ইসলামের দৃষ্টিতে তাবিজ-কবচ
ক্যাটাগরিসমূহ
Full Description
ইসলামের দৃষ্টিতে তাবিজ কবচ
التمائم من منظور إسلامي
<بنغالي>
সানাউল্লাহ নজির আহমদ
ثناء الله نذير أحمد
সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
مراجعة: د/ محمد منظور إلهي
ইসলামের দৃষ্টিতে তাবিজ কবচ
আমাদের দেশে কতিপয় পীর-ফকির, শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেক সাধারণ মানুষই তাবিজ-কবচ, তাগা, কড়ি, শামুক, ঝিনুক ও গাছ-গাছালির শিকড়-বাকড় ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করেন এবং এটি বৈধ ও জায়েয মনে করেন। এ সম্পর্কে বাজারে কিছু বই-পুস্তক পাওয়া যায়, সে সব বইয়ে নির্ধারিত বিষয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো দলিল নেই, আছে কিছু মনগড়া কেচ্ছা-কাহিনী, অসংখ্য তদবিরের বর্ণনা ও তার বানোয়াট ফাজায়েল। এ সব বই পড়ে কেউ কেউ বিপদাপদ, দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, রোগ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের আশায় বিভিন্ন তদবির ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয় ও তা গ্রহণ করে। তারা এ ধরনের চিকিৎসার মূল্যায়ন ও তার বৈধতা-অবৈধতা সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ। অত্র নিবন্ধের মাধ্যমে আমরা এ বিষয়টির তত্ত্ব ও স্বরূপ উদঘাটন এবং ইসলামের দৃষ্টিতে তার হুকুম বর্ণনা করব।
এক. ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَأَى رَجُلًا فِي يَدِهِ حَلْقَةٌ مِنْ صُفْرٍ فَقَالَ: «مَا هَذِهِ الْحَلْقَةُ؟» قَالَ: هَذِهِ مِنَ الْوَاهِنَةِ. قَالَ: «انْزِعْهَا فَإِنَّهَا لَا تَزِيدُكَ إِلَّا وَهْنًا؛ فَإِنَّكَ لَوْ مِتَّ وَهِيَ عَلَيْكَ مَا أَفْلَحْتَ أَبَدًا»
“একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির হাতে তামার চুড়ি দেখে বললেন, এটা কি? সে বলল: এটা ওয়াহেনার অংশ। (ওয়াহেনার অর্থ এক প্রকার হাড়, যা থেকে কেটে ছোট ছোট তাবিজ আকারে দেয়া হয়।) তিনি বললেন: এটা খুলে ফেল, কারণ এটা তোমার দুর্বলতা বাড়ানো ভিন্ন কিছুই করবে না। যদি এটা বাঁধা অবস্থায় তোমার মৃত্যু হয়, তবে কখনও তুমি সফল হবে না”।[1]
দুই. উকবা ইবন আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,
«مَنْ تَعَلَّقَ تَمِيمَةً، فَلَا أَتَمَّ اللهُ لَهُ، وَمَنْ تَعَلَّقَ وَدَعَةً، فَلَا وَدَعَ اللهُ لَهُ»
“যে ব্যক্তি তাবিজ লটকালো, আল্লাহ তাকে পূর্ণতা দেবেন না, আর যে কড়ি ব্যবহার করলো, আল্লাহ তাকে মঙ্গল দান করবেন না”।[2]
তিন. উকবা ইবন আমের আল-জোহানি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقْبَلَ إِلَيْهِ رَهْطٌ، فَبَايَعَ تِسْعَةً وَأَمْسَكَ عَنْ وَاحِدٍ، فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، بَايَعْتَ تِسْعَةً وَتَرَكْتَ هَذَا؟ قَالَ: " إِنَّ عَلَيْهِ تَمِيمَةً " فَأَدْخَلَ يَدَهُ فَقَطَعَهَا، فَبَايَعَهُ، وَقَالَ: " مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ»
“একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে একদল লোক উপস্থিত হল। তিনি দলটির নয়জনকে বায়আত করলেন, একজনকে করলেন না। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! নয়জনকে বায়আত করলেন একজনকে করলেন না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তার সাথে তাবিজ রয়েছে। অতঃপর তিনি স্বহস্তে তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং তাকে বায়আত করলেন, আর বললেন, যে ব্যক্তি তাবিজ ব্যবহার করল সে শির্ক করল”।[3]
