। তারা মানুষকে যাদু শিখাত১৩৭ এবং (তারা অনুসরণ করেছে) যা নাযিল করা হয়েছিল বাবেলের দুই ফিরিশতা হারূত ও মারূতের ওপর। আর তারা কাউকে (যাদু) শেখাত না যে পর্যন্ত না বলত যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা, সুতরাং তোমরা কুফুরী করো না’।১৩৮

    এরপরও তারা এদের কাছ থেকে শিখত, যার মাধ্যমে তারা পুরুষ ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাত।১৩৯ অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোন ক্ষতি করতে পারত না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর তারা শিখত যা তাদের ক্ষতি করত, তাদের উপকার করত না এবং তারা নিশ্চয় জানত যে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোন অংশ থাকবে না। আর তা নিশ্চিতরূপে কতই-না মন্দ, যার বিনিময়ে তারা নিজদেরকে বিক্রয় করেছে। যদি তারা বুঝত।

    ১৩৫. বনী ইসরাঈল বা ইসরাঈল প্রজন্ম।

    ১৩৬. এখানে ‘শায়াতীন’ বলতে জিন্ন ও মানুষ উভয়েই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

    ১৩৭. ইসরাঈল গোত্রের মধ্যে যখন চরম নৈতিক অধঃপতন দেখা দিল; গোলামি, মূর্খতা, অজ্ঞতা, দারিদ্র, লাঞ্ছনা ও হীনতার ফলে যখন তাদের জাতিগত মনোবল ও উচ্চাকাঙ্খার বিলুপ্তি ঘটল, তখন তারা যাদু-টোনা, তাবীজ-তুমার, টোটকা ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকল। তারা এমন সব পন্থার অনুসন্ধান করতে লাগল যাতে কোনো পরিশ্রম ও সংগ্রাম-সাধনা ছাড়াই ঝাড়-ফুঁক ও তন্ত্র-মন্ত্রের জোরে সাফল্য লাভ করা যায়। তখন শয়তানরা তাদেরকে প্ররোচনা দিতে লাগল। তাদেরকে বুঝাতে থাকলো যে, সুলাইমান আলাইহিস সালামের বিশাল রাজত্ব ও তার বিস্ময়কর ক্ষমতা তো আসলে কিছু মন্ত্র-তন্ত্র ও কয়েকটা আঁচড়, নকশা তথা তাবীজের ফল। তারা তাদেরকে সেগুলো শিখিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিল। আর বনী ইসরাঈল জাতি প্রত্যাশিত মহামূল্যবান সম্পদ মনে করে এতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

    ১৩৮. সমগ্র বনী ইসরাঈল জাতি যখন ব্যাবিলনে বন্দী ও গোলামির জীবন যাপন করছিল, মহান আল্লাহ তখন তাদের পরীক্ষার উদ্দেশ্যে দু'জন ফিরিশতাকে মানুষের বেশে পাঠিয়েছিলেন। লূত জাতির কাছে যেমন ফিরিশতারা গিয়েছিলেন সুদর্শন বালকের বেশে তেমনি বনী ইসরাঈলের কাছে হয়তো তারা দরবেশ ও ফকীরের ছদ্মবেশে হাযির হয়ে থাকবেন। তারা তাদের ফিরিশতাসুলভ বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখেই সেখানে মানুষকে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জ্ঞান দান করেছিলেন। তাদের শিখানো জ্ঞান ছিল নিঃসন্দেহে জায়েয, উপকারী এবং কার্যকরী। তারা লোকদের এই মর্মে সতর্কও করে দিয়েছেন যে, দেখো, আমরা কিন্তু তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। কাজেই নিজেদের পরকাল নষ্ট করো না, অর্থাৎ কোনরূপ অসৎ ও ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার করো না। কিন্তু ইয়াহূদীরা তাদের চরম চারিত্রিক বিকৃতি নিয়ে তা শিখেছিল খারাপ উদ্দেশ্যে এবং তার প্রয়োগও করতো নিকৃষ্টতম লক্ষ্যে। ফলে সেই উপকারী জ্ঞান তাদের কাছে যাদু ও যাদুকরী বিদ্যায় পরিণত হলো। আর এর প্রতি তারা এতই ঝুঁকে পড়ল যে, আল্লাহর কিতাবের সাথে তাদের আর কোনো সম্পর্কই রইল না। আর যাদের সাথে নামমাত্র সম্পর্ক ছিল, তাও শুধুমাত্র ‘আমল ও তাবীজ’ পর্যায়ে সীমিত ছিল।

    ১৩৯. অর্থাৎ সেই বাজারে সব থেকে বেশি চাহিদা ছিল এমন জাদু-টোনার, যার সাহায্যে এক ব্যক্তি অন্য একজনের স্ত্রীকে তার স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে। তাদের মধ্যে যে নৈতিক পতন দেখা দিয়েছিল এটি ছিল তার নিকৃষ্টতম পর্যায়।

    ﴿وَلَوۡ أَنَّهُمۡ ءَامَنُواْ وَٱتَّقَوۡاْ لَمَثُوبَةٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ خَيۡرٞۚ لَّوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ١٠٣ ﴾ [البقرة: ١٠٣]

    ১০৩. আর যদি তারা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে (তাদের জন্য) প্রতিদান উত্তম হত। যদি তারা জানত।

    ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقُولُواْ رَٰعِنَا وَقُولُواْ ٱنظُرۡنَا وَٱسۡمَعُواْۗ وَلِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٞ ١٠٤ ﴾ [البقرة: ١٠٤]

    ১০৪. হে মুমিনগণ,১৪০ তোমরা ‘রাইনা’ বলো না; বরং বল, ‘উনজুরনা’১৪২ আর শোন,১৪৩ কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব।

    ১৪০. এই আয়াতটির মর্মার্থ বুঝতে সংক্ষেপে সেই প্রেক্ষাপটটি সামনে রাখা দরকার যে, যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আগমন করলেন এবং মদীনার চারপাশে ইসলামের আহ্বান ছড়িয়ে পড়তে লাগল, তখন ইয়াহূদীরা স্থানে স্থানে মুসলিমদেরকে ধর্মীয় বিতর্কে জড়িয়ে তাদেরকে ব্যস্ত রাখার অপচেষ্টা অব্যাহত রাখল। তাদের উল্লেখযোগ্য বাধা-দানকারী কার্যক্রমগুলো ছিল নিম্নরূপ:

    ক. তুচ্ছ ব্যাপারকে কেন্দ্র করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটানো

    খ. গুরুত্বহীন বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের অবতারণা করা

    গ. অপপ্রচারের মাধ্যমে নব্য মুমিনদের অন্তরে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করার চেষ্টা

    ঘ. প্রশ্নের ওপর অনর্থক প্রশ্ন করে কুরআন ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্যকে দূর্বোধ্য করে তোলা

    ঙ. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে বসে প্রতারণামূলক কথাবার্তা বলে গোলযোগ সৃষ্টি করা

    এই রুকু হতে পরবর্তী রুকুগুলোতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী তথা মুমিনদেরকে এসব অনিষ্টকর কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, যা তাদের বিরুদ্ধে ইয়াহূদীরা করছিল। সেসব সন্দেহ-সংশয়ের জবাবও দেওয়া হয়েছে, যেগুলো তারা মুসলিমদের অন্তরে সৃষ্টির চেষ্টা করছিল।

    ১৪১. এ শব্দটির অর্থ ‘আমাদের একটু সুযোগ দিন’। কিন্তু ইয়াহূদীদের ভাষায় এর অর্থ ‘শোনো, তুমি বধির হয়ে যাও’। ইয়াহূদীরা যখন মুসলিমদেরকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ভালো করে বুঝে নেওয়ার উদ্দেশে ব্যবহার করতে দেখল, তখন তারা এটাকে সুযোগ হিসেবে গণ্য করে তাদের ভাষায় ব্যবহৃত গালির অর্থে শব্দটিকে প্রয়োগ করতে লাগল। আবার কখনো বা তারা শব্দটির উচ্চারণ একটু টেনে ‘রাইনা’ (رَاعِيَنَا)ও বলার চেষ্টা করতে লাগল, যার অর্থ ‘ওহে আমাদের রাখাল’! এর সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাহমাতুল্লিল আলামীনকে তুচ্ছজ্ঞান ও অপদস্ত করা। ইয়াহূদীদের এই ছলচাতুরি বন্ধ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে ‘রাইনা’ বর্জন করতে বললেন। এর একার্থবোধক শব্দ ‘উনযুরনা’ অর্থাৎ আমাদের প্রতি নজর দিন বলতে নির্দেশ দিলেন। শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাবধানতার বিষয়টি আমরা এ আয়াত থেকে বুঝতে পাচ্ছি।

