×
এ প্রবন্ধে লিখক আল-কুরআন হিফয করার গুরুত্ব ও পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

    আল-কুরআনুল কারিম হিফয করার ব্যবহারিক পদ্ধতি

    نحو منهجية عملية في حفظ القرآن الكريم

    < বাংলা - بنغالي - Bengali >

    সানাউল্লাহ নজির আহমদ

    ثناء الله نذير أحمد

    —™

    সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

    মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক

    مراجعة: د/ محمد منظور إلهي

    شمس الحق صديق

    আল-কুরআনু কারিম হিফয করার ব্যবহারিক পদ্ধতি

    আলকুরআনুল কারিম হিফয করার ব্যবহারিক পদ্ধতি

    বর্তমান যুগে ইসলাম বিরোধীদের আধিপত্য বিস্তার ও আগ্রাসী কুটকৌশল সত্ত্বেও ইসলাম তার গতিময়তা ফিরে পাচ্ছে, প্রসারিত হচ্ছে ইসলামের চেতনা ও আদর্শ। যার পশ্চাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে মুসলিম তরুণগণ। বিশেষ করে তাদের কুরআনের প্রতি আগ্রহ, কুরআন তিলাওয়াত করা ও কুরআন হিফয করার বিষয়টি খুবই আশাব্যঞ্জক। আল্লাহর কালামের প্রতি তাদের এ আকর্ষণের ফলে আমরা ব্যক্তিতে, সমাজে বরং সর্বত্র সুন্দর পরিবর্তনের আভাস পাচ্ছি। তারা কুরআন তিলাওয়াত করছে, কঠোর শ্রম দিয়ে কুরআন হিফয করছে, বিশুদ্ধ উচ্চারণের জন্য মেহনত করছে, যা খুবই প্রশংসার যোগ্য। তবে এ ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতির অনুশীলন ও তার নির্দেশনার অভাবে অনেক যুবক মাঝপথে হোঁচট খায়। তারা অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও বিশুদ্ধ উচ্চারণ থেকে বঞ্চিত হয়। আরো বঞ্চিত হয় পূর্ণ কুরআন মুখস্থ ও তা আয়ত্তে রাখা থেকে। আবার কারো কুরআন হিফয থেকে বিরত থাকা, কারো হিফয বন্ধ করে দেয়া, কারো আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কুরআন হিফয করার সাহস না করা ইত্যাদি কারণে আমার এ নিবন্ধের অবতারণা। আশা করি আমার এ প্রবন্ধ তাদের কুরআনের প্রতি মনোযোগী করে তুলবে এবং কুরআনের ব্যাপারে তাদের যত্নশীল হতে সাহায্য করবে, বিশেষ করে কুরআন হিফয করার জন্য তাদের অন্তরে উৎসাহ যোগাবে। এ নিবন্ধ সার্থক, বাস্তবধর্মী ও ফলপ্রসূ করার জন্য বিভিন্ন জনের পরামর্শ নিয়েছি, এ ব্যাপারে যারা পারদর্শী ও পারঙ্গম তাদের সহায়তা গ্রহণ করেছি। অতঃপর প্রবন্ধটি আমি তিনটি পরিচ্ছদে সুবিন্যস্ত করেছি।

    প্রথম পরিচ্ছদ:

    হিফয আরম্ভ করার পূর্বে হিফযের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। যথা:

    ১. ইখলাস অর্জন করা: অর্থাৎ হিফযের মাধ্যমে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা। বলে নেওয়া ভালো, সালাত, সিয়াম, বায়তুল্লাহ শরিফের তাওয়াফ ইত্যাদি নিরেট ইবাদতগুলো কবুল হওয়ার জন্য ইখলাস ও আল্লাহর সন্তুষ্টি জরুরি। তদ্রূপ যেসব জিনিস আমাদের জৈবিক ও শারীরিক চাহিদা পূরণ করে, যেমন পানাহার, পরস্পর লেনদেন, আচার-ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়কে ইবাদতে পরিণত করার জন্য ইখলাস ও আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রয়োজন, বরং শর্ত। আমাদের আলোচ্য বিষয় তথা কুরআন তিলাওয়াত ও কুরআন হিফয করা নিরেট ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত, যা ইখলাস ছাড়া আল্লাহর নিকট মূল্যহীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿فَمَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ رَبِّهِۦ فَلۡيَعۡمَلۡ عَمَلٗا صَٰلِحٗا وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦٓ أَحَدَۢا ١١٠﴾ [الكهف: ١١٠].

    “সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে”[সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ১১]

    হাদীসে কুদসীতে রয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    «أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي، تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ».

    “শরিকদের মধ্যে আমি-ই অংশিদারী অংশের সবচেয়ে বেশি অমুখাপেক্ষী। যে আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করে কোনো আমল করলো, আমি তাকে এবং তার আমলকে প্রত্যাখ্যান করি। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৮৫) অতএব একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হিফয করা।

    ২. কুরআনের মহত্ত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা: এ বিষয়ে আমরা সামান্য আলোচনা করছি।

    • কুরআন আল্লাহর কালাম এ অনুভূতি অন্তরে জাগরুক রাখা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿حَتَّىٰ يَسۡمَعَ كَلَٰمَ ٱللَّهِ﴾ [التوبة: ٦].

    “তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনে”[সূরা আত-তওবাহ, আয়াত: ৬]

    কুরআনের সম্মান মূলত আল্লাহর সম্মান। আল্লাহর সম্মানের উর্ধ্বে কোনো সম্মান নেই, তাই আল্লাহর কালামের চেয়ে বেশি সম্মানিত কোনো বস্তু নেই।

    • কুরআন অবতীর্ন হওয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে চিন্তা করা। আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির দিকনির্দেশনা ও তাদের আলোকবর্তিকা স্বরূপ এ কুরআন নাজিল করেছেন। তিনি বলেন,

    ﴿ ذَٰلِكَ ٱلۡكِتَٰبُ لَا رَيۡبَۛ فِيهِۛ هُدٗى لِّلۡمُتَّقِينَ ٢ ﴾ [البقرة: ٢].

    “এই কিতাবটি, এতে কোনো সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াতস্বরূপ। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২]

    অপর এক স্থানে তিনি আরো বলেন,

    ﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ ﴾ [البقرة: ١٨٥].

