×
আল্লাহর সতকীকরণ- ধরন-ধারণে, আকার-প্রকৃতিতে- বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে আপতিত হয়। কখনো ব্যাপক বিধংসী ঘূর্ণিঝড়ের আকৃতিতে, কখনো নির্বাধ-দুর্দমনীয় বন্যার আকারে, কখনো বা যুদ্ধের আকারে, কখনো প্রচণ্ড ভূমিকম্পের আকারে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করে থাকেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে এ বিষয়টি নিয়েই সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।

    ভূমিকম্প আমাদের যা শেখায়

    في الزلازل عبرة

    < بنغالي >

    আবু শু‘আইব মুহাম্মাদ সিদ্দীক

    أبو شعيب محمد صديق

    —™

    সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

    مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا

    ভূমিকম্প আমাদের যা শেখায়

    যারা পাপকর্মে লিপ্ত, যারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া সীমানা অতিক্রম করে চলে, তাদেরকে সতর্ক করে দেওয়া, পুনরায় তাদেরকে আল্লাহর ইবাদত-দাসত্বের বলয়ে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ভয় ভীতি প্রদর্শন করা, দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহ তা‘আলার অসীম রহমতের একটি বহিঃপ্রকাশ। কেননা তিনি এরূপ করে তাঁর বান্দাদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতি ফিরে তাকানোর এবং তাওবা করার সুযোগ করে দেন। এটা নিঃসন্দেহে তাঁর করুণা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণও আল্লাহর সতর্কীকরণকে এক অর্থে রহমতস্বরূপই দেখতেন।[1]

    আল্লাহর সতকীকরণ ধরন-ধারণে, আকার-প্রকৃতিতে, বিভিন্ন সময় বিভিন্নরূপে আপতিত হয়। কখনো ব্যাপক বিধংসী ঘূর্ণিঝড়ের আকৃতিতে, কখনো নির্বাধ-দুর্দমনীয় বন্যার আকারে, কখনো বা যুদ্ধের আকারে, কখনো প্রচণ্ড ভূমিকম্পের আকারে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করে থাকেন। কারণ তিনি চান না যে, মানুষ অবাধ্য হয়ে, তার বিধি-বিধানের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে, প্রবৃত্তি চালিত হয়ে জীবনযাপন করুক, যার ভয়াবহ পরিণতি হবে পরকালের দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক জীবন, জাহান্নাম।

    বর্তমানযুগে তো মানুষ তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অহমিকায়, যন্ত্রসভ্যতার নানা অর্জনের মোহাবিষ্টতায়, নিজকে অনেকটাই শক্তিমান ভাবতে শুরু করেছে। পৃথিবীর বুকে নিজকে ক্ষমতাবান বলে ধারণা করতে শুরু করেছে। মানুষের এ ধারণা যে অমুলক-অবান্তর, মানুষ যে কেবল অপারগ-অক্ষম তাই নয়; বরং মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলার নির্বাধ শক্তি প্রদর্শনী নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে দেখা অথবা তার বলয়ে এসে সকল বুদ্ধি-জ্ঞানসহ নস্যাৎ হয়ে যাওয়া ছাড়া যে তার আদৌ কিছু করার নেই, আল্লাহ তা‘আলা এ জাতীয় নিদর্শনের মাধ্যমে, খুবই উজ্জ্বলভাবে তা প্রমাণ করে দেন।

    মানুষকে সতর্ক করণের একটি মাধ্যম হল ভূমিকম্প, যার প্রকোপ বর্তমানযুগে অতীতের যে কোনো যুগের তুলনায় বেড়ে গেছে দৃষ্টিগ্রাহ্য আকারে। ভূমিকম্পের শক্ত থাবায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিশাল জনপদ, ধুলিস্যাৎ হচ্ছে আকাশচুম্বি বহু স্থাপনা, প্রাণ হারাচ্ছে বহু মানুষ, বাস্তুহারা হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। আর এসব কিছুই ঘটে যায় মাত্র কয়েক মিনেটের ঝাঁকুনিতে, কম্পনে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿قُلۡ هُوَ ٱلۡقَادِرُ عَلَىٰٓ أَن يَبۡعَثَ عَلَيۡكُمۡ عَذَابٗا مِّن فَوۡقِكُمۡ أَوۡ مِن تَحۡتِ أَرۡجُلِكُمۡ أَوۡ يَلۡبِسَكُمۡ شِيَعٗا وَيُذِيقَ بَعۡضَكُم بَأۡسَ بَعۡضٍۗ﴾ [الانعام: ٦٥]