    ১৪২. তাই মুমিনদেরকে যথাযথ কুলুষমুক্ত শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে নির্দেশ দেওয়া হলো ঐ শব্দটি বলো না, বরং বলো ‘উনযুরনা’। যার অর্থ ‘আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন’ বা ‘আমাদের প্রতি দৃষ্টি দিন’ অথবা ‘আমাদেরকে একটু বুঝতে দিন’।

    ১৪৩. কারণ মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা শৈথিল্যের সাথে শোনার প্রশ্নই উঠে না, তাতে বরং কথা শোনার মাঝখানে সম্ভাবনা থাকে নিজেদের চিন্তাজালে বার বার জড়িয়ে পড়ার। ফলে ভুল বুঝার এবং প্রশ্নের পর প্রশ্ন করার অবকাশ সৃষ্টি হয়, যা প্রায়ই ঘটত ইয়াহূদীদের ক্ষেত্রে। তাই মুমিনদের ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাদেরকে আলোর পথে চলার পাথেয় শুনতে হবে স্বতঃস্ফুর্ত আগ্রহ ও গভীর মনোযোগের সাথে, আর মানতে হবে খুশি মনে, তৃপ্তির সাথে।

    ﴿مَّا يَوَدُّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ وَلَا ٱلۡمُشۡرِكِينَ أَن يُنَزَّلَ عَلَيۡكُم مِّنۡ خَيۡرٖ مِّن رَّبِّكُمۡۚ وَٱللَّهُ يَخۡتَصُّ بِرَحۡمَتِهِۦ مَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلۡفَضۡلِ ٱلۡعَظِيمِ ١٠٥ ﴾ [البقرة: ١٠٥]

    ১০৫. আহলে কিতাব১৪৪ ও মুশরিকদের১৪৫ মধ্য থেকে যারা কুফুরী করেছে, তারা চায় না যে, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর কোন কল্যাণ নাযিল হোক। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে তাঁর রহমত দ্বারা খাস করেন এবং আল্লাহ মহান অনুগ্রহের অধিকারী।

    ১৪৪. পূর্বে অবতীর্ণ আসমানী কিতাবসমূহের অনুসারী।

    ১৪৫. যারা আল্লাহর সাথে অন্যকাউকে শরীক করে অথবা আল্লাহর ইবাদাতের সাথে অন্য কারও ইবাদাত করে।

    ﴿مَا نَنسَخۡ مِنۡ ءَايَةٍ أَوۡ نُنسِهَا نَأۡتِ بِخَيۡرٖ مِّنۡهَآ أَوۡ مِثۡلِهَآۗ أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ ١٠٦ ﴾ [البقرة: ١٠٦]

    ১০৬. আমরা যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার মতো১৪৬ আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।

    ১৪৬. এখানে একটি বিশেষ সন্দেহের জবাব দেওয়া হয়েছে, যা মুসলিমদের অন্তরে সৃষ্টির জন্য ইয়াহূদীরা চেষ্টা চালাত। তাদের অভিযোগগুলো ছিল নিম্নরূপ:

    ক. পূর্ববর্তী কিতাবগুলো যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে থাকে এবং এ-কুরআনও তাঁর পক্ষ থেকেই এসে থাকে, তাহলে ঐ কিতাবগুলোর কিছু বিধানের ক্ষেত্রে এখানে ভিন্নতর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কেন?

    খ. একই আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিধান কীভাবে আসতে পারে?

    গ. আবার কুরআন দাবি করছে যে, ইয়াহূদী ও খৃষ্টানরা তাদেরকে দেওয়া শিক্ষার কিছু অংশ ভুলে গেছে। আল্লাহপ্রদত্ত শিক্ষা হাফেযদের মন থেকে কি করে মুছে যেতে পারে?

    হিদায়াত অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে নয় বরং আল-কুরআন যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, এ ব্যাপারে মুসলিমদের মনে সন্দেহ সৃষ্টির লক্ষ্যেই তারা এগুলো করতো।

    এর জবাবে মহান আল্লাহ বলছেন, তিনিই মালিক, তাঁর ক্ষমতা সীমাহীন, তিনি তাঁর যে কোন নির্দেশকে ইচ্ছা করে রহিত করে দেন বা যে কোনো বিধানকে বিলুপ্ত করেন; কিন্তু যা তিনি রহিত বা বিলুপ্ত করেন, তার চেয়ে উওম অথবা কমপক্ষে সমতুল্য কল্যাণময় ও উপযোগী বিধান সেখানে স্থলাভিষিক্ত করেন। আর বিধান প্রদানে মূল লক্ষ্য হলো আনুগত্যের পরীক্ষা নেওয়া। তাই তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিধান দিয়ে বান্দাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন। এতে সন্দেহ করার কিছুই নেই।

    ﴿ أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۗ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٍ ١٠٧ ﴾ [البقرة: ١٠٧]

    ১০৭. তুমি কি জান না যে, নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহর। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই।

    ﴿ أَمۡ تُرِيدُونَ أَن تَسۡ‍َٔلُواْ رَسُولَكُمۡ كَمَا سُئِلَ مُوسَىٰ مِن قَبۡلُۗ وَمَن يَتَبَدَّلِ ٱلۡكُفۡرَ بِٱلۡإِيمَٰنِ فَقَدۡ ضَلَّ سَوَآءَ ٱلسَّبِيلِ ١٠٨ ﴾ [البقرة: ١٠٨]

    ১০৮. নাকি তোমরা চাও তোমাদের রাসূলকে প্রশ্ন করতে, যেমন পূর্বে মূসাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল?১৪৭ আর যে ঈমানকে কুফরে পরিবর্তন করবে, সে নিশ্চয় সোজা পথ বিচ্যুত হলো।

    ১৪৭. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বললেন: ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য হজ ফরয করেছেন’। তখন সে উপস্থিতি থেকে একজন (আকরা ইবন হাবেস) দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন: ‘হে আল্লাহর রাসূল! প্রতি বছরই কি হজ ফরয’? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কথার উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলেন। এমনকি লোকটি তিনবার এ প্রশ্ন করল। পরে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘আমি যদি হ্যাঁ বলতাম তাহলে তোমাদের জন্য অবশ্যই প্রতি বছর হজ্জ ফরয হয়ে যেত। তখন তা তোমরা পালন করতে সক্ষম হতে না’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘আমি যতক্ষন কিছু না বলি, ততক্ষণ তোমরাও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। অতিরিক্ত প্রশ্ন করে শরী‘আতকে কঠিন করো না। তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিরাও এভাবে তাদের নবীদেরকে অধিক প্রশ্ন করে এবং সে ব্যাপারে নিজেরা মতানৈক্য করে ধ্বংস হয়েছে। সুতরাং যখন আমি তোমাদেরকে কিছু করার নির্দেশ দেই, সাধ্যানুসারে তা পালন করো; আর যখন কিছু থেকে বিরত থাকতে বলি, তা তোমরা পরিত্যাগ করো’। (সহীহ মুসলিম)

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধী ঐ ব্যক্তি, যে এমন জিনিস সম্পর্কে প্রশ্ন করল যা হারাম ছিল না, কিন্তু তার প্রশ্নের কারণে তা হারাম হয়ে গেল’। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: ‘তোমরা বাজে কথা, সম্পদ বিনষ্ট করা এবং বেশি প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকো’। (সহীহ আল-বুখারী)

    ﴿وَدَّ كَثِيرٞ مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ لَوۡ يَرُدُّونَكُم مِّنۢ بَعۡدِ إِيمَٰنِكُمۡ كُفَّارًا حَسَدٗا مِّنۡ عِندِ أَنفُسِهِم مِّنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ ٱلۡحَقُّۖ فَٱعۡفُواْ وَٱصۡفَحُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦٓۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٠٩ ﴾ [البقرة: ١٠٩]

    ১০৯. আহলে কিতাবের অনেকেই চায়, যদি তারা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর কাফির অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারত! সত্য স্পষ্ট হওয়ার পর তাদের পক্ষ থেকে হিংসাবশত (তারা এরূপ করে থাকে)। সুতরাং তোমরা ক্ষমা কর এবং এড়িয়ে চল,১৪৮ যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর নির্দেশ দেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।

    ১৪৮. বিরোধীদের হিংসা-বিদ্বেষ দেখে মুমিন ব্যক্তিরা উত্তেজিত হয়ে পড়বে না, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে না। ধৈর্য্যের সাথে আল্লাহর স্মরণ, তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) ও সৎকর্মে তৎপর থাকবে। বিরোধীদের কথায় উৎকন্ঠিত না হয়ে তা বরং এড়িয়ে যাবে।