    “রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে”[সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫]

    • কুরআনের মর্যাদার বিষয়টি এ থেকেও স্পষ্ট হয় যে, কুরআনের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে অন্য জিনিসও সম্মানের পাত্র হয়ে যায়। যে মাসে এ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সে মাস অন্য মাসের চেয়ে অধিক সম্মানের। যে রাতে এ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সে রাত অন্য রাতের তুলনায় অধিক সম্মানের। যে নবীর ওপর এ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সে নবী অন্য নবীর চেয়ে অধিক সম্মানের। কুরআনের বদৌলতেই শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সব নবী-রাসূল দের ইমাম ও গোটা আদম সন্তানের নেতা হিসেবে ভূষিত হয়েছেন। তিনি বলেন, আমি আদম সন্তানের সরদার, এতে কোনো অহঙ্কার নেই। যে কুরআন শিক্ষা করবে ও অন্যদের শিক্ষা দেবে তার মর্যাদা অন্য সবার চেয়ে বেশি। উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ القُرْآنَ وَعَلَّمَهُ».

    “তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়”(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০২৭)

    • আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের প্রসংশা করে বলেন,

    ﴿وَلَقَدۡ ءَاتَيۡنَٰكَ سَبۡعٗا مِّنَ ٱلۡمَثَانِي وَٱلۡقُرۡءَانَ ٱلۡعَظِيمَ ٨٧ ﴾ [الحجر: ٨٧].

    “আর আমরা তো তোমাকে দিয়েছি পুনঃপুনঃ পঠিত সাতটি আয়াত ও মহান কুরআন”[সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৮৭]

    ৩. হাফেযে কুরআনের ফযিলত ও তার সাওয়াবের জ্ঞান লাভ করা: কুরআন হিফযের প্রস্তুতি হিসেবে হাফেযে কুরআনের ফযিলত ও তার সাওয়াবের জ্ঞান লাভ করা। এর বর্ণনা বিভিন্ন হাদীসে এভাবে এসেছে। যেমন :

    • ওমর রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «إِنَّ اللهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا، وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ».

    “আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাবের দ্বারা অনেক জাতির উত্থান দান করেন এবং অপর জাতিসমূহের নিশ্চিত করেন পতন”(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮১৭)

    • ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ».

    “যে কুরআনের একটি হরফ পড়বে তার একটি নেকি হবে, আবার একটি নেকি দশটি নেকির সমান, আমার কথার উদ্দেশ্য এ নয় যে, الم একটি হরফ। বরং ألف একটি হরফ لام একটি হরফ ميم একটি হরফ”। (সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ২৯১০)

    • উকবা ইবন আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা সুফ্‌ফাতে ছিলাম, এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হন, অতঃপর তিনি বলেন,

    «أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنْ يَغْدُوَ كُلَّ يَوْمٍ إِلَى بُطْحَانَ، أَوْ إِلَى الْعَقِيقِ، فَيَأْتِيَ مِنْهُ بِنَاقَتَيْنِ كَوْمَاوَيْنِ فِي غَيْرِ إِثْمٍ، وَلَا قَطْعِ رَحِمٍ؟» ، فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ نُحِبُّ ذَلِكَ، قَالَ: «أَفَلَا يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمُ، أَوْ يَقْرَأُ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، خَيْرٌ لَهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ، وَثَلَاثٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلَاثٍ، وَأَرْبَعٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَرْبَعٍ، وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنَ الْإِبِلِ».

    “তোমাদের কার ইচ্ছে হয়, প্রতিদিন বুতহান বা আকিক নামক স্থানে গমন করা এবং কোনো অপরাধ বা সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়াই বিনা পরিশ্রমে বড় ও লম্বা চুটি সম্পন্ন দু’টি উট নিয়ে আসা? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা সকলে তা পছন্দ করি। অতঃপর তিনি বলেন, তোমরা কি সকাল বেলা মসজিদে গমন করতে পার না? সেখানে গিয়ে দুটি আয়াত শিক্ষা কর বা তিলাওয়াত কর। এটাই তোমাদের জন্যে দুটি উটের চেয়ে উত্তম। তিনটি আয়াত তিনটি উটের চেয়ে উত্তম। চারটি আয়াত চারটি উটের চেয়ে উত্তম। তদ্রূপ অন্যান্য আয়াতের বিষয়টিও”(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮০৩)

    • আবু উমামা আল-বাহিলী রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,

    «اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ».

    “তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, কারণ কুরআন কিয়ামতের দিন তার পাঠকারীর জন্যে সুপারিশ করবে”(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮০৪)

    • আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ: اقْرَأْ، وَارْتَقِ، وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِي الدُّنْيَا، فَإِنَّ مَنْزِلَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَؤُهَا».

    “হাফেযে কুরআনকে বলা হবে, পড় এবং ওপরে উঠ। তারতিলসহ পড় অর্থাৎ ধীরে ধীরে আবৃত্তি কর, যেমন দুনিয়াতে করতে। কারণ, সর্বশেষ আয়াতের স্থানই হবে তোমার মর্যাদার স্থান”(সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ১৪৬৪)

    • ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللهِ».

    “কুরআনে পারদর্শী ব্যক্তিই নিজ কওমের ইমামতি করবে”(মুসলিম ১:৪৬৫, হাদীস নং ৬৭৩)

    • আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «مَثَلُ الَّذِي يَقْرَأُ القُرْآنَ، وَهُوَ حَافِظٌ لَهُ مَعَ السَّفَرَةِ الكِرَامِ البَرَرَةِ، وَمَثَلُ الَّذِي يَقْرَأُ، وَهُوَ يَتَعَاهَدُهُ، وَهُوَ عَلَيْهِ شَدِيدٌ فَلَهُ أَجْرَانِ».