চার. একদা হুজায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এক ব্যক্তির হাতে জ্বরের একটি তাগা দেখতে পেয়ে তা কেটে ফেলেন। অতঃপর তিনি তিলাওয়াত করেন :
﴿ وَمَا يُؤۡمِنُ أَكۡثَرُهُم بِٱللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشۡرِكُونَ ١٠٦ ﴾ [يوسف: ١٠٦]
“তাদের অধিকাংশই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে তারা শির্ক করে।” [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১০৬] এ থেকে প্রমাণিত হয়, সাহাবী হুজায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মতে তাগা ব্যবহার করা শির্ক।
পাঁচ. সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত, আবু বশির আনসারি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কোনো এক সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী ছিলেন। সে সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনৈক ব্যক্তিকে এ নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন, “কোনো উটের গলায় ধনুকের ছিলা অথবা বেল্ট রাখবে না, সব কেটে ফেলবে।”
ছয়. আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর স্ত্রী জয়নব রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদিন আব্দুল্লাহ বাড়িতে এসে আমার গলায় তাগা দেখতে পান। তিনি বললেন, এটা কী? আমি বললাম, এটা পড়া তাগা। এতে আমার জন্য ঝাড়-ফুঁক দেয়া হয়েছে। তা নিয়ে তিনি কেটে ফেললেন এবং বললেন, আব্দুল্লাহর পরিবার শির্ক থেকে মুক্ত। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
«إِنَّ الرُّقَى، وَالتَّمَائِمَ، وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ»
“ঝাড়-ফুঁক, সাধারণ তাবিজ ও ভালোবাসা সৃষ্টির তাবিজ ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে শির্ক”।[4]
সাত. তাবেঈ আব্দুল্লাহ ইবন উকাইম সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ»
“যে ব্যক্তি কোনো কিছু ঝুলাবে, তাকে ঐ জিনিসের কাছেই সোপর্দ করা হবে”।[5]
এ সব দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, তাবিজ ব্যবহার করা হারাম ও শির্ক।
তাবিজ ইত্যাদি ব্যবহার করা ছোট শির্ক না বড় শির্ক?
কেউ যদি তাবিজ-কবচ, মাদুলি-কড়ি, শামুক-ঝিনুক, গিড়া, হাড়, তাগা-তামা-লোহা বা অনুরূপ কোনো ধাতব বস্তু গলায় বা শরীরের কোথাও ধারণ করে এবং এ ধারণা পোষণ করে যে, ঐগুলো বালা-মুসিবত দূর করার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ক্ষমতা রাখে, তবে তা বড় শির্ক। আর যদি এ ধরনের ধারণা না হয়, তবে তা ছোট শির্ক।
শাইখ সুলাইমান ইবন আব্দুল্লাহ বলেছেন, বালা-মুসিবত দূর করার উদ্দেশ্যে গিড়া, তাগা পরিধান করা ছোট শির্ক। অর্থাৎ যদি তা মাধ্যম বা উসিলা মনে করে ব্যবহার করা হয়।
শাইখ আব্দুল আযীয ইবন বায বলেছেন, শয়তানের নাম, হাড়, পুঁতি, পেরেক অথবা তিলিস্মা অর্থাৎ অর্থবিহীন বিদঘুটে শব্দ বা অক্ষর প্রভৃতি বস্তু দিয়ে তাবিজ বানানো ছোট শির্কের অন্তর্ভুক্ত। ফাতহুল মাজিদ গ্রন্থের টীকায় তিনি আরো বলেছেন : তাবিজ ব্যবহার করা জাহেলি যুগের আমল।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাবিজ-কবচ অনেক ধর্মের প্রতীকী চিহ্ন ছিল। যেমন হিন্দু পুরোহিতদের মাদুলী ধারণ করা, বিশেষ করে কালী শিবের পূজায়। উয়ারী সম্প্রদায়ের আকীদার অন্যতম প্রতীক ছিল বিভিন্ন ধরনের তাবিজ।