    মহান আল্লাহ বলেন: নিশ্চয় তারা ভীষণ কৌশল করছে। আর আমিও ভীষণ কৌশল করছি। অতএব, কাফিরদেরকে কিছুটা অবকাশ দাও, কিছু সময়ের তাদেরকে অবকাশ দাও। (দেখুন: সূরা আত-তারিক, আয়াত ১৫-১৭)

    ﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَمَا تُقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُم مِّنۡ خَيۡرٖ تَجِدُوهُ عِندَ ٱللَّهِۗ إِنَّ ٱللَّهَ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ١١٠ ﴾ [البقرة: ١١٠]

    ১১০. আর তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও এবং যে নেক আমল তোমরা নিজদের জন্য আগে পাঠাবে, তা আল্লাহর নিকট পাবে।১৪৯ তোমরা যা করছ নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।

    ১৪৯. পরকালের প্রস্তুতি সম্পর্কে আরো পড়তে ক্লিক করুন নিম্নের দুটি লিংক:

    http://www.islamhouse.com/p/41497 http://www.islamhouse.com/p/41478

    ﴿وَقَالُواْ لَن يَدۡخُلَ ٱلۡجَنَّةَ إِلَّا مَن كَانَ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰۗ تِلۡكَ أَمَانِيُّهُمۡۗ قُلۡ هَاتُواْ بُرۡهَٰنَكُمۡ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ١١١ ﴾ [البقرة: ١١١]

    ১১১. আর তারা বলে, ইয়াহূদী কিংবা নাসারা ছাড়া অন্য কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এটা তাদের মিথ্যা আশা।১৫০ বল, ‘তোমরা তোমাদের প্রমাণ নিয়ে আস, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’।

    ১৫০. এটি মুসলিমদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের আরেকটি প্ররোচনা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে যে, নাজাত তথা পরকালে মুক্তির পথ হলো ইয়াহূদী অথবা খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করা। তাদের দাবি অনুযায়ী এ দু’টিই আল্লাহ প্রদত্ত এবং তা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় নতুন কোনো জীবন-ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই।

    এখানে লক্ষ্যণীয় যে, তারা পরস্পর চরম শত্রু হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের বিরোধীতায় তারা ঐক্যবদ্ধ, যা মুসলিমদের বিরোধীদের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য।

    ﴿بَلَىٰۚ مَنۡ أَسۡلَمَ وَجۡهَهُۥ لِلَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَلَهُۥٓ أَجۡرُهُۥ عِندَ رَبِّهِۦ وَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ١١٢ ﴾ [البقرة: ١١٢]

    ১১২. হ্যাঁ, যে নিজকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করেছে এবং সে সৎকর্মশীলও, তবে তার জন্য রয়েছে তার রবের নিকট প্রতিদান। আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।১৫১

    ১৫১. অর্থাৎ পরকালে মুক্তি ও জান্নাত প্রাপ্তির জন্য ইয়াহূদী বা খৃষ্টান নয়, বরং প্রকৃত অর্থে আল্লাহর জন্য হতে হবে সমর্পিত, মুসলিম। সাথে থাকতে হবে ইহসান অর্থাৎ:

    ক. পূর্ণ নিষ্ঠা, সততা ও মহান আল্লাহর ভয় এবং আশা বুকে ধারণ করে শরী‘আতের বিধি-নিষেধ পালনে সচেষ্ট হওয়া।

    খ. লোক-দেখানো কোনো উদ্দেশ্যে নয়, বরং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই কেবল ইবাদাত-বন্দেগী আদায় করা।

    গ. প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত সুন্নাহ অনুসরণ করে সকল কর্ম যথার্থরূপে সম্পাদন করা।

    যারা এভাবে ইবাদাত ও আনুগত্যের জীবনধারা গড়ে তুলবে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে নিশ্চিত প্রতিদান। তাদের কোনো শঙ্কা বা ভয়ের কারণ নেই।

    মহান আল্লাহ বলেন:

    (নিশ্চয় যারা বলে, ‘আল্লাহই আমাদের রব’ অতঃপর অবিচল থাকে, ফিরিশতারা তাদের কাছে নাযিল হয় (এবং বলে,) ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, দুশ্চিন্তা করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর তোমাদেরকে যার ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল’।

    আমরা দুনিয়ার জীবনে তোমাদের বন্ধু এবং আখিরাতেও। সেখানে তোমাদের জন্য থাকবে যা তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আরো থাকবে যা তোমরা দাবি করবে।) (দেখুন: সূরা হা-মীম আস-সাজ্‌দাহ, আয়াত ৩০-৩১)

    ﴿وَقَالَتِ ٱلۡيَهُودُ لَيۡسَتِ ٱلنَّصَٰرَىٰ عَلَىٰ شَيۡءٖ وَقَالَتِ ٱلنَّصَٰرَىٰ لَيۡسَتِ ٱلۡيَهُودُ عَلَىٰ شَيۡءٖ وَهُمۡ يَتۡلُونَ ٱلۡكِتَٰبَۗ كَذَٰلِكَ قَالَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ مِثۡلَ قَوۡلِهِمۡۚ فَٱللَّهُ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ فِيمَا كَانُواْ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَ ١١٣ ﴾ [البقرة: ١١٣]

    ১১৩. আর ইয়াহূদীরা বলে, ‘নাসারাদের কোনো ভিত্তি নেই’ এবং নাসারারা বলে ‘ইয়াহূদীদের কোনো ভিত্তি নেই’। অথচ তারা কিতাব পাঠ করে। এভাবেই, যারা কিছু জানে না,১৫২ তারা তাদের কথার মতো কথা বলে। সুতরাং আল্লাহ কিয়ামতের দিন যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত সে বিষয়ে তাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন।

    ১৫২. মুশরিক (অংশীবাদী) ও নাস্তিকেরা।

    ﴿وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن مَّنَعَ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ أَن يُذۡكَرَ فِيهَا ٱسۡمُهُۥ وَسَعَىٰ فِي خَرَابِهَآۚ أُوْلَٰٓئِكَ مَا كَانَ لَهُمۡ أَن يَدۡخُلُوهَآ إِلَّا خَآئِفِينَۚ لَهُمۡ فِي ٱلدُّنۡيَا خِزۡيٞ وَلَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١١٤ ﴾ [البقرة: ١١٤]

    ১১৪. আর তার চেয়ে অধিক যালেম কে, যে আল্লাহর মাসজিদসমূহে তাঁর নাম স্মরণ করা থেকে বাধা প্রদান করে এবং তা বিরাণ করতে চেষ্টা করে? তাদের তো উচিৎ ছিল ভীত হয়ে তাতে প্রবেশ করা।১৫৩ তাদের জন্য দুনিয়ায় রয়েছে লাঞ্ছনা আর আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব।

    ১৫৩. ইবাদাতগৃহগুলো কখনো যালেম (অধিকার হরণকারী)-দের কর্তৃত্ব ও পরিচালনাধীনে থাকতে পারে না। বরং ঐ বিশেষ দীনী প্রতিষ্ঠানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও শাসন-কর্তৃত্বে থাকতে হবে এমন সব লোক, যারা মহান আল্লাহকে ভয় করে এবং সর্বোতভাবে তাঁর প্রতি অনুগত। তাহলে দুষ্কৃতিকারীরা সেখানে উপস্থিত হলেও দুষ্কর্ম করার সাহস পাবে না। কারণ তারা জানবে, সেখানে গিয়ে কোনো যুলুমের কাজ করলে তাদের শাস্তি পেতে হবে।

    মহান আল্লাহ আল-কুরআনের অপর স্থানে বলেন: “মুশরিকদের অধিকার নেই যে, তারা আল্লাহর মসজিদসমূহ আবাদ করবে, নিজদের উপর কুফুরীর সাক্ষ্য দেওয়া অবস্থায়। এদেরই আমলসমূহ বরবাদ হয়েছে এবং আগুনেই তারা স্থায়ী হবে।” (দেখুন: সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১৭-১৮)

    ﴿وَلِلَّهِ ٱلۡمَشۡرِقُ وَٱلۡمَغۡرِبُۚ فَأَيۡنَمَا تُوَلُّواْ فَثَمَّ وَجۡهُ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ وَٰسِعٌ عَلِيمٞ ١١٥ ﴾ [البقرة: ١١٥]

    ১১৫. ১৫৪আর পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। সুতরাং তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও, সে দিকেই আল্লাহর চেহারা।১৫৫ নিশ্চয় আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।১৫৬