    “যে কুরআনে পারদর্শী এবং কুরআন পাঠ করে সে বিচরণকারী, পুণ্যবান ও সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গী। আর যে কষ্ট সত্ত্বেও বারবার কুরআন পাঠ করে, তার সাওয়াব দ্বিগুণ”(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৯৩৭)

    • আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «مَثَلُ المُؤْمِنِ الَّذِي يَقْرَأُ القُرْآنَ كَمَثَلِ الأُتْرُجَّةِ، رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا طَيِّبٌ، وَمَثَلُ المُؤْمِنِ الَّذِي لاَ يَقْرَأُ القُرْآنَ كَمَثَلِ التَّمْرَةِ، لاَ رِيحَ لَهَا وَطَعْمُهَا حُلْوٌ، وَمَثَلُ المُنَافِقِ الَّذِي يَقْرَأُ القُرْآنَ مَثَلُ الرَّيْحَانَةِ، رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ، وَمَثَلُ المُنَافِقِ الَّذِي لاَ يَقْرَأُ القُرْآنَ كَمَثَلِ الحَنْظَلَةِ، لَيْسَ لَهَا رِيحٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ»

    “যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে তারা দৃষ্টান্ত হচ্ছে উতরুজ্জা (লেবু তুল্য ফল) যার ঘ্রাণ মনোহর এবং যার স্বাদও আকর্ষনীয় । আর যে মু‘মিন কুরআন তিলাওয়াত করে না, সে খেজুর ফলের ন্যায়, যার ঘ্রাণ নেই, তবে স্বাদ খুব চমৎকার। পক্ষান্তরে যে মুনাফেক কুরআন পাঠ করে সে রায়হান ফলের ন্যায়, যার ঘ্রাণ চমৎকার, স্বাদ খুব তিক্ত। আর যে মুনাফেক কুরআন পড়ে না সে হানযালা বা কেদাঁ ফলের ন্যায়, যার কোনো ঘ্রাণ নেই, স্বাদ তিক্ত”(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৪২৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৯৭)

    ৪. বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণ করা: কুরআন তিলাওয়াত করা ও গভীর মনোযোগসহ কুরআন শোনা হিফযের জন্য খুব সহায়ক।

    ক. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَتۡلُونَ كِتَٰبَ ٱللَّهِ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنفَقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ سِرّٗا وَعَلَانِيَةٗ يَرۡجُونَ تِجَٰرَةٗ لَّن تَبُورَ ٢٩ ﴾ [فاطر: ٢٩].

    “নিশ্চয় যারা আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন করে, সালাত কায়েম করে এবং আল্লাহ যে রিয্‌ক দিয়েছেন তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসার আশা করতে পারে যা কখনো ধ্বংস হবে না”[সূরা ফাতির, আয়াত: ২৯]

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ».

    “তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, কারণ কুরআন কিয়ামতের দিন তার পাঠকারীর জন্যে সুপারিশ করবে”(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮0৪)

    খ. কুরআন শ্রবণ করার প্রতি আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَإِذَا قُرِئَ ٱلۡقُرۡءَانُ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُۥ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ٢٠٤ ﴾ [الاعراف: ٢٠٤].

    আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমরা রহমত লাভ কর। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ২-৪]

    লাইস ইবন সাদ বলেন, কুরআন শ্রবণকারীর ন্যায় দ্রুত কারো ওপর রহমত অবতীর্ণ হয় না। দলীল হিসেবে তিনি আল্লাহর এ বাণী পেশ করেন,

    ﴿ وَإِذَا قُرِئَ ٱلۡقُرۡءَانُ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُۥ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ٢٠٤ ﴾ [الاعراف: ٢٠٤].

    “আর যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমরা রহমত লাভ কর”[সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ২০৪]

    ৫. কুরআন হিফয করার পূর্বে কুরআন পাঠ ও হিফয করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা: নিম্নে আমরা তার সামান্য আলোচনা পেশ করছি।

    • সাওয়াব ও মর্যাদার আশায় কুরআন পাঠ করা, যার সামান্য আলোচনা ইতিপূর্বে আমরা করেছি।

    • কুরআনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও তার শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য কুরআন পাঠ করা।

    • চিন্তাশক্তি ও বোধ-বুদ্ধির পরিশুদ্ধির জন্য কুরআন পাঠ করা, কুরআন সকল জ্ঞানের উৎস। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ ﴾ [النحل: ٨٩].

    “আর আমরা তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা”[সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৮৯]

    ৬. কুরআন হিফয করা সহজ এই বিশ্বাস মনে রাখা: আল্লাহর এ বাণী স্মরণ রাখা, যে আল্লাহ কুরআন সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَلَقَدۡ يَسَّرۡنَا ٱلۡقُرۡءَانَ لِلذِّكۡرِ فَهَلۡ مِن مُّدَّكِرٖ ١٧﴾ [القمر: ١٧].

    “আর আমরা তো কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব, কোনো উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি?” [সূরা আল-কামার, আয়াত: ১৭]

    ইমাম কুরতুবি রাহিমাহুল্লাহ এর ব্যাখ্যায় বলেন, অর্থাৎ আমি কুরআন হিফয করার জন্য সহজ করেছি, যে হিফয করতে চায় আমি তাকে সাহায্য করি, এর জন্য আছ কেউ?

    ৭. কুরআন মুখস্থ করার ইচ্ছা রাখা: হিফয শুরু ও হিফয চলমান রাখার জন্য দৃঢ় ইচ্ছা প্রয়োজন। অন্যথায় হিফয শুধু একটি আশা বা স্বপ্নই থেকে যাবে। তাই কুরআনের মর্যাদা, হাফেযদের মর্যাদা, কুরআন শোনা ও কুরআন তিলাওয়াত করার সাওয়াব ইত্যাদি নিয়ে ভাবা ও তার জন্য উৎসাহিত হওয়া।

    ৮. অন্যান্য ব্যস্ততা হ্রাস করা, হিফযের নিয়ত থাকা ও তার জন্য চেষ্টা অব্যহত রাখা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهۡدِيَنَّهُمۡ سُبُلَنَاۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٦٩ ﴾ [العنكبوت: ٦٩].

    আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন। [সূরা আল-‘আনকাবুত, আয়াত: ৬৯]

    মুদ্দাকথা : যে অবিরত চলতে থাকে, সে নিশ্চিত লক্ষ্যে পৌঁছায়। যে চেষ্টা করে সে সফল হয়। যে চাষ করে সে ঘরে ফসল তুলে। পিঁপড়ার ব্যাপারটি আমরা অনেকেই জানি, সে উঁচুতে উঠতে বারবার চেষ্টা করে, ব্যর্থ হয়, পড়ে যায়, তার পরেও সে ক্ষান্ত হয় না, চেষ্টা ত্যাগ করে না, বরং আরো উৎসাহ নিয়ে পুনরায় চেষ্টা করে। কুরআনের একজন শিক্ষার্থীরও তদ্রূপ হওয়া জরুরি।

    ৯. প্রতিদিন কিছু সময় কুরআন হিফয করার জন্য নির্দিষ্ট করা: ফজর, আসর, মাগরিব বা অন্য কোনো সময় নিয়মিত কুরআন পাঠ করা। তবে জায়গা হিসেবে মসজিদকে প্রধান্য দেয়াই উত্তম। যেমন পূর্বের একটি হাদীসে রয়েছে : (أَفَلَا يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ) এবং এ জন্যও মসজিদকে প্রধান্য দেয়া উত্তম যে, হিফযের উপযুক্ত পরিবেশ অন্য কোথাও পাওয়া খুব কঠিন।

    দ্বিতীয়ত : মসজিদের আরেকটি ফযিলত রয়েছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত,

    « َمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ، إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ ».