    “বল, তিনি তো সক্ষম তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে তোমাদের ওপর ‘আযাব প্রেরণ করতে অথবা তোমাদেরকে বিভিন্ন সন্দেহপূর্ণ দলে বিভক্ত করতে এবং তোমাদের একদলকে অন্য দলের ভীতি আস্বাদন করাতে।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৬৫]

    একদিকে সতর্কীকরণ, অন্যদিকে মানুষের জুলুম-অন্যায়, আল্লাহ-বিমূখীতা, প্রকাশ্যে ও সম্পূর্ণ নির্লজ্জভাবে নিষিদ্ধ-হারাম-অশালীন কার্যসমূহ অবলীলায় করে যাওয়া ইত্যাদির শাস্তিস্বরূপ সংঘটিত হয়ে থাকে এসব ভূমিকম্প। যাতে মানুষ এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যারা বেঁচে যায় এবং যারা সরাসরি অথাব মিডিয়ার মাধ্যমে শুনতে পায়, দেখতে পায়, তারা যেন আযাবের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে আল্লাহর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রদর্শনী দেখে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। তাওবা করে কৃত পাপ-অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿وَمَا نُرۡسِلُ بِٱلۡأٓيَٰتِ إِلَّا تَخۡوِيفٗا﴾ [الاسراء: ٥٩]

    “আমরা তো নিদর্শনসমূহ কেবল ভীতিপ্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করি।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৫৯]

    প্রশ্ন হতে পারে, ভূমিকম্প হলে পাপী-তাপী, সৎ-অসৎ, নারী ও নিষ্পাপ শিশুরাও তো প্রাণ হারায় অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শাস্তি দেওয়া উদ্দেশ্য হলে সৎ ও নিষ্পাপ শিশুদেরকে কেন প্রাণ হারাতে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়?

    এর উত্তর হল, শাস্তি এলে সৎ-অসৎ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, সবাইকে শামিল করে নেয়। অতঃপর আখেরাতের জীবনে, যার যার নিয়তের নিরিখে পুনরুত্থিত করা হবে। যারা সৎ ও পাপমুক্ত তারা আল্লাহর রহমত ও সন্তুষ্টিতে শামিল হয়ে যাবে। ইমাম আহমদ র. উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করেন, উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যখন আমার উম্মতের মধ্যে পাপকর্ম প্রকাশ পাবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে-আসা আযাব তদেরকে শামিল করে নেবে। আমি প্রশ্ন করে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, তাদের মধ্যে কি তখন কোনো সৎ মানুষ থাকবে না? তিনি বললে, হ্যাঁ, থাকবে। আমি বললাম, ‌ তাহলে তাদের সাথে কী ধরনের আচরণ করা হবে? তিনি বললেন, অন্যদের যা হবে তাদেরও তাই হবে, অতঃপর (পরকালে) তারা আল্লাহর মাগফেরাম ও সন্তুষ্টির আশ্রয়ে যাবে।[2]

    কেউ হয়ত বলতে পারেন, আল্লাহ তো ইচ্ছা করলে Miraculously অলৌকিকভাবে সৎ ও নিষ্পাপ শিশুদেরকে ঘটনার জায়গা থেকে সরিয়ে নিতে পারেন, আর এমনটি হলে সৎ ও নিষ্পাপ শিশুরা অপ্রাপ্য কষ্ট-যাতনা থেকে বেঁচে যাওয়ার সুযোগ পেত।