শাইখ হাফেয হেকামি বলেন: কুরআন ও হাদীস ব্যতীত, ইহুদিদের তিলিসমাতি, মূর্তি পূজারী, নক্ষত্র পূজারী, ফিরিশতা পূজারী এবং জিনের খিদমত গ্রহণকারী বাতিলপন্থীদের তাবিজ ব্যবহার; অনুরূপভাবে পুঁতি, ধনুকের ছিলা, তাগা এবং লোহার ধাতব চুড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে শির্ক। কারণ, এগুলো সমস্যা সমাধানের বৈধ উপায় কিংবা বিজ্ঞানসম্মত ঔষধ নয়।
এ হল সেসব তাবিজ কবচের হুকুম যাতে কুরআনের আয়াত, হাদীসের দো‘আ দরূদ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় না তার।
কুরআন-হাদীসের তাবিজ:
হ্যাঁ, যে সব তাবিজ-কবচে কুরআন হাদীস ব্যবহার করা হয় সে ব্যাপারে আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কতিপয় আলেম কুরআন-হাদীসে বর্ণিত দু’আসমূহের তাবিজ ব্যবহার করা বৈধ মনে করেন। যেমন, সাঈদ ইবনু মুসাইয়িব, আতা, আবু জাফর আল-বাকের, ইমাম মালেক। এক বর্ণনা মতে ইমাম আহমদ, ইবন আব্দুল বার, বাইহাকি, কুরতুবি, ইবন তাইমিয়া, ইবন কাইয়্যিম এবং ইবন হাজারও রয়েছেন। তাদের দলিল, আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿وَنُنَزِّلُ مِنَ ٱلۡقُرۡءَانِ مَا هُوَ شِفَآءٞ وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ﴾ [الاسراء: ٨٢]
“আর আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করেছি যা রোগের সু-চিকিৎসা এবং মুমিনদের জন্য রহমত।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৮২]
﴿كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ مُبَٰرَكٞ﴾ [ص: ٢٩]
“এক কল্যাণময় কিতাব, তা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি।” [সূরা সোয়াদ, আয়াত: ২৯]
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন আমরের ব্যক্তিগত আমল সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি নিজ ছোট বাচ্চা, যারা দো‘আ মুখস্থ করতে অক্ষম, তাদেরকে অনিষ্ট থেকে রক্ষার জন্য গায়ে দো‘আর তাবিজ ঝুলিয়ে দিতেন। দো‘আটি এই:
«بِسْمِ اللَّهِ، أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ، مِنْ غَضَبِهِ وَعِقَابِهِ، وَشَرِّ عِبَادِهِ، وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ، وَأَنْ يَحْضُرُونِ»
“আল্লাহর নামে, তাঁর পরিপূর্ণ বাণীসমূহের মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তাঁর গজব ও শাস্তি থেকে, তাঁর বান্দাদের অনিষ্ট থেকে এবং শয়তানদের কুমন্ত্রণা ও তাদের উপস্থিতি থেকে”।[6]
পক্ষান্তরে অধিকাংশ সাহাবী ও তাদের অনুসারীদের মতে কুরআন ও হাদীসের তাবিজ ব্যবহার করাও নাজায়েয। তাদের মধ্যে রয়েছেন: আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ, ইবন আব্বাস, হুযাইফা, উকবা ইবন আমের, ইবন উকাইম, ইবরাহীম নাখআ’য়ি, একটি বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আহমদ, ইবনুল আরাবী, শাইখ আব্দুর রহমান ইবন হাসান, শাইখ সুলাইমান ইবন আব্দুল ওয়াহহাব, শাইখ আব্দুর রহমান ইবন সাদী, হাফেজ আল-হেকামি এবং মুহাম্মদ হামিদ আলফাকী। আর সমসাময়িক মণীষীদের মধ্যে আছেন শাইখ আলবানি ও শাইখ আব্দুল আজিজ ইবন বাজ। তারা বলেন,
প্রথমত : “উল্লিখিত আয়াত দ্বারা তাবিজের বৈধতা প্রমাণিত হয় না। উপরন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের দ্বারা চিকিৎসা করার স্বরূপ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, আর তা হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা। এ ছাড়া কুরআনের আয়াত তাবিজ আকারে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোনো প্রমাণ নেই, এমনকি সাহাবাদের থেকেও।”