    “যারা মসজিদে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য জড়ো হয় এবং পরস্পর মিলে দাওর (শোনা-শুনি) করে, তাদের ওপর বিশেষ প্রশান্তি (সাকিনা) নাযিল হয়, তাদেরকে আল্লাহর রহমত ঢেকে নেয়, ফেরেশতাগণ তাদের বেষ্টন করে নেয় এবং আল্লাহ তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন”(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬৯৯)

    অনেক সময় শরীর অলস ও উদ্যমহীন হয়ে পড়ে, তখন অপরের সঙ্গ চালিকাশক্তির ন্যায় কাজ করে এবং উৎসাহ প্রদান করে, যার ফলে কুরআন হিফযকারী আলস্য ত্যাগ করে পুনরায় হিফযে মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয়।

    ১০. কুরআনে পারদর্শী একজন ভাল উস্তাদ গ্রহণ করা: ওলামায়ে কেরাম বলেন, শুধু মাসহাফ বা কুরআনের ওপর নির্ভর করে কুরআন শিক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়া যথেষ্ট নয়, বরং এমন উস্তাদের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি যে, অপর বিজ্ঞ উস্তাদ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। সুলাইমান ইবন মূসা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এক সময় বলা হত : কাগজের কুরআন থেকে কুরআন গ্রহণ করো না।

    সাইদ তানুখি বলেন, আগে উস্তাদদের মুখের বুলি ছিল, তোমরা খাতা থেকে কুরআন শিখো না, তোমরা কুরআন থেকে কুরআন গ্রহণ কর না।

    কুরআন শিক্ষার বিশুদ্ধ পদ্ধতি হচ্ছে, শ্রবণ করা এবং মুখস্থ করা।

    ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন,

    «لَقَدْ حَفِظْتُ مِنْ فِيِّ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَبْعَيْنَ سُوْرَةً».

    সত্তরের চেয়ে বেশি সূরা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জবান থেকে সরাসরি শিখেছি। (ফাতহুল বারি : ৯/৪৬, হাদীস নং ৫০) কুরআনের অবশিষ্ট সূরা কিভাবে শিখেছেন? সে ব্যাপারে হাফেয ইবন হাজার রহ. তার বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, আসেমের বর্ণনায় রয়েছে, তিনি (ইবন মাসউদ) বলেন, বাকি অংশ শিক্ষা করেছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের থেকে। (ফাতহুল বারি: ৯/৪৮)

    কুরআন পড়ার জন্য উস্তাদ গ্রহণ করা এবং উস্তাদ থেকে সরাসরি কুরআন শিক্ষা করা আবশ্যক। সে জন্য সাহাবারা পর্যন্ত তাদের ছাত্রদের কুরআন শিক্ষার জন্য, সেসব সাহাবাদের নিকট প্রেরণ করতেন, যারা সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কুরআন শিক্ষা করেছেন। সাহাবী মা‘দী কারিবা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর নিকট এসে বললাম, আমাদেরকে طسم الْمِائَتَيْنِ অর্থাৎ সূরা শুআরা তিলাওয়াত করে শোনান। তিনি বললেন,

    «مَا هِيَ مَعِي، وَلَكِنْ " عَلَيْكُمْ مَنْ أَخَذَهَا مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: خَبَّابَ بْنَ الْأَرَتِّ "، قَالَ: فَأَتَيْنَا خَبَّابَ بْنَ الْأَرَتِّ، فَقَرَأَهَا عَلَيْنَا».

    “এ সূরা আমার নিকট নেই, তোমরা খাববাব ইবন আরত এর নিকট যাও, তিনি সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ সূরা শিক্ষা করেছেন। তিনি বলেন, অতঃপর আমরা খাববাব ইবন আরত এর নিকট আসি, তিনি আমাদেরকে তিলাওয়াত করে শোনান। (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২৯৮০)

    আমরা আরো দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বৎসর জিবরাইল আলাইহিস সালামের সঙ্গে কুরআন দাওর করতেন। যে বৎসর ইন্তেকাল করেন, সে বৎসর তিনি জিবরাইল আলাইহিস সালামের সঙ্গে দুবার দাওর করেন। (ফাতহুল বারি : ৯/৪৩, হাদীস নং ৪৯৯৮)

    রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের সরাসরি কুরআন শিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন,

    «خُذُوا القُرْآنَ مِنْ أَرْبَعَةٍ مِنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ فَبَدَأَ بِهِ، وَسَالِمٍ، مَوْلَى أَبِي حُذَيْفَةَ، وَمُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، وَأُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ».

    “তোমরা চার জন থেকে কুরআন শিক্ষা কর: ১. আবদুল্লা ইবন মাসউদ, ২. আবু হুযাইফার গোলাম সালেম, ৩. মুয়ায ইবন জাবাল থেকে এবং ৪. উবাই ইবন কাব”(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৪৬৪)

    ১১. কুরআন হিফয করার জন্য যে কোনো এক ছাপার কুরআন বাছাই নির্দিষ্ট করা।

    ১২. শেষ থেকে কুরআন হিফয আরম্ভ করা।

    বিশেষ করে ছোট বাচ্চা, দুর্বল স্মরণশক্তি বা অপেক্ষাকৃত কম আগ্রহীদের ব্যাপারে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা খুবই জরুরি। এর ফলে তারা অল্প সময়ে একটি সূরা মুখস্থ করতে পারবে, অন্য সূরার জন্য প্রস্তুতি নেবে ও উদ্যমী হবে।

    ১৩. আল্লাহ তা‘আলার নিকট স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, হিফয করা ও হিফয ধরে রাখার জন্য তাওফীক চাওয়া।

    দ্বিতীয় পরিচ্ছদ:

    প্রতিদিন কিছু অংশ মুখস্থ করার জন্য একটি চার্ট তৈরী করা:

    ১. হিফযের ছাত্রের জন্য জরুরি এক বৈঠকে যতটুকু অংশ হিফয করা সম্ভব প্রথমে তার পরিমাণ নির্ধারণ করা, বেশি নির্ধারণ না করা। বিশেষ করে যখন হিফয শুরু করা হয় বা যখন খুব আগ্রহ থাকে। এতে অলসতা কাছে ঘেঁসতে পারবে না এবং কম সময়ে মুখস্থ হওয়ার ফলে কুরআন ত্যাগ করার প্রবণতাও সৃষ্টি হবে না। বরং প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী সে নিজকে পরিচালিত করতে সক্ষম হবে। সে প্রত্যহ নির্ধারিত অংশ হিফয করাই নিজের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য জ্ঞান করবে।

    ২. প্রচলিত কুরআন (মাসহাফে উসমানি) ভাল করে পড়তে সক্ষম না হলে, একজন শিক্ষকের নিকট হিফয করার পূর্বে নির্ধারিত অংশ শিখে নেয়া।

    ৩. শব্দের উচ্চারণ নির্ভুল ও সঠিক রাখার জন্য কুরআন সামনে রাখা ও দেখে দেখে মুখস্থ করা।

    ৪. এক এক আয়াত করে পড়া এবং পরবর্তী আয়াতের সাথে সংযোগ করা। এক আয়াত এক লাইন থেকে ছোট হলে দুআয়াত করে পড়া। মুখস্থ করার অংশ দুলাইন বা তিন লাইনের বেশি না বাড়ানো।

    ৫. হিফযের সময় আওয়াজ সামান্য উঁচু রাখা। কারণ, নিচু আওয়াজ অলসতা সৃষ্টি করে, আবার উচুঁ আওয়াজের ফলে ক্লান্তি আসে ও অপরের অসুবিধার কারণ হয়। এটা স্বাভাবিক নিয়ম। কেউ যদি খুব একাগ্রতা ও নিবিড় চিত্তে নিচু আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করে, তবে কোনো সমস্যা নেই। হ্যাঁ, জিহ্বার নাড়াচাড়া আবশ্যক। জিহ্বার নাড়াচাড়া ছাড়া শুধু চোখ বুলানো যথেষ্ট নয়।

    ৬. হিফযের সময় আয়াতের উচ্চারণ তারতীলসহ করা অর্থাৎ ধীরে ধীরে ও বিরতি দিয়ে পড়া। তাজবিদের আহকামে ভুল না করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَرَتِّلِ ٱلۡقُرۡءَانَ تَرۡتِيلًا ﴾ [المزمل: ٤].

    “তুমি কুরআন তারতিলসহ পড়”[সূরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত : ৪]

    কুরআন দ্রুত মুখস্থ করার জন্য তাড়াহুড়া না করা, জিহ্বা দ্রুত নাড়াচাড়া না করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ لَا تُحَرِّكۡ بِهِۦ لِسَانَكَ لِتَعۡجَلَ بِهِۦٓ ١٦ ﴾ [القيامة: ١٦].

    “কুরআন তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে তুমি তোমার জিহ্বাকে দ্রুত আন্দোলিত করো না”[সূরা আল-কিয়ামাহ, আয়াত: ১৬]

    দ্বিতীয়ত : এ পদ্ধতিতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿ وَقُرۡءَانٗا فَرَقۡنَٰهُ لِتَقۡرَأَهُۥ عَلَى ٱلنَّاسِ عَلَىٰ مُكۡثٖ وَنَزَّلۡنَٰهُ تَنزِيلٗا ١٠٦ ﴾ [الاسراء: ١٠٦].

    “আর কুরআন আমরা নাযিল করেছি কিছু কিছু করে, যেন তুমি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পার ধীরে ধীরে এবং আমরা তা নাযিল করেছি পর্যায়ক্রমে”[সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ১০৬]

    একবার আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুরআন তিলাওয়াত কি রকম ছিল? তিনি বলেন, টেনে টেনে পড়তেন, অতঃপর بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ তিলাওয়াত করেন। তিনি বিসমিল্লাহতে মাদ করেন, আর-রাহমানে মাদ করেন ও আর-রাহীমে মাদ করেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫০৪৬)

    এ নিয়মেই সাহাবায়ে কেরাম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। একদা ইবন আব্বাসের ছাত্র আবু হাজার বলেন, আমি খুব দ্রুত কুরআন তিলাওয়াত করতে পারি, আমি তিন দিনে কুরআন খতম করি। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু তার প্রতিবাদ করে বলেন, চিন্তা, মনোযোগ ও তারতিলসহ এক রাতে শুধু সূরায়ে বাকারা পড়াই আমার কাছে উত্তম ও পছন্দনীয়, তোমার ন্যায় তিলাওয়াতের চেয়ে। অন্য বর্ণনায় আছে, প্যাঁচালের ন্যায় পড়ার চেয়ে। হিফযের সময় তারতিলসহ পড়ার ফলে চিন্তা ও গবেষণার সুযোগ হয়, সঙ্গে সঙ্গে আয়াতের অর্থ জানা যায় এবং হিফযও হয় সুদৃঢ়।

    ৭. নির্ধারিত অংশ মুখস্থ হলে নিজের কানে আওয়াজ পৌঁছে এমন উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করা।

    ৮. একবার না দেখে পড়ার পর পুনরায় দেখে পড়া, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, হিফয ঠিক আছে, শব্দ-বাক্য বা যের-যবর-পেশে কোনো ভুল নেই।

    ৯. জরুরি ভিত্তিতে মুখস্থ অংশটুকু কোনো অভিজ্ঞ উস্তাদকে পড়ে শোনানো।

    ১০. পূর্বে মুখস্থ অংশের সাথে পরবর্তী মুখস্থ অংশটুকু মিলিয়ে নেয়া। এভাবে প্রতিদিন মিলাতে থাকা।

    তৃতীয় পরিচ্ছদ:

    হিফয সমাপনের পর করণীয়:

    ১. হিফয নিয়ে রিয়া বা লৌকিকতায় লিপ্ত না হওয়া।

    আমাদের পরিভাষায় রিয়া দ্বারা উদ্দেশ্য : হিফয সমাপনের পর বা বিশ্বমানের তিলাওয়াত ও শ্রুতিমধুর কণ্ঠের জন্য সম্মান ও মর্যাদার প্রত্যাশী থাকা, মানুষের অন্তরে আত্মপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা, যা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। মাহমুদ ইবন লাবীদ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ " قَالُوا: وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: " الرِّيَاءُ، يَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ: اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً».

