×
নেতৃত্ব এক মহান দায়িত্ব। যে ব্যক্তির ঘাড়ে এ দায়িত্ব বর্তাবে অবশ্যই তাকে নেতৃত্বের শর্ত পূরণ করে প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, যাপন করতে হবে প্রতিটি ক্ষণ আল্লাহর ভয় হৃদয়ে ধারণ করে। কেননা কেয়ামতের ময়দানে তাকে এ দায়িত্ব বিষয়ে অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হতে হবে।

    নেতৃত্ব এক মহান দায়িত্ব

    القيادة مسؤولية عظيمة

    < بنغالي >

    কামাল উদ্দিন মোল্লা

    كمال الدين ملا

    —™

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    নেতৃত্ব এক মহান দায়িত্ব

    মানুষের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলীর পরিপূর্ণতা আসে স্বভাবজাত গুণাবলী ও অর্জিত গুণাবলীর সংমিশ্রণের ফলে। সমাজের নেতা হন কম সংখ্যক ব্যক্তি; কিন্তু তাদের অনুসারী হন অনেক বেশি। নেতা যেদিকে চলেন সাধারণ মানুষ পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই তাদেরকে অনুসরণ করে থাকে। নেতার একটি ভুল বিরাট জনতাকে ধ্বংসের অতল তলে নিক্ষেপ করে থাকে। তাই ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের সাফল্যের জন্য সঠিক নেতৃত্বের অনুসরণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি নেতাদের দায়িত্ব সাধারণ মানুষদেরকে বিপথে পরিচালিত না করে সঠিক পথে পরিচালিত করা। নয়ত বিচার দিনে তারা সাধারণ মানুষের অভিযোগের মুখোমুখি হবেন এবং কঠিন শাস্তির জন্য বিবেচিত হবেন। এ কথাটি কুরআনে মাজীদে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। সূরা আহযাবে এসেছে,

    ﴿يَوۡمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمۡ فِي ٱلنَّارِ يَقُولُونَ يَٰلَيۡتَنَآ أَطَعۡنَا ٱللَّهَ وَأَطَعۡنَا ٱلرَّسُولَا۠ ٦٦ وَقَالُواْ رَبَّنَآ إِنَّآ أَطَعۡنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَآءَنَا فَأَضَلُّونَا ٱلسَّبِيلَا۠ ٦٧ رَبَّنَآ ءَاتِهِمۡ ضِعۡفَيۡنِ مِنَ ٱلۡعَذَابِ وَٱلۡعَنۡهُمۡ لَعۡنٗا كَبِيرٗا ٦٨﴾ [الاحزاب: ٦٦، ٦٨]

    “যেদিন অগ্নিতে তাদের মুখমণ্ডল ওলট পালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রাসূলের আনুগত্য করতাম। তারা আরো বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথা মেনেছিলাম, অতঃপর তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের পালনকর্তা! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদেরকে মহা অভিসম্পাত করুন।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৬৬-৬৮]

    আল্লাহর প্রতি আনুগত্যহীন নেতৃত্ব সমাজের নৈতিক কাঠামো ও আধ্যাত্মিক শক্তিকে বিনষ্ট করে দেয়। এ অবস্থা থেকে বাঁচা তখনই সম্ভব যখন সমাজের ঐসব লোক, যারা সমাজের গণ্যমান্য এবং তার রাজনৈতিক ও চিন্তার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশ করে থাকে, তারা কোনো বিশেষ বিশ্বাস ও নীতিবোধ দ্বারা পরিচালিত হয় এবং কোনো মূল্যের বিনিময়েই সেটাকে পরিত্যাগ করতে রাজি থাকে না। এসব আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধাচারী নেতাদেরকে তাদের ধন সম্পদ ও পার্থিব উন্নতি আল্লাহর ক্রোধানল হতে বাঁচবার নিশ্চয়তা দেয় না। অসৎ নেতৃত্বের অনুসারীরা আল্লাহর রোষানল থেকে বেঁচে যাবে এমন ধারণা ঠিক নয়। উভয় দলই পাপিষ্ট। কুরআনে এসেছে,