    এর উত্তরে বলা যায়, হ্যাঁ, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে রক্ষা করতে অবশ্যই পারেন, তবে তিনি সাধারণত এরূপ করেন না। এরূপ করা তাঁর সুন্নত বা নিয়ম বহির্ভূত। কেননা তিনি তার সকল নিদর্শন প্রকাশ করে দেওয়া সত্ত্বেও খানিকটা গায়েবের পর্দা অবশিষ্ট রেখে দেন, যাতে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি, আচরণ ইত্যাদি পরীক্ষা করে নেয়ার বিধান অচ্ছেদ্যভাবে বাকি থাকে। কেননা যে সময় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿هَلۡ يَنظُرُونَ إِلَّآ أَن يَأۡتِيَهُمُ ٱللَّهُ فِي ظُلَلٖ مِّنَ ٱلۡغَمَامِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَقُضِيَ ٱلۡأَمۡرُۚ وَإِلَى ٱللَّهِ تُرۡجَعُ ٱلۡأُمُورُ ٢١٠﴾ [البقرة: ٢١٠]

    “তারা কি এরই অপেক্ষা করছে যে, মেঘের ছায়ায় আল্লাহ ও ফিরিশতাগণ তাদের নিকট আগমন করবেন এবং সব বিষয়ের ফয়সালা করে দেওয়া হবে। আর আল্লাহর নিকটই সব বিষয় প্রত্যাবর্তিত হবে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১০]

    আর যেহেতু বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি, ঈমান-আকীদা, কর্ম ও আচরণের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, তাই পরীক্ষার দাবি হল উত্তর দেওয়া না দেওয়া অথবা ভুল উত্তর দেওয়ার সুযোগ বাকি রাখা। তাই আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত নিদর্শন মানুষের সামনে হাজির করা সত্ত্বেও উত্তর না দেওয়া বা ভুল উত্তর দেওয়ার সুযোগ রেখে দেন। যা কিছু অদৃশ্যভাবে মেনে নিতে হবে তা যদি এখনই উন্মুক্ত করে সামনে এনে হাজির করা হয়, তাহলে তো শক-শোবাহ ও নানারূপ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে সত্য থেকে দূরে থাকার সকল সুযোগ রহিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় পরীক্ষার আর মাহাত্ম্য থাকে না। আর আল্লাহ যেহেতু এ পৃথিবীর জীবনে মানুষকে পরীক্ষা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তাই তিনি শক-শোবাহ ও নানারূপ ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে সত্য থেকে দূরে থাকার সুযোগ রেখে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‌

    ﴿قُل لَّا يَعۡلَمُ مَن فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ ٱلۡغَيۡبَ إِلَّا ٱللَّهُۚ وَمَا يَشۡعُرُونَ أَيَّانَ يُبۡعَثُونَ ٦٥ بَلِ ٱدَّٰرَكَ عِلۡمُهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِۚ بَلۡ هُمۡ فِي شَكّٖ مِّنۡهَاۖ بَلۡ هُم مِّنۡهَا عَمُونَ ٦٦﴾ [النمل: ٦٥، ٦٦]

    “বল, আল্লাহ ছাড়া আসমানসমূহে ও জমিনে যারা আছে তারা গায়েব জানে না। আর কখন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে তা তারা অনুভব করতে পারে না। আর আখেরাত সম্পর্কে তাদের জ্ঞান নিঃশেষ হয়েছে। বরং সে বিষয়ে তারা সন্দেহে আছে; বরং এ ব্যাপারে তারা অন্ধ।” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬৫-৬৬]

    সে হিসেবে যখনই ভূমিকম্প আসবে তখনই যদি আল্লাহ তা‘আলা, শিশু ও সৎ ব্যক্তিদেরকে ঘটনাস্থল থেকে অলৌকিকভাবে সরিয়ে নিতে শুরু করেন, তাহলে কি কেউ ভূমিকম্পের ঘটনার বস্তবাদী ব্যাখ্যা দিয়ে সত্য থেকে দূরে থাকার স্পর্ধা দেখাবে? এমতাবস্থায় পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ভুল উত্তর দেওয়ার সুযোগ কি অবশিষ্ট থাকে? এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলার আযাব যখন আসে, তখন তা সৎ ও শিশুদেরকেও বেষ্টন করে নেয়।