    ১৫৪. এ আয়াতটি ‘কিবলা পরিবর্তন’ তথা বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে বায়তুল্লাহ (কা‘বা শরীফ)-এর দিকে কিবলা পরিবর্তনের পর অবতীর্ণ হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিযরতের ১৬/১৭ মাস পর এই নির্দেশ দেওয়া হয় এভাবে:

    (আকাশের দিকে বার বার তোমার মুখ ফিরানো আমি অবশ্যই দেখছি। অতএব, আমরা অবশ্যই তোমাকে এমন কিবলার দিকে ফিরাব, যা তুমি পছন্দ কর। সুতরাং তোমরা চেহারা মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক, তার দিকেই তোমাদের চেহারা ফিরাও। আর নিশ্চয় যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছে, তারা অবশ্যই জানে যে, তা তাদের রবের পক্ষ থেক সত্য এবং তারা যা করে, সে ব্যাপারে আল্লাহ গাফিল নন।) (দেখুন: সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৪)

    কিবলা পরিবর্তনের এ ব্যাপারটিকে নিয়ে বিরোধী-অবিশ্বাসীরা যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছিল, তার জবাবে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (আরো জানতে দেখুন: সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪২, ১৪৫; সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬-৯৭; সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৯৭)

    ১৫৫. অর্থাৎ মহান আল্লাহ সব দিক ও স্থানের মালিক। কাজেই তাঁর নির্দেশ মতো যে কোনো দিকে মুখ করে ইবাদাত করলে তাঁর উদ্দেশেই ইবাদত সমর্পিত হবে।

    ১৫৬. অর্থাৎ মহান আল্লাহ সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত, তিনি অসীম, অনন্ত। কোনো কোনো বিভ্রান্ত মানুষ তাঁকে নিজেদের মতো ভেবে থাকতে পারে! কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহর কর্তৃত্ব বিশাল ও বিস্তৃত এবং তাঁর অনুগ্রহ দানের ক্ষেত্র অত্যন্ত ব্যাপক। তাঁর কোনো বান্দা কোথায় কোন সময় কি উদ্দেশ্যে তাঁকে স্মরণ করছে, তা তিনি সার্বক্ষণিকভাবে জানেন।

    ﴿وَقَالُواْ ٱتَّخَذَ ٱللَّهُ وَلَدٗاۗ سُبۡحَٰنَهُۥۖ بَل لَّهُۥ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ كُلّٞ لَّهُۥ قَٰنِتُونَ ١١٦ ﴾ [البقرة: ١١٦]

    ১১৬. আর তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র মহান; ১৫৭ বরং আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে তা তাঁরই। সব তাঁরই অনুগত।

    ১৫৭. আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন: মানুষ আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, অথচ তাদের জন্য এটা উচিৎ নয়। আর মানুষ আমাকে গালি দেয়, অথচ এটা তার জন্য উচিৎ নয়। তাদের আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অর্থ হলো, তারা বলে, আমি তাদেরকে (মৃত্যুর পরে) জীবিত করে আগের মতো করতে সক্ষম নই। আর তাদের আমাকে গালি দেওয়া হলো, তারা বলে যে, আমার পুত্র আছে। অথচ স্ত্রী বা সন্তান রাখার মতো বিষয় থেকে আমি পবিত্র। (দেখুন: সহীহ আল-বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৪১২৪)

    ﴿بَدِيعُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ وَإِذَا قَضَىٰٓ أَمۡرٗا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ١١٧ ﴾ [البقرة: ١١٧]

    ১১৭. তিনি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা। আর যখন তিনি কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন কেবল বলেন ‘হও’ ফলে তা হয়ে যায়।

    ﴿وَقَالَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ لَوۡلَا يُكَلِّمُنَا ٱللَّهُ أَوۡ تَأۡتِينَآ ءَايَةٞۗ كَذَٰلِكَ قَالَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِم مِّثۡلَ قَوۡلِهِمۡۘ تَشَٰبَهَتۡ قُلُوبُهُمۡۗ قَدۡ بَيَّنَّا ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يُوقِنُونَ ١١٨ ﴾ [البقرة: ١١٨]

    ১১৮. আর যারা জানে না, তারা বলে, ‘কেন আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন না কিংবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আসে না’?১৫৮ এভাবেই, যারা তাদের পূর্বে ছিল তারা তাদের কথার মতো কথা বলেছে।১৫৯ তাদের অন্তরসমূহ একই রকম হয়ে গিয়েছে। আমরা তো আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট করে দিয়েছি এমন কাওমের জন্য, যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।১৬০

    ১৫৮. এখানে পথভ্রষ্টদের দুটি অভিযোগ:

    ক. আল্লাহ নিজে এসে তাদের সাথে কথা বলেন না কেন?

    খ. তাদের কাছে কোনো নিদর্শন (sign) আসে না কেন?

    ১৫৯. অর্থাৎ আজকের পথভ্রষ্টরা কোনো নতুন অভিযোগ বা দাবি উত্থাপন করে নি, যা এর আগের বিরোধীরা করেনি। প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত পথভ্রষ্টতার স্বরূপ ও প্রকৃতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বার বার একই ধরনের সংশয়, সন্দেহ, অভিযোগ, দাবি ও প্রশ্নের পুনরাবৃত্তিই তারা করে চলছে।

    ১৬০. প্রথম অভিযোগটি এতো বেশি অর্থহীন যে, তার জবাব দেওয়া অপ্রয়োজনীয়। এখানে শুধু দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাবে বলা হয়েছে, নিদর্শন তো রয়েছে অগণিত, কিন্তু যে মানতেই চায় না, প্রকৃতিগত বক্রতা যাকে গ্রাস করে নিয়েছে, পরম সত্যের প্রতি বিশ্বাস করাকে যে সযত্নে পাশ কাটিয়ে যেতে সদা তৎপর, তারই মুখে একথা মানায়!

    ﴿إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗاۖ وَلَا تُسۡ‍َٔلُ عَنۡ أَصۡحَٰبِ ٱلۡجَحِيمِ ١١٩ ﴾ [البقرة: ١١٩]

    ১১৯. নিশ্চয় আমরা তোমাকে প্রেরণ করেছি সত্যসহ, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে১৬১ এবং তোমাকে আগুনের অধিবাসীদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না।১৬২

    ১৬১. অর্থাৎ অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে এক অন্যতম ও উজ্জ্বল প্রতীক হচ্ছেন স্বয়ং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর জীবন ও তাঁর ব্যক্তিত্ব। যে দেশ ও জাতিতে তাঁর জন্ম হয়েছিল তার তৎকালীন অবস্থা, যেভাবে তিনি প্রতিপালিত হন, তাঁর ৪০ বছরের নবুয়তপূর্ব জীবনযাপন এবং নবী হবার পরে তিনি যে মহান, বিষ্ময়কর ও যুগান্তকারী কার্যাবলি সম্পাদন করেন, এসব কিছুই মানুষের জন্য সুস্পষ্ট নিদর্শন।

    ১৬২. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনের অপর স্থানে আরো বলেন:

    ﴿وَلَن تَرۡضَىٰ عَنكَ ٱلۡيَهُودُ وَلَا ٱلنَّصَٰرَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمۡۗ قُلۡ إِنَّ هُدَى ٱللَّهِ هُوَ ٱلۡهُدَىٰۗ وَلَئِنِ ٱتَّبَعۡتَ أَهۡوَآءَهُم بَعۡدَ ٱلَّذِي جَآءَكَ مِنَ ٱلۡعِلۡمِ مَا لَكَ مِنَ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٍ ١٢٠ ﴾ [البقرة: ١٢٠]

    ১২০. আর ইয়াহূদী ও নাসারারা কখনো তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ কর।১৬৩ বল, ‘নিশ্চয় আল্লাহর হিদায়াতই হিদায়াত’ আর যদি তুমি তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর তোমার কাছে যে জ্ঞান এসেছে তার পর, তাহলে আল্লাহর বিপরীতে তোমার কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী থাকবে না।

    ১৬৩. তাদের অসন্তুষ্টির কারণ এ নয় যে, ইয়াহূদী ও খৃষ্টানরা যথার্থই সত্যসন্ধানী, অথচ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকৃত সত্যকে তাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারেন নি! বরং তাঁর প্রতি তাদের অসন্তুষ্টি এজন্য যে, তারা তাদের ধর্মকে ইচ্ছেমত বিকৃতির মাধ্যমে মুনাফেকী করে যেভাবে লাভবান হয়ে আসছিল; যেভাবে ছল-চাতুরী, প্রতারণা এবং অন্তঃসারশূন্য স্বেচ্ছাচারী প্রদর্শনীমূলক কর্মকাণ্ডকে ধর্ম হিসেবে চালিয়ে আসছিল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের সে ভ্রষ্টতাগুলোকে উন্মোচন করেন, যাতে তাদের ভীষণ স্বার্থহানী ঘটে এবং তাদেরকে সর্বশেষ আসমানী কিতাব তথা আল-কুরআনের অনুসারী হবার আহ্বান জানান, যার সবই তাদের জন্য ছিল চরম অসহনীয়।

