ইসলাম ও মানবতা

أعرض المحتوى باللغة العربية anchor

translation লেখক : চৌধুরী আবুল কালাম আজাদ

ইসলাম ও মানবতা

চৌধুরী আবুল কালাম আজাদ


﴿ الإسلام والإنسانية﴾

أبو الكلام أزاد


ইসলাম ও মানবতা

সকল সৃষ্টির স্রষ্টা মহান রাব্বুল আল-আমীন এই পৃথিবীতে তাঁর খলিফা বা স্থলাভিষিক্তরূপে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আর খিলাফত পরিচালনা তথা পার্থিব ও পারলৌকিক শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকনির্দেশনা-সম্বলিত জীবন বিধান হিসেবে ইসলামি জীবন ব্যবস্থা বা ইসলামি দর্শনের উৎস হিসেবে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ অবতীর্ণ করেছেন তার প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মাধ্যমে। আর জ্ঞানদান করার কারণে তাঁর সকল সৃষ্টির ওপর মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেনঃ এই জ্ঞান দ্বারা মানুষ ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা দেখতে পারে, বুঝতে পারে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে।

الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ ﴿2﴾

তিনি আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন, যেন পরীক্ষা করতে পারেন তোমাদের মধ্যে কারা সঠিক-সুন্দর পথে জীবন-যাপন করে (৬৭:২)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে সকল মানুষকেই ভালোবাসেন। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেছেন,

يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ﴿1﴾

হে! মানবজাতি, তোমরা তোমাদের প্রভুর (নির্দেশ মেনে চলার মাধ্যমে) তাকওয়া অবলম্বন কর, যিনি তোমাদের একই ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন আর তাদের থেকেই বহু নর ও নারী বিস্তৃত করেছেন। (৪:১)

ইসলামের মূল উৎস আল-কোরআনের উল্লেখিত আয়াতের মাধ্যমেই ইসলামি দর্শনে বিশ্বমানবতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সৃষ্টি-জগতে মানবজাতি একটি জাতি। এই মানবজাতির মধ্যে বিরাজ করবে প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসা। সাম্প্রদায়িকতা নয় বরং সম্প্রীতি। ঘৃণা, নিন্দা, হিংসা, প্রতিহিংসা বা পশুত্ব নয় বরং মানবতা। মানবপ্রেম তথা সৃষ্টি প্রেমের মাধ্যমেই লাভ করা যায় মানবজীবনের কাঙিক্ষত লক্ষ্য, মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রেম। আর এটাই শিক্ষা দিয়েছেন মহানবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর নবুয়তের ২৩ বছর তথা পার্থিব জগতের ৬৩ বছরের জীবনে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ তোমরা সবাই আদম সন্তান আর আদমকে বানানো হয়েছে মাটি দ্বারা। সুতরাং মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। হ্যাঁ যে মানুষ মানবতাবোধের অধিক মর্যাদা দিয়ে মানব তথা সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে মহান স্রষ্টার নির্দেশ অধিক পালন করবে, সে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী হবে। আল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ﴿13﴾

নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী যে আল্লাহর (নির্দেশ অধিক পালন করে, মন্দ কাজ পরিহার করে) তাকওয়া অধিক অবলম্বন করে। (৪৯:১৩)