    “আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ের জিনিস হচ্ছে শির্কে আসগার। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল, শির্কে আসগার তথা ছোট শির্ক কি? তিনি বললেন, রিয়া তথা লোক দেখানো আমল। অতঃপর তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের আমলের প্রতিদান দিবেন, তখন রিয়াকারীদের বলবেন, তোমরা তাদের কাছে যাও, যাদের দেখানোর জন্য আমল করতে, দেখ তাদের কাছে কোনো প্রতিদান পাওয়া যায় কি-না? (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২৩৬৩০)

    যে ব্যক্তি কুরআনকে নিয়ে রিয়াতে লিপ্ত হবে, সে নিজকে কঠিন আযাবের সম্মুখীন করবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُقَالَ: جَرِيءٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ، وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ، وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ: عَالِمٌ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ: هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ، وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا؟ قَالَ: مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلَّا أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ: هُوَ جَوَادٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ، ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ».

    “সর্ব প্রথম যাদের ব্যাপারে কিয়ামতের দিন ফয়সালা হবে, তার মধ্যে ঐ ব্যক্তি রয়েছে যে, ইলম শিক্ষা করেছে, অপরকে শিক্ষা দিয়েছে ও কুরআন তিলাওয়াত করেছে। তাকে উপস্থিত করা হবে, অতঃপর তার ওপর প্রদত্ত নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে, সে তা স্বীকারও করবে। তাকে বলা হবে, তুমি এর ওপর কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি ইলম শিক্ষা করেছি, অপরকে শিক্ষা দিয়েছি এবং তোমার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন পড়েছি। তাকে বলা হবে, তুমি মিথ্যে বলছ, বরং তুমি ইলম শিক্ষা করেছ, যাতে তোমাকে আলেম বলা হয়, কুরআন পড়েছ যাতে তোমাকে কারী বলা হয়। অতঃপর তাকে চেহারার ওপর দাঁড় করিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়া হবে”(সহীহ মুসলিম, ১৯০৫) সুতরাং মুক্তি পেতে হলে, ইখলাস এবং নিয়ত ও উদ্দেশ্যকে পরিশুদ্ধ রাখা জরুরি।

    ২. কুরআন মোতাবেক আমল করা এবং সে অনুযায়ী আদব, আখলাক ও চরিত্র গঠন করা :

    কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আমল করার জন্য ও কুরআন মোতাবেক জীবন পদ্ধতি পরিচালনা করার জন্য। ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু বলেন, তোমাদের আমলের জন্যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, সুতরাং আমলের জন্য কুরআন পড়। তোমাদের কেউ কেউ পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করে, একটি হরফও বাদ পড়ে না, অথচ মোটেও সে কুরআন অনুযায়ী আমল করে না। কতক বিজ্ঞজন বলেছেন, কেউ কেউ কুরআন তিলাওয়াত করে নিজের ওপরই অভিসম্পাত করে, অথচ সে জানেও না। যেমন কুরআনের অনেক জায়গায় রয়েছে অত্যাচারী তথা নিজেদের ক্ষতি সাধনকারীদের ওপর আল্লাহর লানত। অথচ কুরআনের ওপর আমল না করার কারণে সে নিজেই এর অন্তর্ভুক্ত। আবার সে তিলাওয়াত করে, মিথ্যুকদের ওপর আল্লাহর লানত। অথচ কুরআন অনুযায়ী আমল না করে সে নিজেও একজন মিথ্যুক। আনাস রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু বলেন, অনেক কুরআন পাঠকারী এমন রয়েছে, কুরআন যাদেরকে অভিসম্পাত করে।

    ৩. নিজেকে নিয়ে অহংকারে লিপ্ত না হওয়া বা অপরকে তুচ্ছ জ্ঞান না করা:

    অহংকার বা অপরকে তুচ্ছ জ্ঞান করার অর্থ আল্লাহর করুণা বা তাওফিকের কথা ভুলে নিজের কঠোর পরিশ্রম ও চেষ্টার ফলে হিফয সমাপন সমাপ্ত হয়েছে মনে করা ও আত্মতুষ্টিতে লিপ্ত হওয়া। অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাকে হিফযের তওফীক দিয়েছেন, যদি তার অনুগ্রহ না হত, কখনো সে পূর্ণ কুরআন বা তার কিয়দাংশ মুখস্থ করতে সক্ষম হত না। তাই হিফযের জন্য সর্বতোভাবে আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ স্বীকার করা, তার কৃতজ্ঞতা আদায় করা এবং শুধু তার দিকেই এ নেয়ামতের নিসবত করা জরুরি।

    মানুষের ওপর বড়ত্বের প্রকাশই অহংকার, এ থেকে বিরত থাকা। কারণ, মানুষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার মেহেরবাণীতে, তার করুণায়। তাই অন্যদের মূর্খ ভাবা বা তুচ্ছজ্ঞান করার কোনো সুযোগ নেই। যে এতে লিপ্ত হয়, তার হয়তো এর শাস্তির কথা জানা নেই। হাদীসে কুদসিতে রয়েছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    «الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِي، وَالْعَظَمَةُ إِزَارِي، فَمَنْ نَازَعَنِي وَاحِدًا مِنْهُمَا، قَذَفْتُهُ فِي النَّارِ».

    “অহংকার আমার চাদর, বড়ত্ব আমার পরিধেয় বস্ত্র, যে আমার এ দু’টোর যে কোন একটি নিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। (সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৮০৯০)

    আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

    «لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ».

    “যার অন্তরে সামান্য পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না”(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯১)

    ৪. কুরআন বারবার তিলাওয়াত করা:

    কুরআন মুখস্থ রাখার জন্য বারবার তিলাওয়াত করা এবং আগ্রহ সৃষ্টির জন্য হাদীস ইত্যাদি অধ্যয়ন করা। কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত ও তা ভুলে যাওয়ার ক্ষতি সম্পর্কে জানা। যেমন,

    • ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «إِنَّمَا مَثَلُ صَاحِبِ القُرْآنِ، كَمَثَلِ صَاحِبِ الإِبِلِ المُعَقَّلَةِ، إِنْ عَاهَدَ عَلَيْهَا أَمْسَكَهَا، وَإِنْ أَطْلَقَهَا ذَهَبَتْ».