    ﴿ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَتۡلُونَهُۥ حَقَّ تِلَاوَتِهِۦٓ أُوْلَٰٓئِكَ يُؤۡمِنُونَ بِهِۦۗ وَمَن يَكۡفُرۡ بِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ١٢١ ﴾ [البقرة: ١٢١]

    ১২১. যাদেরকে আমরা কিতাব দিয়েছি, তারা তা পাঠ করে যথার্থভাবে। তারাই তার প্রতি ঈমান আনে।১৬৪ আর যে তা অস্বীকার করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।

    ১৬৪. এখানে আহলে কিতাবদের অন্তর্গত কিছু সৎলোকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তারা সততা ও দায়িত্বশীলতার সাথে আল্লাহর কিতাব পড়ে। তাই আল্লাহর কিতাবের দৃষ্টিতে যা সত্য তাকেই তারা সঠিক বলে মেনে নেয়।

    ﴿يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَنِّي فَضَّلۡتُكُمۡ عَلَى ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٢٢ ﴾ [البقرة: ١٢٢]

    ১২২. হে বনী ইসরাঈল,১৬৫ তোমরা আমার নি‘আমতকে স্মরণ কর, যা আমি তোমাদেরকে দিয়েছি। আর নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি সৃষ্টিকুলের ওপর।

    ১৬৫. বিগত ৫৬-১২১ আয়াতমালায় মহান আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করে তাদের ঐতিহাসিক অপরাধসমূহ এবং আল-কুরআন নাযিল হবার সময়ে তাদের যে অবস্থা ছিল, তা পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করেছেন। এখান থেকে আরেকটি ধারাবাহিক বক্তব্য শুরু হচ্ছে, যা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে:

    এক. নূহ আলাইহিস সালামের পরে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম প্রথম নবী ছিলেন। মহান আল্লাহ তাকে ইসলামের শাশ্বত আহ্বান ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। প্রথমে তিনি নিজে স্বশরীরে ইরাক থেকে মিশর পর্যন্ত এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তীন থেকে নিয়ে আরবের মরু অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান পর্যন্ত বছরের পর বছর সফর করে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের তথা ইসলামের দিকে আহবান করতে থাকেন। এরপর এ মিশন সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। পূর্ব জর্দানে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্র লূত আলাইহিস সালামকে নিযুক্ত করেন। সিরিয়া ও ফিলিস্তীনে নিযুক্ত করেন নিজের পুত্র ইসহাক আলাইহিস সালামকে এবং আরবের অভ্যন্তরে নিযুক্ত করেন নিজের বড় পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে। তারপর মহান আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় কাবাগৃহ নির্মাণ করেন এবং আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী এটিকেই এই মিশনের কেন্দ্র গণ্য করেন।

    দুই. ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশধারা দুটি বড় বড় শাখায় বিভক্ত হয়। একটি হলো ইসমাঈল আলাইহিস সালামের সন্তান-সন্ততিবর্গ। তাঁরা আরবে বসবাস করতেন। কুরাইশ ও আরবের আরো কতিপয় গোত্র এ ধারারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর যেসব আরব গোত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধারাভুক্ত ছিল না তারাও তাঁর প্রচারিত ধর্মে কমবেশী প্রভাবিত ছিল বলে তাঁর সাথেই নিজেদের সম্পর্ক জুড়তো।

    দ্বিতীয় শাখাটি ইসহাক আলাইহিস সালামের সন্তানবর্গের। এই শাখায় ইয়াকুব আলাইহিস সালাম, ইউসুফ আলাইহিস সালাম, মূসা আলাইহিস সালাম, দাউদ আলাইহিস সালাম, সুলাইমান আলাইহিস সালাম, ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম প্রমুখ অসংখ্য নবী জন্মগ্রহণ করেন। ইতিঃপূর্বেই আমরা জেনেছি, যেহেতু ইয়াকুব আলাইহিস সালামের আরেক নাম ছিল ‘ইসরাঈল’, তাই তাঁর বংশ ‘বনী ইসরাঈল (ইসরাঈল প্রজন্ম)’ নামে পরিচিত হয়।

    তিন. ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রধান কাজ ছিল তাওহীদী আদর্শের গোড়াপত্তন করা। তাওহীদাশ্রিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা যারা একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদত চর্চার পাশাপাশি অন্যদেরকেও আল্লাহপ্রদত্ত দীন ও আদর্শের প্রতি আহ্বান করবে। এই মহান ও বিরাট কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতেই তাঁকে তাওহীদী জনতার পিতা হিসেবে অভিষিক্ত করা হয়। তারপর তাঁর বংশধারা থেকে যে শাখাটি বের হয়ে ইসহাক আলাইহিস সালাম ও ইয়াকুব আলাইহিস সালামের নামে অগ্রসর হয়ে ‘বনী ইসরাঈল’ নাম ধারণ করে সেই শাখাটি তাঁর এ দায়িত্বের উত্তরাধিকার লাভ করে। এই শাখায় নবীদের জন্ম হতে থাকে এবং তাঁদেরকে সত্য-সঠিক পথের জ্ঞানদান করা হয়। বিশ্বের জাতিসমূহকে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার উদ্দেশে বনী ইসরাইলকে গঠন করার কার্যক্রম চালু থাকে। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো বনী ইসরাঈলের লোকেরা নিজেরাই তাওহীদ ও তাওহীদী আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যার ফলে আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলের সাথে তার অঙ্গীকার কর্তন করেন। এবং বনী ইসমাঈল (ইসমাঈল বংশধারায়) এ দায়িত্ব অর্পন করেন। তাওহীদ চর্চা ও বিশ্বময় তাওহীদী আদর্শ প্রচারের জন্য যেসব যোগ্যতার প্রয়োজন বনী ইসমাঈলকে আরবের বিরান ভূমিতে রেখে সেসব যোগ্যতা অর্জনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা ব্যবস্থা করেন।

    নিচের আয়াতগুলোতে ইবরাহীম আলাইসি সালামের তাওহীদ চর্চা, তাওহীদ প্রচার এবং খানায় কাবা পূনঃনির্মাণ, পূনঃনির্মাণের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

    ﴿وَٱتَّقُواْ يَوۡمٗا لَّا تَجۡزِي نَفۡسٌ عَن نَّفۡسٖ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يُقۡبَلُ مِنۡهَا عَدۡلٞ وَلَا تَنفَعُهَا شَفَٰعَةٞ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ١٢٣ ﴾ [البقرة: ١٢٣]

    ১২৩. আর তোমরা ভয় কর সেদিনকে, যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না এবং কোনো ব্যক্তি থেকে বিনিময় গ্রহণ করা হবে না আর কোন সুপারিশ তার উপকারে আসবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।

    ﴿وَإِذِ ٱبۡتَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ رَبُّهُۥ بِكَلِمَٰتٖ فَأَتَمَّهُنَّۖ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامٗاۖ قَالَ وَمِن ذُرِّيَّتِيۖ قَالَ لَا يَنَالُ عَهۡدِي ٱلظَّٰلِمِينَ ١٢٤ ﴾ [البقرة: ١٢٤]

    ১২৪. আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন,১৬৬ অতঃপর সে তা পূর্ণ করল। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে মানুষের জন্য নেতা বানাব’। সে বলল, ‘আমার বংশধরদের থেকেও’? তিনি বললেন, ‘যালিমরা আমার ওয়াদাপ্রাপ্ত হয় না’।১৬৭

    ১৬৬. যেসব কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁকে বিশ্বমানবতার নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত করার যোগ্য প্রমাণিত করেছিলেন কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। সত্যের আলো তাঁর সামনে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হবার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সমগ্র জীবন ছিল কুরবানী আর ত্যাগের মূর্ত প্রতীক। দুনিয়ার যা কিছুকে মানুষ ভালোবাসতে পারে, এমন প্রতিটি বস্তুকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মহান আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক সত্যের জন্য কুরবানী করেছিলেন। দুনিয়ার যে সব বিপদকে মানুষ ভয় করে, সত্যের খাতিরে তার প্রত্যেকটিকে তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন।