তা ছাড়া ইমাম আবু দাউদ বলেছেন, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন আমেরের বর্ণিত হাদীসের সূত্র (সনদ) হাদীস বিশারদদের নিকট বিশুদ্ধ নয়। আর শুদ্ধ হলেও এটা তার একার আমল, যা অসংখ্য সাহাবীর বিপরীত হওয়ার ফলে এবং এর স্বপক্ষে কোনো দলিল না থাকার কারণে আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
আরেকটি কারণ, যেসব দলিলের মাধ্যমে তাবিজ নিষিদ্ধ প্রমাণিত হয়েছে, সেসব দলিলে পৃথক করে কুরআন-হাদীসের তাবিজ বৈধ বলা হয়নি। যদি বৈধ হত, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই তা বলে দিতেন। যেমন তিনি শির্কমুক্ত ঝাড়-ফুঁকের ব্যাপারটি অনুমতি দিয়েছেন। মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«اعْرِضُوا عَلَيَّ رُقَاكُمْ، لَا بَأْسَ بِالرُّقَى مَا لَمْ يَكُنْ فِيهِ شِرْكٌ»
“তোমাদের ঝাড়-ফুঁক আমার কাছে পেশ কর, ওটাতে শির্ক না থাকলে তাতে কোনো বাধা নেই”।[7]
পক্ষান্তরে তিনি তাবিজ সম্পর্কে এরূপ কিছু বলেন নি।
দ্বিতীয়ত : সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদের ছাত্র ইবরাহীম নাখ‘ঈ রহ. বলেন, তারা অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদের সঙ্গী-সাথী ও শিষ্যগণ কুরআন বা কুরআনের বাইরের সব ধরনের তাবিজ অপছন্দ করতেন। যেমন ’আলকামা, আসওয়াদ, আবু ওয়ায়েল, হারেস ইবন সুয়াইদ, ওবায়দা সালমানী, মাসরুক, রাবী‘ ইবন খায়সাম এবং সুয়াইদ ইবন গাফালাহ প্রমুখ তাবেঈগণ।[8]
তৃতীয়ত : অবৈধ পন্থার পথ রুদ্ধ করার জন্য শরী‘আত অনেক বৈধ কাজও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, সে হিসেবে নিষিদ্ধ তাবিজ থেকে উম্মতকে হিফাজত করার লক্ষ্যে বৈধ তাবিজও নিষিদ্ধ হবে – এমনটাই স্বাভাবিক। কারণ এ পথ খোলা রাখলে বাতিল তাবিজপন্থীরা সাধারণ মানুষের মন আল্লাহর ওপর ভরসা থেকে বিমুখ করে, তাদের লিখিত তাবিজের প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলার সুযোগ পাবে। শুধু তাই নয়, ঐ সব শয়তানদের প্ররোচনার কারণে কতক সাধারণ মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আর তারা মানুষের আসক্তি দেখে তাদের সহায়-সম্পদ লুটে নেয়ার ফন্দি আঁটে। যেমন, তাদেরকে বলে, তোমাদের পরিবারে, ধন সম্পত্তিতে বা তোমার ওপর এরূপ বিপদ আসবে। অথবা বলে, তোমার পিছনে জিন লেগে আছে ইত্যাদি। এভাবে এমন কতগুলো শয়তানি কথা-বার্তা তুলে ধরে যা শুনে সে মনে করে, এ লোক ঠিকই বলছে। সে যথেষ্ট দয়াবান বলেই আমার উপকার করতে চায়। এভাবেই সরলমনা মূর্খ লোকেরা তাদের কথায় বিশ্বাস করে ও অতঃপর ভয়ে অস্থির হয়ে যায়, আর তার কাছে সমাধান তলব করে। তাই তাবিজ কুরআন-হাদীসের হলেও ব্যবহার করা, রুগির বালিশের নিচে রাখা বা দেয়ালে ঝোলানো নাজায়েয বলাই অধিকতর শ্রেয়।
একটি সংশয় : অনেকে বলে থাকেন, তাবিজ, কবচ ইত্যাদি আমরা দো‘আ-দরূদ ও প্রাকৃতিক ঔষধের ন্যায় ব্যবহার করি। যদি তার অনুমোদন থাকে তবে তাবিজ কবচ নিষিদ্ধ কেন? এর উত্তর হচ্ছে : অসুখ-বিসুখ ও বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি পাওয়ার পদ্ধতি দুইটি :
এক. যা সরাসরি কুরআনের আয়াত বা রাসূলের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। একে শরীয়তী উপায় বা চিকিৎসা বলা যেতে পারে। যেমন ঝাড়-ফুঁক ইত্যাদি, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করে দেখিয়েছেন এবং যার বর্ণনা হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে রয়েছে। এগুলো আল্লাহর ইচ্ছায় বান্দার মঙ্গল সাধন বা অমঙ্গল দূর করে।