    ﴿وَقَالَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لَن نُّؤۡمِنَ بِهَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانِ وَلَا بِٱلَّذِي بَيۡنَ يَدَيۡهِۗ وَلَوۡ تَرَىٰٓ إِذِ ٱلظَّٰلِمُونَ مَوۡقُوفُونَ عِندَ رَبِّهِمۡ يَرۡجِعُ بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٍ ٱلۡقَوۡلَ يَقُولُ ٱلَّذِينَ ٱسۡتُضۡعِفُواْ لِلَّذِينَ ٱسۡتَكۡبَرُواْ لَوۡلَآ أَنتُمۡ لَكُنَّا مُؤۡمِنِينَ ٣١ قَالَ ٱلَّذِينَ ٱسۡتَكۡبَرُواْ لِلَّذِينَ ٱسۡتُضۡعِفُوٓاْ أَنَحۡنُ صَدَدۡنَٰكُمۡ عَنِ ٱلۡهُدَىٰ بَعۡدَ إِذۡ جَآءَكُمۖ بَلۡ كُنتُم مُّجۡرِمِينَ ٣٢ وَقَالَ ٱلَّذِينَ ٱسۡتُضۡعِفُواْ لِلَّذِينَ ٱسۡتَكۡبَرُواْ بَلۡ مَكۡرُ ٱلَّيۡلِ وَٱلنَّهَارِ إِذۡ تَأۡمُرُونَنَآ أَن نَّكۡفُرَ بِٱللَّهِ وَنَجۡعَلَ لَهُۥٓ أَندَادٗاۚ وَأَسَرُّواْ ٱلنَّدَامَةَ لَمَّا رَأَوُاْ ٱلۡعَذَابَۚ وَجَعَلۡنَا ٱلۡأَغۡلَٰلَ فِيٓ أَعۡنَاقِ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْۖ هَلۡ يُجۡزَوۡنَ إِلَّا مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٣٣﴾ [سبا: ٣١، ٣٣]

    “আপনি যদি পাপিষ্টদেরকে দেখতেন, যখন তাদেরকে তাদের রবের সামনে দাঁড় করানো হবে, তখন তারা পরস্পর কথা কাটাকাটি করবে। যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত, তারা অহংকারীদেরকে বলবে, তোমরা না থাকলে আমরা মুমিন হতাম। অহংকারীরা দুর্বলকে বলবে, তোমাদের কাছে হিদায়াত আসার পর আমরা কি তোমাদের বাধা দিয়েছিলাম? বরং তোমরাই তো ছিলে অপরাধী। দুর্বলরা অহংকারীদেরকে বলবে, বরং তোমরাই তো চক্রান্ত করে আমাদেরকে নির্দেশ দিতে যেন আমরা আল্লাহকে না মানি এবং তার অংশীদার সাব্যস্ত করি। তারা যখন শাস্তি দেখবে, তখন মনের অনুতাপ মনেই রাখবে।” [সূরা সাবা: ৩১-৩৩]

    তবে কুরআনের প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে সমাজের বিপর্যয় ও অন্যায় অনাচারের জন্য অধিকতর দায়ী সমাজের বিত্তবান ও নেতারা। যেমন কুরআনে এসেছে,

    ﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا فِي قَرۡيَةٖ مِّن نَّذِيرٍ إِلَّا قَالَ مُتۡرَفُوهَآ إِنَّا بِمَآ أُرۡسِلۡتُم بِهِۦ كَٰفِرُونَ ٣٤ وَقَالُواْ نَحۡنُ أَكۡثَرُ أَمۡوَٰلٗا وَأَوۡلَٰدٗا وَمَا نَحۡنُ بِمُعَذَّبِينَ ٣٥﴾ [سبا: ٣٤، ٣٥]