    যেসব দেশে বা জায়গায় ভূমিকম্প হচ্ছে সেসব দেশ ও জায়গার প্রতি দৃষ্টি দিলে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে। কুফর, শির্ক, দীন থেকে বিচ্যুতি, ইসলামি শরিয়তের বিধি-বিধান রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার এমনকী ব্যক্তি জীবন থেকে বিদায় দেওয়া, প্রকাশ্যে-দিবালোকে হারাম-অন্যায় কর্ম সম্পাদন করা ইত্যাদিই তো সেসব জনপদের সাধারণ অবস্থা যেখানে ভূমিকম্প ঘটছে।

    ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ মানুষের পাপের কারণেই আপতিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

    ﴿وَمَآ أَصَٰبَكُم مِّن مُّصِيبَةٖ فَبِمَا كَسَبَتۡ أَيۡدِيكُمۡ وَيَعۡفُواْ عَن كَثِيرٖ ٣٠﴾ [الشورا: ٣٠]

    ‌‍“আর তোমাদের প্রতি যে মুসিবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। আর অনেক কিছুই তিনি ক্ষমা করে দেন।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ৩০]

    অন্য এক আয়াতে এসেছে,

    ﴿مَّآ أَصَابَكَ مِنۡ حَسَنَةٖ فَمِنَ ٱللَّهِۖ وَمَآ أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٖ فَمِن نَّفۡسِكَۚ﴾ [النساء: ٧٩]

    “তোমার কাছে যে কল্যাণ পৌঁছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর তোমার কাছে যে অকল্যাণ পৌঁছে তা তোমার নিজের পক্ষ থেকে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৭৯]

    অতীতের সত্য অস্বীকারকারী জাতিদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

    ﴿ فَكُلًّا أَخَذۡنَا بِذَنۢبِهِۦۖ فَمِنۡهُم مَّنۡ أَرۡسَلۡنَا عَلَيۡهِ حَاصِبٗا وَمِنۡهُم مَّنۡ أَخَذَتۡهُ ٱلصَّيۡحَةُ وَمِنۡهُم مَّنۡ خَسَفۡنَا بِهِ ٱلۡأَرۡضَ وَمِنۡهُم مَّنۡ أَغۡرَقۡنَاۚ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيَظۡلِمَهُمۡ وَلَٰكِن كَانُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ يَظۡلِمُونَ ٤٠﴾ [العنكبوت: ٤٠]

    “অতঃপর এদের প্রত্যেককে নিজ নিজ পাপের কারণে আমরা পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারও ওপর আমরা পাথরকুচির ঝড় পাঠিয়েছি, কাউকে পাকড়াও করেছে বিকট আওয়াজ, কাউকে আবার মাটিতে দাবিয়ে দিয়েছি, আর কাউকে পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ এমন নন যে, তাদের উপর যুলুম করবেন; বরং তারা নিজেরা নিজদের ওপর যুলুম করত।” [সূরা আল-‘আনকাবুত, আয়াত: ৪০]

    আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “আল্লাহ কখনো জমিনকে অনুমতি দেন, অতঃপর তাতে বড় বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। ফলে মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতি, আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা, পাপ পরিত্যাগ করা, বিনম্র হয়ে আল্লাহর কাছে মিনতি করা ইত্যাদি দেখা দেয়।”

    অবশ্য বর্তমানযুগে নানা প্রকার জড়বাদী ব্যাখ্যার রাহুগ্রাসে আক্রান্ত হয়ে, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগ সংঘটিত হওয়ার সময়, পাপ পরিত্যাগ করা, বিনম্র হয়ে আল্লাহর কাছে মিনতি করা ইত্যাদি মানুষ অনেকটা ভুলেই গিয়েছে। তাদের ধারণা, এগুলো মানুষের পাপের কারণে ঘটে না; বরং এগুলোর পেছনে সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে। তারা মনে করে, এগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ না বলে আল্লাহর ‘আযাব বা সতর্কীকরণ বলা মূর্খতা বৈ অন্য কিছু নয়।