দুই. প্রাকৃতিক চিকিৎসা অর্থাৎ বস্তু ও তার প্রভাবের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক, যা খুবই স্পষ্ট এমনকি মানুষ সেটা বাস্তবে অনুভব ও উপলব্ধি করতে পারে। যেমন: বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি করা ঔষধ। ইসলামি শরী‘আত এগুলো ব্যবহার করার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছে। কারণ, এগুলো ব্যবহার করার অর্থই হচ্ছে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা, যিনি এ সব জিনিসে নির্দিষ্ট গুণাবলি দান করেছেন এবং তিনি ইচ্ছা করলে যে কোনো সময় এসব বস্তুর গুণ ও ক্রিয়া বাতিল করে দিতে পারেন। যেমন তিনি বাতিল করেছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জন্য প্রজ্বলিত অগ্নির দাহন ক্রিয়া। কিন্তু তাবিজ ইত্যাদির মধ্যে আদৌ কোনো ফলদায়ক প্রভাব নেই এবং তা কোনো অমঙ্গল দূর করতে পারে না। এতে জড় বস্তুর কোনো প্রভাবও নেই। তাছাড়া, মহান আল্লাহ এগুলোকে কোনো শরয়ী মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করেন নি। মানুষও স্বাভাবিকভাবে এগুলোর কোনো প্রভাব প্রতিক্রিয়া দেখে না, অনুভবও করতে পারে না। এ জন্য অনেকে বলেছেন, এগুলোর ওপর ভরসা করা, মুশরিকদের ন্যায় মৃত ব্যক্তি ও মূর্তির ওপর ভরসা করার সমতুল্য; যারা শুনে না, দেখে না, কোনো উপকারও করতে পারে না, আর না পারে কোনো ক্ষতি করতে। কিন্তু তারা মনে করে, এগুলো আল্লাহর কাছ থেকে তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, অথবা অমঙ্গল প্রতিহত করবে।
উদাত্ত আহ্বান : এখনো যে সকল আলেম তাবিজ-কবচ নিয়ে ব্যস্ত তাদের দরবারে আমাদের সবিনয় অনুরোধ, এর থেকে বিরত থাকুন। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগ, সাধারণ মানুষ খুব সহজেই টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট ও বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছে যে, তাবিজ-কবচ বৈধ নয় বা ইসলামে এর কোনো স্বীকৃতিও নেই। এমতাবস্থায় যারা তাবিজ-কবচ করেন বা বৈধ বলেন তাদের ব্যাপারে তারা বিব্রতকর অবস্থায় পতিত হন। আলহামদু লিল্লাহ, বর্তমান সময়ে আরবী শিক্ষিত ও সাধারণ শিক্ষিত অনেক ব্যক্তি, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম তাবিজ-কবজের অসারতা বুঝতে পেরে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। নিজে রিবত থাকছেন এবং অপরকে বিরত থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। যেহেতু এটা আকীদার বিষয়, তাই এখানে শিথিলতার কোনো সুযোগ নেই। অতএব, এ থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি। আল্লাহ সহায়।
সমাপ্ত
[1] সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৫৩১। হাদীসটি সহীহ্।
[2] মুসনাদ আহমদ, হাদীস নং ১৭৪০৪
[3] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১৭৪২২
[4] সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৮৮৩, সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৫৩০
[5] সুনান নাসায়ী, হাদীস নং ৪০৭৯ ও সুনান তিরমিযী, হদাসী নং ২০৭২
[6] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৬৬৯৬ ও সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫২৮। হাদীসটি হাসান।
[7] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২২০০
[8] ফাতহুল মজিদ