    “হাফেযে কুরআনের উদাহরণ উটের মালিকের ন্যায়, যদি সে তাকে বেঁধে রাখে, নিজ আয়ত্তে রাখতে পারবে, অন্যথায় সে চলে যাবে”। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫0৩১)

    • সাহাবী আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «بِئْسَ مَا لِأَحَدِهِمْ أَنْ يَقُولَ نَسِيتُ آيَةَ كَيْتَ وَكَيْتَ، بَلْ نُسِّيَ وَاسْتَذْكِرُوا القُرْآنَ، فَإِنَّهُ أَشَدُّ تَفَصِّيًا مِنْ صُدُورِ الرِّجَالِ مِنَ النَّعَمِ».

    “তোমাদের কারো এমন বলা যে, আমি অমুক আয়াত ভুলে গেছি, খুবই খারাপ। বরং তাকে ভুলানো হয়েছে। তার উচিত বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। কারণ, কুরআন মানুষের হৃদয় থেকে উটের চেয়ে দ্রুত পলায়নপ”(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৫৩২)

    • আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

    «تَعَاهَدُوا القُرْآنَ، فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَهُوَ أَشَدُّ تَفَصِّيًا مِنَ الإِبِلِ فِي عُقُلِهَا».

    “তোমরা বারবার কুরআন পড়, আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার জান, রশি থেকে উটের পলায়ন করার চেয়েও কুরআন দ্রুত পলায়নকারী”(সহীহ বুখারী হাদীস নং ৫০৩৩)

    এসব বর্ণনা ও অন্যান্য বর্ণনার ফলে আলেমগণ কুরআন খতমের কম মেয়াদ ও দীর্ঘ মেয়াদ ঠিক করে দিয়েছেন, যা অতিক্রম করা বৈধ নয়।

    কুরআন খতমের কম মেয়াদ: তিন দিন। আব্দুল্লাহ ইবন আমর বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «لَا يَفْقَهُ مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ فِي أَقَلَّ مِنْ ثَلَاثٍ».

    “যে তিন দিনের কমে কুরআন খতম করবে, সে কিছুই বুঝবে না”(সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩৯৪)

    মুয়াজ ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু তিন দিনের কমে কুরআন খতম করা মাকরূহ বলতেন। (ইবন কাসির : ফাজায়েলে কুরআন) ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু বলতেন, তোমরা সাত দিনে কুরআন খতম কর, তিন দিনের কমে কুরআন খতম কর না। (ফাতহুল বারি, ৯/৯৭)

    তিন দিনের কম কুরআন খতমে দ্রুত পড়ার দরুন চিন্তা-ফিকিরের সুযোগ থাকে না, বিরক্তির উদ্রেক হয়, শব্দ উচ্চারণ সঠিক হয় না, তিলাওয়াতও সুন্দর হয় না ইত্যাদি। যে সকল আকাবের ও বুযর্গানে দ্বীনের ব্যাপারে বর্ণিত রয়েছে, তারা তিন দিনের কমে কুরআন খতম করেছেন, সম্ভবত তাদের নিকট আমাদের বর্ণিত হাদীসগুলো পৌঁছেনি বা দ্রুত পড়া সত্ত্বেও তারা কুরআনে মনোযোগ ঠিক রেখেছেন বা রমযান ইত্যাদির মত কোন ফযিলতপূর্ণ সময়ে তারা এমন করেছেন। তারা এ সময়কে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। এটা তাদের চিরাচরিত নিয়ম ছিল না।

    কুরআন খতমের দীর্ঘ মেয়াদ: কুরআন খতমের দীর্ঘ মেয়াদ চল্লিশ দিন। আব্দুল্লাহ ইবন আমর থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করেন, কত দিনে কুরআন খতম করব? তিনি বলেন,

    «اقْرَأِ القُرْآنَ فِي أَرْبَعِينَ»

    “তুমি চল্লিশ দিনে কুরআন খতম কর”(সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ২৯৪৭)

    এ হাদীসের কারণে ইসহাক ইবন রাহওয়াইহ বলেন, চল্লিশ দিনের অধিক অতিবাহিত হবে, অথচ কুরআন খতম হবে না, এটা খুবই খারাপ। (সুনান তিরমিযী, ৫/১৯৭) তিনি আরো বলেন, চল্লিশ দিনের মধ্যে কুরআন খতম না করা মাকরূহ। (ইবন কাসির : ফাজায়েলে কুরআন)

    ৫. গুনাহ ও নাফরমানির কারণে কুরআন চলে যায়:

    হাদীসে রয়েছে গুনাহের কারণে মানুষ অনেক নেয়ামত হতে বঞ্চিত হয়, বিভিন্ন মুসিবতে গ্রেফতার হয়, যার মধ্যে বড় মুসিবত হচ্ছে কুরআন ভুলে যাওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

    «لَا يُصِيبُ عَبْدًا نَكْبَةٌ فَمَا فَوْقَهَا أَوْ دُونَهَا إِلَّا بِذَنْبٍ، وَمَا يَعْفُو اللَّهُ عَنْهُ أَكْثَرُ» .

    “মানুষ সামান্য মুসিবত বা তার চেয়েও ছোট বা বড় মুসিবতে নিজ গুনাহের কারণেই পতিত হয়। আর আল্লাহ তা‘আলা যেসব গুনাহ ক্ষমা করেন, তার পরিমাণ তো অনেক বেশি। (তিরমিযী: ৫:৩৭৭, হা.৩২৫২) কুরআন ভোলার ক্ষেত্রে গুনাহই বেশি দায়ী। জাহহাক ইবন মুজাহিম বলেন, যে কুরআন পড়ে ভুলে গেছে, সে মূলত নিজ গুনাহের কারণেই ভুলে গেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿وَمَآ أَصَٰبَكُم مِّن مُّصِيبَةٖ فَبِمَا كَسَبَتۡ أَيۡدِيكُمۡ وَيَعۡفُواْ عَن كَثِيرٖ ٣٠﴾ [الشورا: ٣٠].