    যারা এরূপ বলে তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই। ঠিক আছে, এগুলো প্রাকৃতিক কারণে ঘটে। তবে প্রাকৃতিক কারণে কেন ঘটে সেটার ব্যাখ্যা দিলে ভালো হয়। নির্দিষ্ট সময়ে প্রকৃতিকে কে নির্দেশ দেন নড়ে চড়ে উঠতে? অথবা ঘটনা সংঘটিত হওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কারণসমূহ একত্রিত হতে কে নির্দেশ দেন? জড়বাদী ধারণানির্ভর বিজ্ঞান এ ধরনের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। প্রখ্যাত নাস্তিক ব্রাট্রান্ড রাসেল নিজেই বলেছেন, বিজ্ঞান একটি ফুলের রাসায়নিক ব্যাখ্যা দিতে পারে বটে; কিন্তু ফুলে সুগন্ধি থাকার পশ্চাতগত কারণ কী, বিজ্ঞান তা বলতে অপারগ। ব্রাট্রান্ড রাসেল তার গ্রন্থ Human Knowledge-এ এও বলেছেন যে, বিরাজমান পৃথিবীতে মানুষের গবেষণালব্ধ জ্ঞান কখনো কাউকে নিশ্চিত জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছায় না। একদিকে মানবচিন্তার সীমাবদ্ধতা, অন্যদিকে বিশ্বের রহস্যময় প্রকৃতি, নিশ্চিত জ্ঞানের পথে একটি দুর্ভেধ্য বাধা। মনুষ্যজ্ঞানের শেষসীমানা নিশ্চয়তা (Certainty) নয়; বরং সম্ভাবনা (Probability), অন্যভাবে বলতে গেলে, বাস্তবতাকে আমরা সরাসরি আবিষ্কার করতে সক্ষম নই। আমরা শুধু এতটুকু জানতে পারি যে, এখানে ওমুক সত্যের উপস্থিতির সম্ভাবনা আছে, যদিও তা আমাদের সরাসরি নিরীক্ষার বলয়ে আসছে না।

    সে হিসেবে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় অতি উৎসাহী হয়ে ধর্মীয় ব্যাখ্যা হতে চোখ বন্ধ করে রাখার আদৌ কোনো অর্থ হতে পারে না।

    ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান এখনো একথা বলতে অপারগ যে, নির্দিষ্ট কোন এলাকায় কখন ভূমিকম্প শুরু হবে? সুনির্দিষ্টভাবে তার মাত্রা কী হবে? সকল কারণ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও আদৌ ভূমিকম্প হবে কি হবে না, বিজ্ঞান এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারে না। এর অর্থ আকাশ ও পৃথিবীর অধিপতি আল্লাহ তা‘আলা যখন ভূমিকম্পের কারণগুলোকে সক্রিয় হতে নির্দেশ দেন তখন তা সক্রিয় হয়। তিনি যে মাত্রায় হতে বলেন সে মাত্রায়ই সংঘটিত হয়।

    আরো সহজভাবে বলতে গেলে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই হলেন সকল বিষয়ের স্রষ্টা যার মধ্যে রয়েছে ভূমিকম্পের কারণসমূহও। মানুষের পাপের কারণে কোনো এলাকাবাসীকে ভীতিপ্রদর্শন বা সতর্ক করার ইচ্ছা করলে আল্লাহ সে কারণসমূহকে সংঘটিত, সক্রিয় হতে বলেন, অতঃপর ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।

    আসলে মানুষের কৃতকর্মের কারণেই মানুষের ওপর নেমে আসে দুর্যোগ। যদিও আল্লাহ তা‘আলা অনেক কিছুই ক্ষমা করে দেন।

    সমাপ্ত

    [1] দারেমী-৩০

    [2] ইবন হাজার আল আসকালানী, বাযলুল মাউন: ১২৯