    ১৬৭. অর্থাৎ এ অঙ্গীকারটি ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সন্তানদের কেবলমাত্র সেই অংশটির সাথে সম্পর্কিত যারা সদাচারী, সত্যনিষ্ঠ ও সৎকর্মশীল। তাদের মধ্য থেকে যারা যালিম (অধিকার হরণকারী ও সীমালঙ্ঘনকারী), তাদের জন্য এ অঙ্গীকার নয়। এ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, পথভ্রষ্ট ইয়াহূদীরা ও মুশরিক বনী ইসরাঈলরা এ অঙ্গীকারের আওতায় পড়ে না।

    ﴿وَإِذۡ جَعَلۡنَا ٱلۡبَيۡتَ مَثَابَةٗ لِّلنَّاسِ وَأَمۡنٗا وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ مُصَلّٗىۖ وَعَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيۡتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ ١٢٥ ﴾ [البقرة: ١٢٥]

    ১২৫. আর স্মরণ কর, যখন আমরা কা‘বাকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ স্থান বানালাম১৬৮ এবং (আদেশ দিলাম যে,) ‘তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর’।১৬৯ আর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, ‘তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকূকারী-সাজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর’।১৭০

    ১৬৯. মাকামে ইবরাহীম সে-ই জান্নাতী পাথর, যার উপর দাঁড়িয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কাবা ঘর নির্মাণ করেছিলেন। জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের এক পর্যায়ে তিনি বলেন: যখন মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফ শেষ করেন, তখন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে জিজ্ঞেস করেন: এটা কি আমাদের পিতার (হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের) মাকাম? তিনি জবাবে বলেন: হ্যাঁ। তারপর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবার জিজ্ঞেস করেন: আমরা কি এখানে সালাত পড়বো না? তখন আল-কুরআনের এই আয়াতটি নাযিল হয়:

    ﴿ وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ مُصَلّٗىۖ﴾ [البقرة: ١٢٥]

    “তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান বানিয়ে নাও।”

    আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি তিন বিষয়ে আমার রবের সাথে কিংবা আমার রব তিন বিষয়ে আমার সাথে একমত হয়েছেন। এর একটি হচ্ছে, আমি বললাম: ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি যদি মাকামে ইবরাহীমে সালাত পড়তেন’! তখন ঐ আয়াতটি নাযিল হয় যে, তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান বানিয়ে নাও। এটি একটি বড় হাদীসের অংশ বিশেষ। (দেখুন: সহীহ আল-বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৪১২৫)

    ১৭০. পাক-পবিত্র রাখার অর্থ শুধু ময়লা-আবর্জনা থেকে পরিষ্কার রাখা নয়। আল্লাহর ঘরের আসল পবিত্রতা হলো, সেখানে আল্লাহর ছাড়া আর কারোর নাম উচ্চারিত হবে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘরে বসে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে মালিক, প্রভু, মা‘বুদ, অভাবপূরণকারী বা ফরিয়াদ শ্রবণকারী হিসেবে ডাকে, সে আসলে তাকে নাপাক ও অপবিত্রই করে দেয়।

    ﴿وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِ‍ۧمُ رَبِّ ٱجۡعَلۡ هَٰذَا بَلَدًا ءَامِنٗا وَٱرۡزُقۡ أَهۡلَهُۥ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ مَنۡ ءَامَنَ مِنۡهُم بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ قَالَ وَمَن كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُۥ قَلِيلٗا ثُمَّ أَضۡطَرُّهُۥٓ إِلَىٰ عَذَابِ ٱلنَّارِۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ ١٢٦ ﴾ [البقرة: ١٢٦]

    ১২৬. আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম বলল, ‘হে আমার রব, আপনি একে নিরাপদ নগরী বানান এবং এর অধিবাসীদেরকে ফল-মুলের রিয্ক দিন১৭১ যারা আল্লাহ ও আখিরাত দিবসে ঈমান এনেছে’। তিনি বললেন, ‘যে কুফুরী করবে, তাকে আমি স্বল্প ভোগোপকরণ দিব।১৭২ অতঃপর তাকে আগুনের আযাবে প্রবেশ করতে বাধ্য করব। আর তা কত মন্দ পরিণতি’।

    ১৭১. পবিত্র সেই নগরীতে শান্তি, নিরাপত্তা ও আহার্য নিশ্চিত করে মহান আল্লাহ আল-কুরআনের অন্যত্র বলেন:

    ১৭২. ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন মানবজাতির নেতৃত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ তালাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, জবাবে তাকে বলা হয়েছিল, তার সন্তানদের মধ্য থেকে একমাত্র মুমিন ও সত্যনিষ্ঠরাই এ পদের অধিকারী হবে, যালিমদের এ অধিকার নেই। এখানে তিনি যখন রিযিকের জন্য প্রার্থনা করলেন, তখন আগের ফরমানটিকে সামনে রেখে কেবলমাত্র নিজের মুমিন সন্তান ও বংশধরদের জন্য দোয়া করলেন। কিন্তু এখানে মহান আল্লাহ জানিয়ে দিলেন, সত্যনিষ্ঠ নেতৃত্ব এক কথা, আর রিযিক ও আহার্য দান ভিন্ন বিষয় যা এই দুনিয়ায় মু'মিন ও কাফির নির্বিশেষে সবাইকে দেওয়া হবে। এ থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, কারোর অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য দেখে এ ধারণার কারণ নেই যে, আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট আছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সে-ই নেতৃত্ব লাভের অধিকারী।

    ﴿وَإِذۡ يَرۡفَعُ إِبۡرَٰهِ‍ۧمُ ٱلۡقَوَاعِدَ مِنَ ٱلۡبَيۡتِ وَإِسۡمَٰعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ١٢٧ ﴾ [البقرة: ١٢٧]

    ১২৭. স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবার ভিতগুলো উঠাচ্ছিল (এবং বলছিল,) হে আমাদের রব, আমাদের পক্ষ থেকে কবূল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।

    ﴿رَبَّنَا وَٱجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَيۡنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ أُمَّةٗ مُّسۡلِمَةٗ لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبۡ عَلَيۡنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١٢٨ ﴾ [البقرة: ١٢٨]

    ১২৮. হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধরের মধ্য থেকে আপনার অনুগত কাওম বানান।১৭৩ আর আমাদেরকে আমাদের ইবাদাতের বিধি-বিধান দেখিয়ে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

    ১৭৩. সন্তান-সন্ততির প্রতি মায়া-মমতা শুধুমাত্র স্বভাবগত ও সহজাত প্রবৃত্তিই না; বরং তা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশও বটে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সন্তানদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন, আর এভাবে প্রার্থনা করার জন্য তিনি মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত হয়েছিলেন। আল-কুরআনের অপর স্থানে তিনি দো‘আ করেন এভাবে:

    ﴿رَبِّ ٱجۡعَلۡنِي مُقِيمَ ٱلصَّلَوٰةِ وَمِن ذُرِّيَّتِيۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلۡ دُعَآءِ ٤٠ ﴾ [ابراهيم: ٤٠]

    “হে আমার রব! আমাকে সালাত কায়েমকারী বানিয়ে দিন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে থেকেও। হে আমাদের পালনকর্তা! আমার দো‘আ কবুল করুন”(দেখুন: সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪০)

    ﴿رَبَّنَا وَٱبۡعَثۡ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُزَكِّيهِمۡۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٢٩ ﴾ [البقرة: ١٢٩]

    ১২৯. হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবে১৭৪ এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত১৭৫ শিক্ষা দিবে আর তাদেরকে পবিত্র করবে।১৭৬ নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।১৭৭

    ১৭৪. তিলাওয়াতের মূল অর্থ অনুসরণ করা। শব্দটি কুরআন মাজীদ ও অন্যান্য আসমানী কিতাব পাঠ করার ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে। মানবরচিত কোনো গ্রন্থ পাঠে এ শব্দটি প্রয়োগ করা হয় নি। তাই আল্লাহর কিতাব অনুধাবন-অনুসরণের উদ্দেশ্য ছাড়া শুধু আবৃত্তি করলে তিলাওয়াতের হক আদায় হয় না।

    ১৭৫. এখানে ‘কিতাব’ বলতে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ কিতাবকে বুঝানো হয়েছে। আর ‘হিকমাহ’ শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়েছে সত্যে উপনীত হওয়া, ন্যায় ও সুবিচার এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ইত্যাদি। পরিভাষাটি আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হলে অর্থ দাঁড়ায় বাস্তব ও অনস্তিত্বের সব বস্তুর পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান এবং অসীম ও সুদৃঢ় উদ্ভাবনী শক্তি। আর অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয় বিদ্যমান সব বস্তুর বিশুদ্ধ জ্ঞান এবং সৎকর্ম, ন্যায় ও সুবিচার, সত্য কথা ইত্যাদি। আল-কুরআনে হিকমাহ বলে সুন্নাহকেও বুঝানো হয়ে থাকে।

    ১৭৬. পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করার অর্থ জীবনকে সত্য, সঠিক ও পরিচ্ছন্ন মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, চরিত্র-নৈতিকতা, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সামগ্রিকভাবে উন্নত দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে সুসজ্জিত করে গড়ে তোলা।

    ১৭৭. এখানে একথা বুঝানোই উদ্দেশ্য যে, মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব আসলে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ঐ দো‘আর প্রতু্ত্তর!