    “কোনো জনপদে সতর্ককারী প্রেরণ করা হলেই তার বিত্তশালী অধিবাসীরা বলতে শুরু করেছে, তোমরা যে বিষয়সহ প্রেরিত হয়েছে আমরা তা মানি না। তারা আরো বলেছে, আমরা ধনে জলে সমৃদ্ধ। সুতরাং আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হব না।” [সূরা সাবা, আয়াত: ৩৪–৩৫]

    কুরআন তাদের এ দাবির প্রতিবাদ করে যে, ‘যেহেতু তারা সম্পদ, ক্ষমতা ও সংখ্যাধিক্যের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ, কাজেই কোনো রকম শাস্তি থেকে তারা নিশ্চিতরূপে মুক্ত।’ তাদের এ দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে কুরআনের বক্তব্য হচ্ছে, “আর তোমাদের সম্পদ এবং সন্তান এমন বস্তু নয় যে যা তোমাদেরকে মর্যাদায় আমার নিকটবর্তী করে দিতে পারে। তবে হ্যাঁ, যারা ঈমান আনবে এবং নেক কাজ করবে, পরন্তু সেসব লোকদের জন্য তাদের কাজের দ্বিগুণ বিনিময় রয়েছে এবং তারা উত্তমস্থানে শান্তিতে থাকবে।‌‌” যারা দীর্ঘকালব্যাপী পার্থিব ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মালিক থাকে, তাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। সম্পদ ও ক্ষমতার প্রমোদ তাদেরকে সদাচার ন্যায়পরায়ণতা ও যুক্তির দাবির প্রতি বধির করে দেয়। তাদেরকে এটা বিশ্বাস করানো অত্যন্ত কষ্টসাধ্য যে, তারা যে পথ অনুসরণ করছে, তা শেষ পর্যন্ত তাদেরকে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। যে সমস্ত লোক এমন ধরনের নেতৃত্বের অধীনে জীবন পরিচালনা করতে গিয়ে পথভ্রষ্ট হলো তারা কিয়ামত দিবসে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তা‘আলার কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলবে,

    ﴿ وَقَالَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ رَبَّنَآ أَرِنَا ٱلَّذَيۡنِ أَضَلَّانَا مِنَ ٱلۡجِنِّ وَٱلۡإِنسِ نَجۡعَلۡهُمَا تَحۡتَ أَقۡدَامِنَا لِيَكُونَا مِنَ ٱلۡأَسۡفَلِينَ ٢٩ ﴾ [فصلت: ٢٩]

    “হে আমাদের রব, যেসব জিন ও মানুষ আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল, তাদের দেখিয়ে দিন, আমরা তাদের পদদলিত করব, যাতে তারা যথেষ্ট অপমানিত হয়।” [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ২৯]

    কুরআনের এসব আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়ে থাকে যে দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্বের কারণে একটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্য নেমে আসে। জাতীয় দুর্ভাগ্যের একটি মারাত্মক কারণ হচ্ছে, ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্বের উত্থান এবং জনসাধারণ কর্তৃক তা মেনে নেওয়া।

    কুরআনের মতে যেকোনো প্রকার পাপ ও অন্যায় কাজের বিস্তার রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব রয়েছে জাতীয় নেতৃবৃন্দের ওপরই। যদি এতে তারা ব্যর্থ হন, তবে তারা যে সমাজের মধ্যমণি তার নৈতিক অধঃপতনের দায়িত্ব তাদেরকেই বহন করতে হবে।

    একটি জাতির অধঃপতন ও ধ্বংস ঠেকাতে পারে সমাজের নেতা ও মুরব্বীরা। এটা তাদেরই দায়িত্ব। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন জাতির মধ্যে কেউ পাপ কাজ করে এবং তার থেকে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী তাকে বাধা প্রদান না করে, তবে শাস্তি তাদের সবাইকে গ্রাস করে ফেলবে’’ তাই জাতির সংরক্ষণে সমাজের দায়িত্বশীলদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। নয়ত তাকেও পরকালে বহুগুণ ‘আযাবের সম্মুখীন হতে হবে।

    সমাপ্ত