ইসলামী দর্শনানুযায়ী মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম সালাতেই সে মানবতাবোধ, একতা, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের শিক্ষা দেয়া হয়। যে সমাজে মানবিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়, সে সমাজেই দেখা দেয় অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা, অন্যায় ও অবিচার। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নবুওয়ত প্রাপ্তির পর ইসলাম প্রচারের প্রারম্ভে একবার তিনি কোথাও যাচ্ছিলেন। রাস্তায় এক বৃদ্ধ মহিলাকে বড় বোঝা বহন করে নিয়ে যেতে দেখে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার সাহায্যার্থে বোঝাটি নিজের কাঁধে নিয়ে পথ চলতে চলতে জিজ্ঞেস করলেন, মা, তুমি এত বড় বোঝা নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? বৃদ্ধা জানালেন, তার এলাকায় মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি বেরিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে যার দেখা হয়, সে-ই পিতৃধর্ম হারিয়ে ফেলে। তাই বৃদ্ধ বয়সে পিতৃধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধা এই এলাকা ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আর কিছু না বলে বৃদ্ধাকে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিয়ে বিদায় চাইলে বৃদ্ধা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মানবতা ও মহানুভবতায় বিমুগ্ধ হয়ে তার নাম ও পরিচয় জানতে চান। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিথ্যা বলতে জানতেন না এবং কখনো মিথ্যা বলেননি। তিনি বললেন, আমার নাম মুহাম্মদ ইবনে আবদুলস্নাহ। বৃদ্ধা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মমতা ও মানবতা প্রেমে মুগ্ধ হন এবং বুঝতে পারেন এমন চরিত্র সত্য নবী ছাড়া কারো হতে পারে না। তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাক্ষাৎধন্য হয়ে মহাসত্য ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করেন। ইসলামি দর্শন হলো, মানবতার জন্য, মানুষের জন্য। ধর্ম তথা ইসলাম মানুষের কল্যাণের জন্য দেয়া হয়েছে। মানুষের ধর্ম বা ইসলামের জন্য বানানো হয়নি। মানুষের জন্যই ধর্ম বা ইসলাম। মানুষের পদভারে পৃথিবী প্রকম্পিত হলেও মানবতা আজ ভুলুণ্ঠিত। প্রকৃত মানুষের অভাব বড় বেশী। যে মানুষরূপী মানুষের কাছে মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তাহীনতা বোধ হয়, তাকে কি মানুষ বলা যায়? সবচেয়ে কষ্ট ও যন্ত্রণাদায়ক হলো মানুষ ধর্মের বৈপরীত্যের কারণে অমানুষিক, পশুসুলভ ও বর্বর আচরণ করছে। অথচ পৃথিবীর সব ধর্মই তো মনুষ্যত্ব শেখায়। শান্তির কথা বলে এবং মানবতার বাণী শোনায়। আমাদের সমাজে তথা বিশ্বসমাজে সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করলে মানবসমাজে অশান্তি থাকতে পারে না। কারণ সকল ধর্মই ভালো কাজ করা, মন্দ পরিহার করা এক কথায় মানবতার শিক্ষা দেয়। অথচ পৃথিবীর বহু ধর্মের পার্থক্যের কারণে তথাকথিত মানুষ মানুষকে হত্যা করছে, সম্পদ লুট করছে, এমনকি মা বোনদের সম্ভ্রম পর্যন্ত লুটছে। প্রায়ই মানবিক মূল্যবোধ বলে একটি কথা বলা হয়। আসলে এ পৃথিবীতে মানুষ সবকিছুরই মূল্য দেয়, শুধু মানুষের মূল্য দিতে কেন যে কুণ্ঠিত হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা এ পৃথিবীর সবকিছুই বানিয়েছেন মানুষের জন্য। বলেছেনঃ

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا

তিনি মহান আল্লাহ যিনি মানুষের মঙ্গলের জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন (২:২৯)। আর মানুষ বানিয়েছেন তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে, তাঁকে জানতে ও তাঁর নির্দেশিত পথে পরিচালিত হয়ে বাহ্যিক ও আত্মার শান্তি লাভ করতে। এ শান্তির জন্য প্রয়োজন আত্মার পরিশুদ্ধতা। আবার আত্মার পরিশুদ্ধতার জন্য কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ঘৃণা, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি ব্যাধিমুক্ত হয়ে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। আর মানবপ্রেম তথা সৃষ্টিপ্রেম ছাড়া এসব নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না।

অপরদিকে মানবতাবোধ, মানবপ্রেম সৃষ্টি তথা সৃষ্টি-প্রেমের মাধ্যামেই স্রষ্টাপ্রেম অর্জন করা যায়। ইসলামের মূল উৎস পবিত্র কোরআনে ঘোষিত বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বমানবতার আদর্শ অনুসরণ করার মাধ্যমেই বর্তমান ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বিশ্বে মানবসমাজে মানুষের প্রতি মানুষের স্নেহ, মমতা, সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব তথা মনুষ্যত্ব ও মানবতার যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে তা হ্রাস পেতে ও দূর হতে পারে।

ইসলামের মানবতার শিক্ষা হলো সংঘাত নয় সমঝোতা, সাম্প্রদায়িকতা নয় সহমর্মিতা, যুদ্ধ নয় শান্তি, পরনিন্দা নয় আত্মসমালোচনা, কুৎসা নয় আত্মশুদ্ধি, অহঙ্কার নয় বিনম্রতা, শত্রুতা নয় বন্ধুত্ব, পরশ্রীকাতরতা নয় ভ্রাতৃত্ব, জবরদস্তি নয় ন্যায় পরায়নতা, অমঙ্গল কামনা নয় সমবেদনা, ক্ষতিসাধন নয় কল্যাণ কামনা এবং হিংস্রতা ও পশুত্ব নয় সদাচরণ ও মানবতা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে মানবতাবোধে উদ্ভাসিত হয়ে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ ও শান্তি লাভ করার শক্তি দান করুন।

সমাপ্ত

1

ইসলাম ও মানবতা

402.7 KB PDF
2

ইসলাম ও মানবতা

506 KB DOC

ক্যাটাগরিসমূহ