    আর তোমাদের প্রতি যে মুসীবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। আর অনেক কিছুই তিনি ক্ষমা করে দেন। (সূরা আশ-শূরা আয়াত: ৩)

    কুরআন ভোলা সব চেয়ে বড় মুসিবত। (ইবন কাসির : ফাযায়েলে কুরআন) আগের যুগে যে কুরআন ভুলে যেত, সে খুবই কোণঠাসা হয়ে যেত। ইবন সিরিন থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে কুরআন ভুলে যেত তাকে তারা ঘৃণা করতেন, তার ব্যাপারে তারা কঠোর মন্তব্য করতেন। (ফাতহুল বারি, ৯/৮৬) এর কারণ হিসেবে কুরতুবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে পূর্ণ কুরআন বা তার কিয়দাংশ মুখস্থ করল, তার মর্যাদা অন্যদের তুলনায় বৃদ্ধি পেল। যদি সে এ মর্যাদার অবমাননা করে, অথবা এ মর্যাদা থেকে ছিটকে পড়ে, সে তিরস্কারের পাত্র। কুরআন না পড়ার অর্থ অজ্ঞতার শিকার হওয়া। (ফাতহুল বারি, ৯/৮৬)

    কারো মতে কুরআন ভুলে যাওয়া মারাত্মক গুনাহ। আবুল আলিয়া আনাস রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, আমরা সব চেয়ে বড় গুনাহ মনে করতাম, কুরআন পড়ে অলসতা বা গাফলতির কারণে ভুলে যাওয়া। (ফাতহুল বারি, ৯/৮৬)

    ইবন কাসির রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কতক আলেম কুরআন ভুলে যাওয়া ব্যক্তিকে কুরআন বিমুখ ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করে এ আয়াতের অর্ন্তভুক্ত জ্ঞান করেছেন,

    ﴿ وَمَنۡ أَعۡرَضَ عَن ذِكۡرِي فَإِنَّ لَهُۥ مَعِيشَةٗ ضَنكٗا وَنَحۡشُرُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ أَعۡمَىٰ ١٢٤ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرۡتَنِيٓ أَعۡمَىٰ وَقَدۡ كُنتُ بَصِيرٗا ١٢٥﴾ [طه: ١٢٤، ١٢٦].

    “আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন?” (সূরা ত্বহা, আয়াত: ১২৪, ১২৫)

    তখন আল্লাহ বলবেন,

    ﴿ كَذَٰلِكَ أَتَتۡكَ ءَايَٰتُنَا فَنَسِيتَهَاۖ وَكَذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمَ تُنسَىٰ ١٢٦ ﴾ [طه: ١٢٦].

    “এমনিভাবেই তোমার নিকট আমাদের নিদর্শনাবলী এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল”[সূরা ত্বহা, আয়াত: ১২৪৬] সামান্য হলেও সে এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, কুরআন তিলাওয়াত না করা, তার ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করা, স্বেচ্ছায় ভুলে যাওয়ারই শামিল, যা মারাত্মক অপরাধ। (ইবন কাসির: ফাযায়েলে কুরআন)

    ৬. কুরআন মুখস্থ রাখার পদ্ধতি:

    কুরআন মুখস্থ রাখার জন্য সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে তাওফীক মোতাবিক তিলাওয়াত করা। যাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়, তারা নিম্নের পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে :

    (ক) এক পারা আট ভাগ করে নেওয়া:

    ফজরের সুন্নত ব্যতীত অন্যান্য সুন্নতে মুয়াক্কাদাতে প্রতি দুরাকাতে একঅষ্টমাংশ পড়া। (জোহরের আগে-পরে সুন্নতে তিন অংশ, মাগরিবের সুন্নতে এক অংশ, এশার সুন্নতে এক অংশ, এভাবে আট অংশের পাঁচ অংশ পড়া হয়ে যাবে।)

    • আসরের আগে দু রাকা‘আত সালাতে এক অংশ পড়া। (এক অষ্টমাংশ)

    • ফরজ সালাতে ও তাহাজ্জুদের সালাতে দুই অংশ পড়া। (দুই অষ্টমাংশ)

    এভাবে প্রতি দিন সর্ব নিম্ন এক পারা অবশ্যই তিলাওয়াত করা।

    (খ) নফল সালাতে, গাড়িতে, আযান-ইকামাতের মাঝখানে, বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে, অফিসে যাওয়ার পথে এবং আসার সময়... আরো অন্যান্য সময়ে কুরআন তিলাওয়াত করা।

    (গ) ফজর সালাতের পরে সামান্য সময়ের জন্যে হলেও কুরআন পড়তে বসা, অন্ততঃ পক্ষে এক অষ্টমাংশ তিলাওয়াত করা।

    (ঘ) আরো উঁচু হিম্মত সম্পন্ন লোক মনজিল পদ্ধতিতে এক সপ্তাহে পূর্ণ কুরআন খতম করতে পারেন, নিম্নের বিন্যাস অনুসারে মাশায়েখ ও ওলামায়ে কেরামরা কুরআন খতম করতেন :

    • প্রথম দিনের পরিমাণ: সূরা আল-ফাতিহা থেকে সূরা আল-মায়েদার আগ পর্যন্ত।

    • দ্বিতীয় দিনের পরিমাণ: সূরা আল-মায়েদা থেকে সূরা ইউনুসের আগ পর্যন্ত।

    • তৃতীয় দিনের পরিমাণ: সূরা ইউনুস থেকে সূরা মারইয়ামের আগ পর্যন্ত।

    • চতুর্থ দিনের পরিমাণ: সূরা মারইয়াম থেকে সূরা আশ-শু‘আরার আগ পর্যন্ত।

    • পঞ্চম দিনের পরিমাণ: সূরা আশ-শু‘আরা থেকে সূরা আস-সাফ্‌ফাতের আগ পর্যন্ত।

    • ষষ্ঠ দিনের পরিমাণ: সূরা আস-সাফ্‌ফাত থেকে সূরা কাফ এর আগ পর্যন্ত।

    • সপ্তম দিনের পরিমাণ: সূরা কাফ থেকে সূরা আন-নাস-এর শেষ পর্যন্ত।

    আলাদা আলাদা এ পরিমাণ স্মরণ রাখার জন্য (فمي مشوق) শব্দটি মুখস্থ রাখা যায়। ف দ্বারা সূরা আল-ফাতিহার শুরু, م দ্বারা সূরা আল-মায়েদার শুরু, ي দ্বারা সূরা ইউনুসের শুরু, م দ্বারা সূরা মারইয়ামের শুরু, ش দ্বারা সূরা আশ-শু‘আরার শুরু, و দ্বারা সূরা আস-সাফ্‌ফাতের শুরু, ق দ্বারা সূরা ক্বাফ এর শুরু।

    যার দশ পারার কম মুখস্থ তার উচিত পুরো মুখস্থ অংশ প্রতি পনের দিন অন্তর একবার অবশ্যই পড়া। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দিন। আমীন।

    সমাপ্ত