    ﴿وَمَن يَرۡغَبُ عَن مِّلَّةِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ إِلَّا مَن سَفِهَ نَفۡسَهُۥۚ وَلَقَدِ ٱصۡطَفَيۡنَٰهُ فِي ٱلدُّنۡيَاۖ وَإِنَّهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ لَمِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ١٣٠ ﴾ [البقرة: ١٣٠]

    ১৩০. আর যে নিজকে নির্বোধ বানিয়েছে, সে ছাড়া কে ইবরাহীমের আদর্শ থেকে বিমুখ হতে পারে? আর অবশ্যই আমরা তাকে দুনিয়াতে বেছে নিয়েছি এবং নিশ্চয় সে আখিরাতে নেককারদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

    ﴿إِذۡ قَالَ لَهُۥ رَبُّهُۥٓ أَسۡلِمۡۖ قَالَ أَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٣١ ﴾ [البقرة: ١٣١]

    ১৩১. যখন তার রব তাকে বললেন, তুমি আত্মসমর্পণ কর।১৭৮ সে বলল, 'আমি সকল সৃষ্টির রবের কাছে নিজকে সমর্পণ করলাম।

    ১৭৮. যে আল্লাহর অনুগত হয়, আল্লাহকে নিজের মালিক, প্রভু ও মা‘বুদ হিসেবে গ্রহণ করে, নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দেয় এবং দুনিয়ায় তাঁর দেওয়া বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করে, সে-ই মুসলিম। এই বিশ্বাস, প্রত্যয়, দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মপদ্ধতির নাম ‘ইসলাম’। মানব জাতির সৃষ্টিলগ্ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ও জাতিতে যেসব নবী ও রাসূল এসেছেন, এটিই ছিল তাঁদের সবার এক ও অভিন্ন দীন, জীবন পদ্ধতি, আহবান ও মিশন।

    ﴿وَوَصَّىٰ بِهَآ إِبۡرَٰهِ‍ۧمُ بَنِيهِ وَيَعۡقُوبُ يَٰبَنِيَّ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰ لَكُمُ ٱلدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ ١٣٢ ﴾ [البقرة: ١٣٢]

    ১৩২. আর এরই উপদেশ দিয়েছে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে এবং ইয়াকূবও১৭৯ (যে,) হে আমার সন্তানেরা, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দীনকে চয়ন করেছেন।১৮০ সুতরাং তোমরা মুসলিম হওয়া ছাড়া মারা যেয়ো না।

    ১৭৯. বনী ইসরাঈল (ইসরাঈল প্রজন্ম) সরাসরি হযরত ইয়াকূব আলাইহিস সালামের বংশধর হবার কারণে বিশেষভাবে তার নাম এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

    ১৮০. ‘দীন’ বিশ্বাস ও আচরণের কিছু মৌলনীতি যার পরিধি ইহলৌকিক জীবনের পুরো অঞ্চল জুড়ে সুবিস্তৃত। দীন আলাদাভাবে উল্লেখ থাকলে দীন ও শরী‘আহ উভয়টাকেই বুঝাবে। আর দীন ও শরিয়া একত্রে উল্লিখিত হলে, দীনের অর্থ হবে মৌলিক বিশ্বাস ও ইবাদত যা সকল তাওহীদী উম্মতকেই পালন করতে হতো। আর শরী‘আহর অর্থ হবে বিধানমালা যা জাতি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হতো।

    ﴿أَمۡ كُنتُمۡ شُهَدَآءَ إِذۡ حَضَرَ يَعۡقُوبَ ٱلۡمَوۡتُ إِذۡ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعۡبُدُونَ مِنۢ بَعۡدِيۖ قَالُواْ نَعۡبُدُ إِلَٰهَكَ وَإِلَٰهَ ءَابَآئِكَ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ إِلَٰهٗا وَٰحِدٗا وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ ١٣٣ ﴾ [البقرة: ١٣٣]

    ১৩৩. নাকি তোমরা সাক্ষী ছিলে, যখন ইয়াকূবের নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয়েছিল? যখন সে তার সন্তানদেরকে বলল, আমার পর তোমরা কার ইবাদাত করবে? তারা বলল, আমরা ইবাদাত করব আপনার ইলাহের, আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহের, যিনি এক ইলাহ। আর আমরা তাঁরই অনুগত।

    ﴿تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسۡ‍َٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٣٤ ﴾ [البقرة: ١٣٤]

    ১৩৪. সেটা এমন এক উম্মত যা বিগত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের জন্যই, আর তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্যই। আর তারা যা করত সে সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না।

    ﴿وَقَالُواْ كُونُواْ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰ تَهۡتَدُواْۗ قُلۡ بَلۡ مِلَّةَ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ حَنِيفٗاۖ وَمَا كَانَ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٣٥ ﴾ [البقرة: ١٣٥]

    ১৩৫. আর তারা বলে, তোমরা ইয়াহূদী কিংবা নাসারা হয়ে যাও, হিদায়াত পেয়ে যাবে। বল, বরং আমরা ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ করি, যে একনিষ্ঠ ছিল এবং যে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।১৮১

    ১৮১. এই জবাবটির মর্মার্থ বুঝতে দু’টি বিষয় সামনে রাখা দরকার:

    এক. খৃষ্টপূর্ব ৩য়-৪র্থ শতকে ইয়াহূদীবাদ আর ঈসা আলাইহিস সালামের সময়কালের বেশ কিছুকাল পরে খৃষ্টবাদের অভ্যুদয় ঘটে। তাই প্রশ্ন জাগে, ইয়াহূদী বা খৃষ্টবাদ গ্রহণ করাই যদি সঠিকপথ লাভের ভিত্তি হয়, তাহলে এর শত শত বছর আগে জন্মগ্রহণকারী ইবরাহীম আলাইহিস সালামসহ অন্যান্য নবীগণ ও সৎব্যক্তিবর্গ, যাঁদেরকে এরাই সৎপথপ্রাপ্ত বলে স্বীকার করে, তাঁরা সৎপথপ্রাপ্ত হলেন কিভাবে? আসল কথা হলো, বিশ্বব্যাপী যুগে যুগে প্রয়োজন অনুযায়ী মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবী-রাসূলদের মাধ্যমেই মানুষ বিশ্বাস ও দিক-নির্দেশনার অভিন্ন উপাদানের ভিত্তিতে চিরন্তন, শাশ্বত ও সহজ-সত্য পথের সন্ধান লাভ করেছে।

    দুই. ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থগুলোই ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোর ইবাদাত-বন্দেগী, উপাসনা-আরাধনা, প্রশংসা ও আনুগত্য না করার সাক্ষ্য দেয়। মহান আল্লাহর গুণ-বৈশিষ্ট্যের সাথে আর কাউকে শরীক না করাই ছিল তাঁর মিশন। কাজেই সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যে চিরন্তন সত্য-সরল একত্ববাদী পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, ইয়াহূদী ও খৃষ্টবাদ তা থেকে সুস্পষ্টভাবে বিচ্যুত হয়েছে। কারণ তাদের উভয়ের মধ্যে ঘটেছে শির্কের প্রকাশ্য মিশ্রণ।

    ﴿قُولُوٓاْ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيۡنَا وَمَآ أُنزِلَ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطِ وَمَآ أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَآ أُوتِيَ ٱلنَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمۡ لَا نُفَرِّقُ بَيۡنَ أَحَدٖ مِّنۡهُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ ١٣٦ ﴾ [البقرة: ١٣٦]

    ১৩৬. তোমরা বল, ‘আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা নাযিল করা হয়েছে আমাদের ওপর ও যা নাযিল করা হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানদের ওপর আর যা প্রদান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা প্রদান করা হয়েছে তাদের রবের পক্ষ হতে নবীগণকে। আমরা তাদের কারো মধ্যে তারতম্য করি না। আর আমরা তাঁরই অনুগত’।১৮২

    ১৮২. নবীদের মধ্যে পার্থক্য না করার অর্থ হচ্ছে, তাঁদের কেউ সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন আর কেউ তার উপর কায়েম ছিলেন না অথবা কাউকে মানি আর কাউকে মানি না আমরা তাদের মধ্যে এভাবে পার্থক্য করি না। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সব নবীই যুগে যুগে একই চিরন্তন সত্য ও একই সরল-সোজা পথের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। কাজেই যথার্থ সত্যপ্রিয় কারো পক্ষে সব নবীকে সত্যপন্থী ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মেনে নেওয়াই স্বাভাবিক। যিনি এক নবীকে মানেন আর অন্য নবীকে করেন অস্বীকার, তিনি আসলে যে নবীকে মানেন তাঁরও অনুগামী নন। কারণ মূসা আলাইহিস সালাম, ঈসা আলাইহিস সালাম ও অন্যান্য নবীগণ যে বিশ্বব্যাপী চিরন্তন সহজ-সত্য পথ দেখিয়েছিলেন তিনি আসলে তার সন্ধান পান নি, বরং তিনি নিছক বাপ-দাদার অনুসরণ করে নিজের পছন্দমত একজন নবীকে মানছেন। তার আসল ধর্ম হয়ে পড়ছে বর্ণবাদ, বংশবাদ অথবা কোনো ভৌগলিক জাতীয়তাবাদ সংক্রমিত এবং বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণ, কোনো নবীর অনুগামিতা নয়।

    ﴿فَإِنۡ ءَامَنُواْ بِمِثۡلِ مَآ ءَامَنتُم بِهِۦ فَقَدِ ٱهۡتَدَواْۖ وَّإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنَّمَا هُمۡ فِي شِقَاقٖۖ فَسَيَكۡفِيكَهُمُ ٱللَّهُۚ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ١٣٧﴾ [البقرة: ١٣٧]

    ১৩৭. অতএব, যদি তারা ঈমান আনে, তোমরা যেরূপে তার প্রতি ঈমান এনেছ, তবে অবশ্যই তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা বিমুখ হয় তাহলে তারা রয়েছে কেবল বিরোধিতায়, তাই তাদের বিপক্ষে তোমার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।১৮৩

    ১৮৩. মহান আল্লাহ আল-কুরআনের অন্য এক আয়াতে বলেন:

    ﴿وَٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِأَعۡدَآئِكُمۡۚ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ وَلِيّٗا وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ نَصِيرٗا ٤٥ ﴾ [النساء: ٤٥]

    “আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের ভালো করেই জানেন এবং তোমাদের সাহায্য-সমর্থনের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট”(দেখুন: সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৫)

    ﴿صِبۡغَةَ ٱللَّهِ وَمَنۡ أَحۡسَنُ مِنَ ٱللَّهِ صِبۡغَةٗۖ وَنَحۡنُ لَهُۥ عَٰبِدُونَ ١٣٨ ﴾ [البقرة: ١٣٨]

    ১৩৮. (বল,) আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করলাম। ১৮৪ আর রং এর দিক দিয়ে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক সুন্দর? আর আমরা তাঁরই ইবাদাতকারী।

    ১৮৪. صِبْغَةً ‘সিবগাহ’ শব্দের অর্থ রং বা বর্ণ, colour, dye, stain; পারিভাষিক অর্থে ‘যা ধারণ করা হয়’ বা ‘ধর্ম’ অথবা ‘দীন’ অর্থাৎ religion, creed, doctrine, belief আয়াতটির অর্থ হবে আমরা আল্লহর দীন ইসলামকে ধারণ করলাম।

    খ্রিষ্টানদের মধ্যে একটি বিশেষ রীতির প্রচলন ছিল। কেউ তাদের ধর্ম গ্রহণ করলে তাকে গোসল করানো হতো। আর এ গোসলের অর্থ ছিল, তার সব গুনাহ যেন ধুয়ে-মুছে গেলো এবং তার জীবন নতুন এক রং ধারণ করলো। তাদের কাছে এর পারিভাষিক নাম হচ্ছে ‘ইসতিবাগ’ বা ‘রঙ্গীন করা’ (ব্যাপটিজম: debut, launching or initiation)। তাদের ধর্মে যারা প্রবেশ করে কেবল তাদেরকেই ব্যাপটাইজড বা খৃষ্ট ধর্মে রঞ্জিত বলে ধারণা করা হয়। এমনকি খৃষ্টানদের শিশুদেরকেও ব্যাপটাইজড করা হয়।

    এ ব্যাপারেই আল-কুরআন বলছে, এ লোকাচারমূলক ‘রঞ্জিত’ হবার যৌক্তিকতা কোথায়? বরং মহান আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গীন হও। যা কোনো পানি দিয়ে হওয়া যায় না; বরং তাঁর বন্দেগীর পথ অবলম্বন করেই এ রঙ্গে রঙ্গীন হওয়া যায়।

    ﴿قُلۡ أَتُحَآجُّونَنَا فِي ٱللَّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمۡ وَلَنَآ أَعۡمَٰلُنَا وَلَكُمۡ أَعۡمَٰلُكُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُخۡلِصُونَ ١٣٩ ﴾ [البقرة: ١٣٩]

    ১৩৯. বল, তোমরা কি আমাদের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করছ অথচ তিনি আমাদের রব ও তোমাদের রব?১৮৫ আর আমাদের জন্য রয়েছে আমাদের আমলসমূহ এবং তোমাদের জন্য রয়েছে তোমাদের আমলসমূহ এবং আমরা তাঁর জন্যই একনিষ্ঠ।১৮৬

    ১৮৫. ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের পক্ষ থেকে আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে মুমিনদের সাথে বিবাদ করার কিছু নেই। বরং বিতর্ক যদি করারই থাকে তবে তা হতে পারে মুমিনদের তরফ থেকেই, কেননা তারাই তো মহান আল্লাহর সাথে অন্যদেরকে ইবাদাতের যোগ্য বানিয়ে নিয়েছে, মুমিনেরা নয়!

    ১৮৬. অর্থাৎ বিরোধীতাকারীদের কাজের জন্য তারা দায়ী, আর মুমিনদের কাজের জন্য মুমিনরা দায়বদ্ধ। তারা যদি তাদের বন্দেগীকে বিভক্ত করে থাকে এবং অন্য কাউকে আল্লাহর সাথে শরীক করে আরাধনা-উপাসনা ও আনুগত্য করে, তাহলে সে ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরিণাম তাদেরকেই ভোগ করতে হবে। মুমিনরা বলপূর্বক তাদেরকে ঐ কাজ থেকে বিরত রাখতে চায় না। তবে তাঁরা নিজেদের বন্দেগী, আনুগত্য ও উপাসনা-আরাধনা সবকিছুই একমাত্র আল্লাহর জন্যই একমুখী হয়ে নির্দিষ্ট করে নিয়েছে। যদি বিরোধীরা একথা স্বীকার করে নেয় যে, মুমিনদেরও এক আল্লাহর ইবাদাত করার ক্ষমতা ও অধিকার আছে, তাহলে তো সব বিবাদই মিটে যায়!

    ﴿أَمۡ تَقُولُونَ إِنَّ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطَ كَانُواْ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰۗ قُلۡ ءَأَنتُمۡ أَعۡلَمُ أَمِ ٱللَّهُۗ وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن كَتَمَ شَهَٰدَةً عِندَهُۥ مِنَ ٱللَّهِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ١٤٠ ﴾ [البقرة: ١٤٠]

    ১৪০. নাকি তোমরা বলছ, ‘নিশ্চয় ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাদের সন্তানেরা ছিল ইয়াহূদী কিংবা নাসারা? বল, ‘তোমরা অধিক জ্ঞাত নাকি আল্লাহ’?১৮৭ আর তার চেয়ে অধিক যালিম কে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে যে সাক্ষ্য রয়েছে তা গোপন করে?১৮৮ আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।

    ১৮৭. ইয়াহূদী ও খৃষ্টান জনতার মধ্যে যারা অজ্ঞতা ও মূর্খতাবশত মনে করত যে, এই বড় বড় মহান নবীদের সবাই ইয়াহূদী অথবা খৃষ্টান ছিলেন, তাদেরকে সম্বোধন করে এখানে একথা বলা হয়েছে।

    ১৮৮. এখানে সম্বোধন করা হয়েছে ইয়াহূদী ও খৃষ্টান আলেমদেরকে।

    ﴿تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسۡ‍َٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٤١ ﴾ [البقرة: ١٤١]

    ১৪১. সেটা ছিল একটি উম্মত, যারা বিগত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে, তা তাদের জন্য আর তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্য। আর তারা যা করত, সে সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না।১৮৯

    ১৮৯. এ বক্তব্যটি এই সূরার ১৩৪ নং আয়াতের অনুরূপ।

    সমাপ্ত